নোয়াখালীর সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরি। এই যুগে এসেও লোকটা কখনো নিজের জন্য ভাবেননি, ভেবেছেন কেবলই অন্যের জন্য। ২০১৯ সালে নোয়াখালী পৌর পার্কে ভদ্রতা শেখানোর এক বিশেষ অভিযান চালান তিনি। নিজের অফিস, রাজনীতি, সন্তান-সন্ততি, বউ-বাচ্চাসহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে পুলিশ, র্যাব নিয়ে হাজির হন পৌর পার্কে, ভদ্রতা শেখানোর 'পবিত্র' মিশনে।
পুলিশ-র্যাব ছিলো বলে ভাববেন না বড় কোন অপরাধীকে ধরতে গিয়েছেন। উনি গিয়েছিলেন, মূলত পার্কে ঘুরতে আসা, আড্ডা দিতে আসা তরুণ-তরুণীদের ধরতে, তাদের ভদ্রতা শেখাতে। দিনের বেলা পার্কে ঘুরতে আসা, প্রেম করতে বা আড্ডা দিতে আসা কোন মর্মে অপরাধ বা অভদ্রতার সামিল হতে পারে তা অবশ্য আমরা অনেকেই তখন বুঝতে পারিনি। একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি হয়তো এটাকে অপরাধই ভেবেছেন, তাই এসেছেন। এসে থেমে যাননি। পুরো পার্ক ঘুরে সবাইকে ঘুরতে আসার অপরাধে বকে দিয়েছেন, ধমকে দিয়েছেন, কাউকে থানায় নিয়ে গিয়েছেন, মুচলেকা নিয়েছেন। ছবি তুলেছেন, সেই ছবি আবার ফেসবুকে ভাইরালও করিয়েছেন। বাবা-মাদের ডেকে এনে কড়া ভাষায় সন্তানের দিকে নজর করার রাখার কথা বলেছেন।
হয়তো এই দায়িত্ব তাকে কেউ দেয়নি। এই এখতিয়ার উনার আছে কিনা, এটাও অনেকে বলতে পারেন। কিন্তু তবু, নিজের মনের তাগিদেই, নিজেকে নিজেই দেয়া ভদ্রতা শেখানোর নাগরিক দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি।
পার্কে ঘুরে ঘুরে অন্যের সন্তানকে বকে দেয়ায় ব্যস্ত থাকা এই মহান ব্যক্তির একটি পুত্র সন্তান আছে। শাবাব চৌধুরী। ২০১৮ সালে এই পুত্র সন্তানের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে এক পথচারীর নিহত হয়। ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, গাড়ি এসে ফুটপাতে থাকা এই পথচারির পায়ের উপর উঠে যায়। পথচারীটি বাম্পার ধরে ফেলে। এরপর গাড়িটি পেঁছনে গিয়ে আরো দ্রুত গতিতে এসে ওই পথচারীকে ধাক্কা দিলে মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া এই পথচারী ঘটনাস্থলেই মারা যান। প্রতক্ষদর্শীরা ধারণা করেন, গাড়ি চালানোর সময় এমপিপুত্র মদ্যপ ছিলেন।
সম্প্রতি এই এমপিপুত্রেরই আরেকটি ঘটনা গত ১৩ই জুলাই রাতের। চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে পুলিশের একটি গাড়িকে ধাক্কা দেন তিনি। ধাক্কা দেয়ার পর পুলিশের সাথে বাক-বিতন্ডাও হয়। এরপর পুলিশ থানায় নিয়ে গেলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি।
আপনি ভাবছেন, এমপি পুত্রতো এমন হবেই! বেপরোয়া হবে, আইনকানুন মানবে না, দু-চারজনকে খুন করবে, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাবে-নাহলে আর এমপি পুত্র কিসের। কিন্তু এখানে তাজ্জব বিষয় এটাই, অন্য এমপি পুত্র না হয় এমন হলো... কিন্তু অন্যের সন্তানকে ভদ্রতা শেখানোয় ব্যস্ত থাকা, নিজের সব কাজ ফেলে পার্কে ঘুরে ঘুরে অন্যের সন্তানকে বকে দেয়া মহানুভব এমপির সন্তান কীভাবে এমন বেপরোয়া, আইন অমান্য কারি হতে পারে?
এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সমস্যাটি আসলে জনাব একরামুল করিম চৌধুরীর মহানুভবতায়। পার্কে পার্কে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অন্যের সন্তানকে তথাকথিত 'ভদ্রতা', 'আইনকানুন' শেখাতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন তিনি, যে নিজের পরিবার এমনকি নিজের সন্তানের কথাই ভুলে গিয়েছেন। নিজের সন্তানকে আইনকানুন, ভদ্রতা শেখানোর একদমই সময় পাননি। ১০ মিনিট সময় বের করে কোনদিন নিজের সন্তানকে বলতে পারেননি, বেপরোয়া গাড়ি চালাবে না বাবা, ফুটপাতে গাড়ি চালাবে না, বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে অন্যের গাড়িকে ধাক্কাও দিবে না। কিংবা ২০১৮ সালে একজনকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলার পর নিজের সন্তানকে মামলা-মোকদ্দমা-জেল থেকে বাঁচালেও, হয়তো একটু বকে দেয়ার সময়টিও পাননি তিনি।
শুধু কি এমপি সাহেব! এমপি সাহেবের স্ত্রী নোয়াখালী কবির হাট উপজেলার চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলিতো মানুষের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের সন্তান কোথায় থাকে সে খবরই রাখার সময় পান না। ২০১৮ সালে পথচারীকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় সারা বাংলাকে তিনি বলেন, ওই রাতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাদের ড্রাইভার। তার ছেলে শাবাব নাকি ঢাকাতেই ছিলেন না, ছিলেন নোয়াখালীতে।
আহা! কে জানে, শাবাব যখন ঘরে এসে মায়ের গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তিনি হয়তো রাত বিরাতে অন্যের ছেলেমেয়ের বাইরে যাওয়ার কুফল ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে গাড়ির চাবি কে নিলো খেয়াল করেননি। নিজের সন্তান ঢাকায় কখন আসলো, হয়তো খেয়াল করেননি তাও।
এই স্বার্থান্বেষী যুগে অন্যের স্বার্থের জন্য নিজের স্বার্থ ভুলে থাকা এমন মহানুভব ব্যক্তিত্ব আর কোথাও পাবেন না।
হে মহানুভব
আপনাকে স্যালুট!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন