ফিরে দেখা এরশাদ: রাজনীতির রসায়নে এক ব্লকবাস্টার মুভি নির্মাতা

১১৩০ পঠিত ... ১৯:২৯, জুলাই ১৪, ২০২০

এরশাদের মৃত্যুদিন আজ। আমাদের দেশের ইতিহাসান ভাইয়েরা দ্বি-দলীয় খুশিজল খেয়ে ইতিহাস রচনা করায়; ইতিহাস জুড়ে দলীয় খুশির ফোয়ারা ছুটতে থাকে। চোখের সামনে ঘটা ঘটনাপ্রবাহের 'হাওয়া ভার্সন' আর 'চেতনা ভার্সন' সারাক্ষণ প্রচারিত হওয়ায় এরশাদের 'বিপদের বাঁশি' ভার্সান সেই শেষবার বাতাবি লেবু টিভিতে বেজে তারপর বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আকিনো কুরোসাওয়ার 'রশোমন' চলচ্চিত্রের মতো নানাদিক থেকে এরশাদকে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সাদা-কালোর বাইরে ধূসর এলাকা দেখার চোখ আমাদের দলীয় ঠুলিপরা জনপদে একেবারেই নেই।

এরশাদ ছিলেন পোকিত 'সাতে পাঁচে থাকি না দাদা'। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এ কারণে উনি ফুল-লতা-পাতার কবিতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। হাওয়া ইতিহাসান এরশাদকে ভারতে প্রশিক্ষণ নেবার কারণে গরিব ভারতের গুপ্তচর মনে করেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ফিরে যাবার কারণে চেতনা ইতিহাসান এরশাদকে গরিব পাকিস্তানের গুপ্তচর মনে করেন। কপিরাইট না মেনে বিদেশি স্পাই স্টোরি কপি পেস্ট করে আবার সে ফুলকপি স্টোরির কপিরাইট দাবি করা 'মাসুদ রানা' পড়ে বড় হওয়া ইতিহাসানদের কল্পনার দৌড় আর কত দূর হতে পারে!

এরশাদ রসায়নের ছাত্র ছিলেন; রংপুরের লোক হওয়ায় তার রঙ-এর অন্ত ছিলো না। 'নিজের টুকু বুঝে নেয়া' এই সাতে পাঁচে দাদা; পোশাকে, অভিনয়ে; বাতাবি লেবু টিভির 'তোমাদের পাশে এসে বিপদের বাঁশি হতে আজকের চেষ্টা অপার' গানের সঙ্গে লিপসিং করে; রাজনীতির ব্লকব্লাস্টার এমন এক মুভি বানিয়েছেন যে; পরবর্তীতে জনগণকে ভালোবাসার যত অভিনয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা করেছেন; তার সবই এরশাদের কপিপেস্ট। পরিবর্তন ঘটে শুধু 'প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ' আর 'জয় বাংলা বাংলার জয়' আবহসংগীতে। বাকি সবই এরশাদময়।

এরশাদের মনোজগত গড়ে উঠেছে 'প্রণব মুখার্জি' আর 'ইয়াহিয়া খান' নামের দুটি ঐতিহাসিক চরিত্রের মিশেলে। ইয়াহিয়া খান যেভাবে রাষ্ট্রপতি ভবনকে প্রজাপতি ভবনে রূপান্তর করেছিলেন; এরশাদও ঠিক সেইভাবে বঙ্গভবনকে রঙ্গভবনে রূপান্তর করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডি হিলারী ক্লিনটন তার স্বামী বিল ক্লিনটনকে নারী-কেলেংকারীর কারণে ক্ষমা করার অনেক আগেই রওশন এরশাদ তার স্বামী এরশাদকে ক্ষমা করেছিলেন। একটা অভিজ্ঞতার পর ক্লিনটন থেমে গেলেও; এরশাদ থামেননি; তিনি রাজশাহীতে গিয়ে বিদিশার নেশায় শ্রাবস্তীর কারুকার্যে পড়ে যান। প্রথম দেখায় বিদিশা সাংঘাতিক ভিত্তোরিয়া ওকাম্পোর প্রীতি নিয়ে এলেও; পরে যথারীতি প্রতিশোধ গ্রন্থ লিখে তবে শান্ত হয়েছেন। অথচ মনিকা লিভনিস্কি আজ টেড টকে এসে অল্প বয়েসে ক্লিনটনের প্রেমে পড়ার জন্য নিজেকে দায়ী করে স্ক্যান্ডাল জয় করে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দেখান। প্রতীচ্যের নারীর এই আত্মসম্মানবোধ নারীবাদের স্বকীয় সংজ্ঞা তুলে ধরে যেন।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বা লিটনের ফ্ল্যাটে আলুথালু হওয়া প্রেম যাজক ইতিহাসানেরা; এরশাদের চরিত্রিক ত্রুটির সমালোচনা করে বুড়া হইলো সখিনার কারণে। আজো তাই ইতিহাসের রিক্সা চালাচ্ছে ঢাকা শহরে। আমৃকা গিয়ে সখিনারা ভুলে গেছে প্রেমযাজকদের। অথচ এরশাদের প্রেমিকারা তাকে ভোলেনি কখনো; কী দিশায় কী বিদিশায় ঠিকই তারা স্মরণ করতে পারে, কবিতার পড়ার প্রহরগুলো রাতের আনমনে।

এরশাদ ১৯৮৩ সালে যে সমসাময়িক চিন্তার শিক্ষানীতির প্রবর্তন করেন; সেটাই ইউরোপের কল্যাণরাষ্ট্রের শিক্ষানীতি; অযথা বিসিএস শোবিজ তারকা তৈরির অপ্রয়োজনীয় ডিগ্রি সংগ্রহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত বেকার তৈরি না করে; প্রায়োগিক শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন এই সামরিক শাসক। এস এস সি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিখে আসা ছাত্ররা এরপর তাদের শখ ও সক্ষমতা অনুযায়ী, কলা-বিজ্ঞান-বানিজ্য-কারগরী শিক্ষাধারায় চলে যাবে; এমন ছিলো সে শিক্ষানীতি। এমনটা হলে এতো শার্ট প্যান্ট পরা বেকার, রাজনৈতিক দলের ফুটসোলজার, বিদেশে অদক্ষ দাস রপ্তানী, সেলফি সাফল্যের জোকার সাহেদ-সাবরিনা তৈরি হতো না এ সমাজে।

এরশাদ সেনাবাহিনীর লোক; বিএনপির বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারকে শুধু জেনারেলের ডান্ডা দেখিয়ে ক্ষমতা দখলটাই তার বে-আইনি হয়েছিলো; এরপর শের-ই-বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, জনতার জিয়ার মাজার জিয়ারত করে 'অবৈধ দখল"-কে বৈধতা দিতে চেষ্টা করেন তিনি। সেই থেকে রাজনীতির মাজারে গিয়ে অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দেবার প্রথাটির চল হয়।

প্রণব মুখার্জি যেমন সারাজীবন অসাম্প্রদায়িকতার চর্চায় থাকলেও; পরে শিব সেনার রাজনৈতিক মন্দিরে গিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদলেন; এরশাদ ঐ কান্না অনেক আগে কেঁদেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন অমুক মসজিদে যেতে হবে। 'ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম' করা এরশাদের জীবনের হুব্রিস-হামারশিয়া বা সেই ভুল; যা তার রাজনৈতিক চরিত্রটিকে অত্যন্ত নেতিবাচক করেছে। ইতিহাসান ভাইদের মতোই অত্যাচারী যে ঈমান হোসেন ভাইয়েরা ফেসবুকে এসে ঈমান পরীক্ষা করে নাশতেক-কাফের তকমা দেয়ার সাহস পেয়েছে; লেখকের গলায় চাপাতি চালানোর ভীতিপ্রদ জনপদ তৈরি হয়েছে; তা এরশাদের 'রাষ্ট্রধর্ম' হুব্রিসের ফলাফল।

এরশাদ দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ভিত্তোরিয়া- ওকাম্পোর অসমবয়েসি প্রেমগাথা নিয়ে আলু থালু খঞ্জনি রায় এরশাদ-বিদিশা প্রেমগাথা নিয়ে কলতলায় কাসুন্দির মাতম তুলেছে; তাই উনি সেই 'সামন্ত-হিন্দু মানসের' সুপিরিয়রিটির চর্চাটিকে অপছন্দ করেছেন। "নিজে করলে ঠিক আছে; মুছুম্মান করলে ঠিক নাই"; কলতলায় পিতলের ঘড়া নিয়ে বারান্দা থেকে নেবে আসা রায় বাবুকে দেখে মুসলমান-দলিতের 'সরে যা সরে যা ছুঁসনি বাবুর সঙ্গে যেন ছোয়াচ না লাগে"; এই বর্ণ-শ্রেণী বৈষম্য চর্চার ভ্যাড়ভেড়ে গ্রাম থেকে এরশাদ মুক্তি চেয়েছেন। কিন্তু এটা এরশাদের ভুল ছিলো। সব পরিবর্তনের চেষ্টা নিজের হাতে তুলে নিতে নেই। সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয় কিছু কিছু পরিবর্তনকে।

আজকের পৃথিবীতে যে নবীন কিশোরের আগমন ঘটেছে; তারা ধর্ম-বর্ণ বৈষম্যের সঙ্গে নিজেদের রিলেট করতে পারেনা। এই আমরাই জীবনে কখনো রিলেট করতে পারিনি, ধনী-গরীব পার্থক্যের কারণে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদার কম বেশি হবার ব্যাপারটা। হিন্দুদের কাস্ট প্রথাটা; মুসলমান সমাজের ধনী-গরীব বৈষম্য প্রথাটা; এগুলো আসলে অচল ও বাতিল চিন্তা। তাই রাষ্ট্রধর্ম একটা বাতিল কবচ। ওটা এরশাদ প্রজন্মের চিন্তা। এ প্রজন্মে তা অপ্রয়োজনীয়। ফেসবুকে ইমান হোসেন ভাইকে যেমন আর দেখতেই ইচ্ছা করে না আজকাল। যদি তুমি নির্মল বন্ধুত্বে আসো; তবে তুমি বেশ; যদি তুমি ঈমান পরীক্ষা করতে আসো; তবে তুমি শেষ। মানে আনফ্রেন্ড।

এরশাদ একটি স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করেছিলেন। এরশাদের অনুরোধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরী রোগীবান্ধব এই নীতি প্রণয়ন করেছিলেন সে সময়; যেখানে ডাক্তারের প্রাইভেট প্র্যাকটিস কমানো যাবে; সরকারি হাসপাতালে তার বেশি সময় নিশ্চিত করা যাবে। এটাও কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতির অনুরূপ।

এরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন। উনি তাই প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি পছন্দ করেননি; যা পড়ার টেবিল থেকে ছাত্রকে হাতুড়ি ও জুয়ার আসরে নিয়ে যায়। তাই তিনি তার ছাত্র সংগঠন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

ক্ষমতার চর দখলের লড়াইয়ে তখন শুধু খালেদা আর হাসিনার ছাত্র ফুট সোলজারেরা। ফলে এরশাদকে ফেলে দিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের "সি-স" গণতন্ত্র আনতে কোন অসুবিধা হয়নি। যে স্বপ্নবান তরুণেরা দেশে গণতন্ত্র ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে নব্বুইয়ের গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন; সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়; যখন এরশাদের বিপদের বাঁশী ভবনের চেয়ে ভয়ংকর হাওয়া ভবন আর চেতনা ভবনের স্বৈরাচার দেশটিকে ঠগীদের করদ রাজ্যে পরিণত করে। নব্বুই-এর দেশপ্রেমিক তরুণদের মূল্যায়ন হয়নি। কেউ কেউ হাওয়া ভবন আর চেতনা ভবনের স্বৈরাচারী ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিয়ে বেশ নধর-গোলগাল হয়েছেন। যুগে যুগে পাশাপাশি বিশুদ্ধ ও শংকর বিপ্লবী আমরা দেখেছি। এটাই হয়; কেউ দেশের মানুষের মুক্তির যুদ্ধ সারাজীবন করে; কেউ কেউ একবার যুদ্ধে গিয়ে ফিরে এসে সুফল কুড়ায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ঠোঙ্গায়।

এরশাদের মূল্যায়নে তার ইহজাগতিক সাফল্যই যথেষ্ট। রংপুরে তার পাঁচটি আসনে কারাগারে থেকেও তিনি বিজয়ী হয়েছেন। ফলে ঢাকা শহরের কয়েক হাজার লোক এরশাদকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে; নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের নিষ্ঠুর ভবনগুলো নির্মাণ করলেও; গ্রামীণ জনপদের মানুষ তার গ্রামোন্নয়নের প্রচেষ্টাগুলোর মূল্যায়ন করেছে। রাজনীতিতে তিনি যখন কিং ছিলেন না; তখনও কিং মেকার ছিলেন।

নব্বই-এর গণ-আন্দোলনে যারা মারা গেছেন; ইতিহাসান ভাইয়েরা যাদের ছবি দিয়ে জাতির বিবেক জাগাতে চেষ্টা করেন; এটা ঐ একই ব্যাপার; স্বজনের মৃত্যুর কথা বলে; দেশের ক্ষমতা, চাকরির কোটা দখলের শঠতা। শুধু যার যায় সে জানে, নূর হোসেনের মা, ডা মিলনের মা জানেন কেবল সন্তান হারানোর বেদনা কেমন হয়। বাকি সবাই বেদনার ব্যবসায়ী।

এরশাদ নায়কও নন, খলনায়কও নন; দেবতাও নন, অপদেবতাও নন। তিনি রসায়নের ছাত্র; বেশ করে শিখিয়ে গেছেন রঙ্গভবনের থিয়েটারে রাজনীতির অভিনয়; প্রতিদিন একটি চশমার ফ্রেম পরিবর্তন; সেলফি তোলা; ক্ষমতা দখল করে ফুট সোলজারদের জীবন 'রাঙ্গা' করে তোলা; ডাকসাইটে সব নেতার রাজনৈতিক আদর্শের নিকুচি করে 'মন্ত্রী হবার লোভে ছুটে আসা', 'তেলের বিনিময়ে পদ-পদবী-পদকের আসর', শিল্প-সাহিত্যের 'পিঠ চুলকানোর ভাঁড়ঘর উত্তোলন' এসবই এরশাদ শুরু করে গেছেন। আজ সে কৌতুক বৃক্ষ ফুলে-ফলে ভারী হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে যেন। 'চোরের খনি আর চাটার দল' থিয়েটারের শৈল্পিক রূপ এরশাদ; যে থিয়েটার আরো অনেক বেশি নৃশংস হয়ে উঠেছে ঝাঁসির রাণীদের কালে।

১১৩০ পঠিত ... ১৯:২৯, জুলাই ১৪, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top