সাতাশ রোজার গনগনে দুপুরের শনশনে ফাঁকা রাস্তায় অপেক্ষমান উবারের ট্যাক্সিতে তাড়াহুড়া করেই উঠতে যাবো, এমন সময় রাস্তার অন্য পাশ থেকে পাশের বাড়ির বুড়ো দারোয়ান দৌড়ে এসে সলজ্জ কাঁচুমাচু হাসিমুখে জানালো আজ রাতেই সে বাড়ি যাবে; ‘ইদের বখশিসটা স্যার।‘ পাড়ায় দারোয়ান বারো জনের জন্য মনে মনে বরাদ্দ তো আছেই। কিন্তু ওয়ালেট খুলে দেখি কোনো ছোট বা মাঝারি নোট তাতে নেই। বড়লোকদের মাঝে ছোট হয়ে বেঁচে থাকলেও দারোয়ানকে ফিরিয়ে দিয়ে তার কাছে ছোট হওয়ার বিপদ অনেক। পরে সে সকলের সামনে আমাকে আর সালাম ঠুকবে না। ‘ছোটলোকের’ সালাম ছাড়া বড়লোক হয়ে থাকা যায়? সমাজ মেনে নেবে? অতএব চারজনের বরাদ্দের সমপরিমান নোট তাকে একাই দিতে হলো। কচকচে নোটটা একরকম জলেই গেল; না ছিলো টিভি ক্যামেরা, না ছিলো কোনো সাক্ষী। যদিও ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তাতে কী?
সাদা চামড়ার মানুষের মন খারাপ হলে মুখ হয় লাল। সিনেমায় দেখতে ভালো লাগে; মনে হয় আহারে। উবারে উঠে দেখি বাঙাল ড্রাইভারের মুখ কালো– তাতে হতাশা! এমন মুখ কি আর ভালো লাগে? বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেস কী?’ বললো, ‘কেস দেয়ার লাইগাই হুদাই কাগজগুলি নিয়া গেল, স্যার। ফাঁকা রাস্তায় প্যাসেঞ্জার তোলার জন্যই তো দাঁড়াইছি! দুই মিনিটও হয় নাই! তারপরেও কমপক্ষে বারো’শ টাকার কেস দিবে বলছে! ইদের কামাইয়ের জন্য এইসব করতেয়াছে!’
: তো দুই তিন শ টাকা দিয়া দিতেন? ল্যাঠা চুইকা যাইতো! আর তো উপায় এই আমলে নাই।
: ফাঁকা রাস্তায় ঘুষ খাইবো না, স্যার! সবদিক থিকা দেখা যায় তো। জ্যাম থাকলে খায়া ফালাইতো। বলছে সামনে বক্স থিকা কাগজ নিয়াসতে।
ঠিকই তো! রোজার দিন বলে কথা। চা-বিড়ির দোকান, খাবার দোকান, সবই তো রমজান মাসে পর্দায় ঢাকা। বেপর্দা হয়ে ঘুষ খাওয়াটা সমিচীন হয় কী করে? এদিকে অফিসের তাড়া… মিটিংও আছে। বললাম, চলেন যাই।
বক্সের কাছাকাছি এসেই দেখলাম একজন হেঁটে হেঁটে লেগুনা, সিএনজি থেকে নির্বিচারে গাড়ির কাগজ সংগ্রহ করছে আর আরেকজন মোটরসাইকেলে বসে সেসব তদারকি করছে। একটু দূরেই নেমে সেসব কাণ্ডকারখানার ছবি তুলে নিলাম আগেভাগে; পরে লাগতেই পারে।
কাছে গিয়ে মোটরসাইকেলকে বললাম, ‘ভাই কী অপরাধে তার কাগজ বাজেয়াপ্ত করলেন?’ তিনি বললেন, ‘বক্সে আসেন।‘ বললাম, ‘তা না হয়ে যাবো, কিন্তু কারণটা তো এখানেই বলতে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘রাস্তায় পার্ক করার অপরাধে, বক্সে আসেন।‘ আমি বললাম যে, ‘রাস্তা তো ফাঁকা, আর প্যাসেঞ্জার নামাবে ওঠাবে কই?’ তিনি আবারো বললেন, ‘বক্সে আসেন।‘ কী তাজ্জব! পোশাকে তার শুধু ফার্স্ট নেইম লেখা, লাস্ট নেইম নিশ্চয়ই হবে বক্সি! ঘুষকুমার বক্সি!
কিছু নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেই হয়। আমরাও বক্সে গেলাম। সামনে চলে হ্যামিলনের কাগজওয়ালা, আর তার পিছনে ইঁদুরের দলের মতো উবার, সিএনজি, লেগুনার ড্রাইভারদের সারি।
সংক্ষেপে বলতে গেলে একরকম বন্ধুত্বপূর্ণ সুরেই ঘুষবিহীন কেস রফা হলো। হয়তো এভাবে সম্ভব হলো তার পোশাকের বিপরীতে আমার কাঁধে ক্যামেরার উপস্থিতির কারণে। বক্সি কুমারের পক্ষ নিয়ে উবার ড্রাইভারকে কপট বকাও দিলাম। বক্সির ঘর্মাক্ত নধর দেহ আর ধরা পড়ে যাওয়ার ফলে তেতে যাওয়া মেজাজ শীতল করতে তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ভাই আপনি ঠাণ্ডা হোন, একটু পানি খান!’ মোমের মতো গলতে থাকা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আপনের কি মাথা খারাপ? রোজার দিনে পানি খামু কেমনে?’ যাত্রার বিবেকের আওয়াজ শুনলাম, ‘ক্যান? ঘুষটা যেইভাবে খাইতে নিছিলেন?’
আমরা চলে আসলাম, বাকি ইঁদুরদের রমজানের পবিত্রতা রক্ষাকারি বক্সের ভেতরে রেখেই। সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বর সেখানেও আছেন। তাতে কী? মানুষ তো আর নাই।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন