কোপার্নিকাসের যুগে ফেসবুক থাকলে যেভাবে পৃথিবীর চারপাশেই সূর্য ঘুরতো

১২৪০ পঠিত ... ২৩:০০, জুলাই ০৬, ২০২০

 

বিজ্ঞানী এরিস্টটলের মনে করতেন যে, যেহেতু একটা বল উপড়ে ছুড়ে মারলে সেটা আগে বা পিছনে না পড়ে যেখানে মারা হয়েছে সেখানেই পড়ে তার মানে পৃথিবী স্থির আছে, সূর্য সহ অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। উনার সময়টা ছিলো খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩৫০ বছর আছে। মানে কয়েক হাজার বছর আগে। উনার আগে টলেমিও এই ধারণা পোষণ করতেন। এরিস্টটল এতটাই প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ছিলেন যে, উনার কথা হাজার বছর ধরে বেদবাক্যের মত মানা হয়েছে।

প্রায় দুই হাজার বছর পরে আনুমানিক ১৫১৫ সালের দিকে পোলিশ প্রিস্ট কোপার্নিকাস উল্টা কথা বলেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। তখন দুইটা সমস্যা ছিলো। এক হচ্ছে চার্চ এই কথা মানবে না, ঝুলিয়ে দিতে পারে। দুই, যথেষ্ট প্রমাণ এবং ব্যাখ্যা দাঁড় করানো। অনেক বিজ্ঞানী বলেছেন যে উনি দুই নাম্বারটা নিয়ে কনসার্ন ছিলেন বেশি। এই থিওরি পাবলিশ করা হয় না। ১৫৪২ সালে পোপ পল ৩ এর নির্দেশে দ্য হোলি অফিস নামে একটা রোমান ব্রাঞ্চ করা হয় যাদের কাজ হবে নাস্তিক, ডাইনি খুঁজে বের করে টাইট দেয়া। এছাড়া ৫৭ ধারা নামে একটা নতুন আইন করা হয় যে আইন ব্যবহার করে কেউ ফেসবুকে কারো অনুভূতিতে আঘাত করলে তাকেও টাইট করে দেয়া হবে। এরই মধ্যে ১৫৪৩ সালে প্রথম এই মতবাদ পাবলিশ করেন (On the Revolution of Heavenly Spheres) এবং কিছুদিন পরেই মারা যান। ফেসবুকীয় জনতা তখন বলতে শুরু করে, চার্চের বিরুদ্ধে কথা বলাতেই মারা গেছে। এমনি হবে উপরঅলার বিচার। এর কথা যারা সমর্থন করে তারা নাস্তিক। তারা বিড়াল কুকুরেরও অধম। তাদের বাঁচা মরায় কিছু আসে যায় না। 'পৃথিবী নয়, সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।'

কোপার্নিকাসের অনেক ফলোয়ার এই থিওরিকে সমর্থন দেয় এবং জনতা তাদের চার্চবিরোধী ক্রিশ্চিয়ানিটির শত্রু বলে আখ্যা দেয়। কয়েকজনের নামে ৫৭ ধারায় কেইস হয়, তারা টাইট খায়। কয়েকজনকে মেরে ফেলা হয়। ফেসবুকে 'কোপার্নিকাসের ভক্ত, কোপ খাবে শক্ত' নামে পেইজ খুলে 'পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে না' এই কথা যারা বলবে তাদের নাস্তিক ঘোষণা দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। কয়েকজন তখন বলার চেষ্টা করে যে, 'কথা বলার জন্য আপনারা কাউকে মারতে পারেন না। এটা বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট, ন্যাচারাল একটা ব্যাপার।' তখন তাদেরকেও নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে দেয়া হয়। কয়েকজনকে টাইট দেয়া হয়। অনেকে টাইটের চোটে জান বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। তখন জনতা রসিয়ে রসিয়ে বলা শুরু করে, 'এরা বিদেশের সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্যই এইসব চার্চবিরোধী কথা বলে। আমাদের চার্চ শান্তির কথা বলে। কাউকে কুপাকুপি করা কখনোই ছাপুট করে না।'

এর কিছুদিন পরে ১৫৪৮ সালে ফিলিপ্পো নামে এক ছেলে ইতালির নোলা নামক এক স্থানে জন্ম নেয়, যে পরবর্তীতে পরিচিত হয় 'জর্দানো ব্রুনো' নামে। ব্রুনো নোলা থেকে ১৫৬৫ সালে ন্যাপলসে চলে আসে এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চ স্যান ডমিনিকো ম্যাজোরের কনভেন্টে ভর্তি হয়। এই কনভেন্টের কাজ মূলত ধর্মীয় জীবন যাপন করা। গেইম অফ থ্রন্সে যে হাই স্প্যারো থাকে, তার গ্রুপের মত আর কি। কেউ কিছু করলে তাকে রাস্তায় সবার সামনে নেংটুপুটু করে শেইম শেইম আর ওম শান্তি ওম শান্তি করে। এই চার্চ ছিলো স্প্যানিশ শাসকদের বিরুদ্ধে পলিটিক্যাল মুভমেন্টের কেন্দ্র। সেখানে আসার পরে ব্রুনো থিওলজি এবং রাজনীতির লিঙ্ক খোঁজা নিয়ে পড়াশোনা এবং গবেষণা করতে থাকে। রাজনীতির জন্য ধর্মের অপব্যবহার যেহেতু অনেকের বিজনেসে ঝামেলা করে তাই একদল লোক ফেসবুকে প্রচার করা শুরু করে যে ব্রুনো ক্রিশ্চিয়ানিটি-বিদ্বেষী। এরই মধ্যে ব্রুনো রেপুটেশন গেইন করে তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তির জন্য। তাকে এই স্মৃতিশক্তির কারিশমা দেখানোর জন্য পোপ পায়াস ফাইভ এর কাছে পাঠানো হয়। ১৫৭১ এ ব্রুনো ডেকন পদ পায়। এইটা প্রিস্টের এক পোস্ট নীচের পোস্ট। পরের বছর ব্রুনো বিখ্যাত কলেজ অফ স্যান ডমিনিকোতে থিওলজির ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন যাতে আরও ফর্মালি পড়তে পারেন। চার বছর পরে ব্রুনো থিওলজির ডিগ্রি লাভ করেন। এরই মধ্যে ব্রুনোর কিছু ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে তাকে লোকজন নাস্তিক বলে টাইট দেয়ার আহবান জানায়। তখন জর্দানো ব্রুনো ন্যাপলস ছেড়ে রোমের 'সান্তা মারিয়া সোপ্রা মিনার্ভা' এর কনভেন্টে চলে যান। সেখানেও টিকতে না পেরে এইবার জর্দানো ব্রুনো নিজেকে ফিলিপ্পো ব্রুনো পরিচয় দিয়ে জেনোয়া চলে যায়। সেখানে কয়েক মাস থাকার পরে সে আশ্রয় নেয় নোলি নামের একটা ছোট্ট গ্রামে যেখানে সে বাচ্চাদের গ্রামার পড়াতো। ১৫৭৭ এ ব্রুনো চলে যায় ভেনিসে এবং সেখানে The Signs of the Times নামে একটা বুকলেট পাবলিশ করে। এরই মধ্যে সে ক্রিশ্চিয়ানিটির প্রোটেস্টেন্টিজম শাখায় কনভার্টেড হয়। ১৫৭৯ সালে সে ইউনিভার্সিটি অফ জেনেভাতে স্যাক্রেড থিওলজির প্রফেসর হিসাবে যোগদান করে 'ফিলিপাস ব্রুনাস নোলানাস' নামে। সেখানে ফিলসফির এক প্রফেসরের একটা গবেষণার সমালোচনা করে একটা পেপার পাবলিশ করায় ব্রুনোর নামে ৫৭ ধারায় প্রফেসরের অনুভূতিতে আঘাত করার মামলা হয় এবং তাকে দুই সপ্তাহ জেল খাটতে হয়। ব্রুনো এর পরে এখানে সেখান হয়ে ফ্রান্সে চলে যায় এবং ইউনিভার্সিটি অফ টুলুজে লেকচারার হিসাবে কাজ করে। এর পরে ব্রুনো প্যারিসে চলে যায়। এর মধ্যে ব্রুনো বই লেখে, নাটক লেখে। সেখানে ব্রুনোর দর্শন, আইডিয়া অনেকের অনুভূতিতে আঘাত করে। ১৫৯২ সাল পর্যন্ত ব্রূনো অনেক লেখালেখি করে এবং তার মতামত অনেকের অনুভূতিকে ছিঁড়েখুঁড়ে লাল করে দেয়। এর মধ্যে একটা বড় অংশ ছিলো কোপার্নিকাসের থিওরিকে সাপোর্ট করা এবং পাবলিকলি বলা যে 'পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে'। তার বিরুদ্ধে কতিপয় জনতা ক্ষেপে উঠে, তাকে নাস্তিক, ক্রিশ্চিয়ানবিদ্বেষী ট্যাগ দিয়ে টাইট করার আহবান আসে ফেসবুকে।
অনেকে তার সাথে তর্ক করে বলে যে এইটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। অনেকে তার কথা বলার ধরণ, পোশাক-আষাক, শারীরিক গঠন নিয়ে ফেসবুকে ট্রল, মিম বানিয়ে তাকে এবং তার আইডিয়াকে হাসির পাত্র বানানোর চেষ্টা করে। এই জনতার মধ্যে বড় অংশ এস্ট্রোনমি, থিওলজি ঠিকমত বানানও করতে পারতো না।
ব্রুনোর নামে ছড়ানো হলো যে, সে যেহেতু 'সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরা সাপোর্ট করে' তার মানে 'সে দেশের সরকারকে সাপোর্ট করেনা, সে চার্চফোব, তাকে হত্যা করতে হবে'।

অনেকে ফেসবুকে বলার চেষ্টা করলো যে, মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করা উচিত না। কথা বলার জন্য কাউকে মারা উচিত না। তখন ফেসবুকের একটা বড় ইউজারবেজ তাদেরকে বললো, 'আপনি কি ক্রিশ্চিয়ান? তাহলে আপনি কিভাবে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরা সাপোর্ট করেন?' এবং তাদেরকেও সরকারবিদ্বেষী, চার্চবিদ্বেষী বলে ট্যাগানো হলো। বেশিরভাগ মানুষ এতে ভয়ে চুপ করে গেলো। কে যাবে এইসব গাধার সাথে তর্ক করে নিজের জানের রিস্ক নিতে?

তখন সেই ইউজারবেজ বললো, 'তর্কে পারে নাই মিথ্যা বইলা, তাই তারা চুপ হয়ে গেছে, আমরা কিন্তু মারামারি সাপোর্ট করি না, আমরা শান্তিকামী জনতা।' এরই মধ্যে কয়েকজনকে মেরে ফেলা হলো। একেকজনকে মারার পরে সেই ইউজারবেজ বললো, 'ঠিক আছে মেরে ফেলাটা ঠিক হয় নাই, তাই বলে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে- এইটা বলাও তার উচিত হয় নাই।'

তখন শহরের কয়েকটা ড্রেন থেকে প্যারাসিট্যামল মজিদ, নাস্তিকদের দাঁতভাঙ্গা জবাব ইত্যাদি নামের অনেক বই বের হলো। সেখান থেকে লেখাপড়া করে তারা যুক্তি দেয়া শুরু করলো, 'এইটা বলা যদি তার বাকস্বাধীনতা হয়, তাহলে খুন করাও খুনির স্বাধীনতা, আপনার মাকে ধর্ষণ করাও আমার স্বাধীনতা। আপনি দেখেন, এন্টার্কটিকার শ্বেত ভাল্লুক পর্যন্ত আমাদের সাথে আছে। তার মানে আমরা শান্তির পক্ষের লুক। আরে পৃথিবী যদি ঘুরতোই তাহলে কি আপনার বাপ-মা একসাথে থাকতে পারতো? আপনার জন্ম হইতো? এইবার বলেন এইটা প্রকৃতি সাপোর্ট করে কিনা?' অজ্ঞানযাত্রা নামক একটা ফেসবুক পেজ থেকে এইসব যুক্তিকে ব্রেক করা হইলে তাদেরকেও নাস্তিক ট্যাগ দেয়া হয়। মোটকথা, একটা মব ক্রিয়েট হয় যারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে 'চার্চের কথামত কেউ না চললে তাকে মেরে ফেলা কোন ভুল কাজ না।'

এইভাবে বছরের পর বছর তর্কাতর্কি খুনাখুনি চলতে থাকলো। কারো কথা পছন্দ না হলেই তাকে নাস্তিক, চার্চবিদ্বেষী ট্যাগ দিয়ে দেয়া হত, অথবা তাকে কেউ মেরে ফেলত। আর সেই ইউজারবেজ বলতো, 'খুনাখুনি ছাপুট করি না, কিন্তু তারা তো চার্চবিদ্বেষী নাস্তিক।' আস্তে আস্তে ঘটনা মজার টার্ন নিলো।
একসময় দেখা গেলো যে কারো নাম ব দিয়ে শুরু হইলেই তাকে ব্রুনোর সমর্থক বলে মারা হইলো। এই প্রক্রিয়ায় সেই বড় ইউজারবেজের অনেকেই মারা পড়লো। মরার আগ পর্যন্ত তারা বলতেছিলো, 'আমাকে মারবেন না। আমি সরকারের, চার্চের সমর্থক।' কিন্তু দেখা গেলো আরেকপক্ষ কোন না কোন যুক্তি দিয়ে তাদেরকে চার্চের বিপক্ষ বানিয়ে দিতো। আর সেই বড় ইউজারবেইজ বলতো, 'ব দিয়ে নাম রাখাটা প্রকৃতি সাপোর্ট করেনা, চার্চের বিরোধী হয়।' এভাবে তুচ্ছ কারণে অনেকে প্রাণ হারালো।

এইরকম আরও কিছু অদ্ভুত কারণ ছিলো। যেমন গরু খাওয়া, মাথার চুল বড় রাখা, শার্টের বোতাম একটা কম লাগানো, ছেলেদের ক্লাস ফাইভের পরে পড়াশোনা করা। দেখা গেলো যে, যারা খালি বলতো যে 'খুনাখুনি ছাপুট করি না, কিন্তু চার্চ নিয়ে কথা বলা ঠিক না। চার্চ আমার বাপের সম্পত্তি'- তারাও একে একে বিভিন্ন কারণে চার্চবিরোধী ট্যাগ খেতে লাগলো। তারা ফেসবুক লাইভে এসে বলা শুরু করলো, 'আমি চার্চের লোক, আমাকে বাঁচতে দেন।' সেখানে ইউজারবেজ এসে কমেন্ট করতো, 'আপনি কি এক শার্টে ৭ বোতাম লাগানো সমর্থন করেন? আপনি কি গরু খাওয়া সমর্থন করেন না? আপনি কি মেসিকে রোনালদোর চেয়ে সেরা প্লেয়ার মনে করেন? আপনি কি গর ঝাড়ু দিয়ে না কুড়িয়ে ইহুদীদের বানানো ভ্যাকুয়াম দিয়ে পরিষ্কার করেন? আপনি কি হাগু করে বদনা ইউজ না করে হ্যান্ড শাওয়ার ইউজ করেন?'- 'তাইলে আপনি চার্চের লোক না, আপনি নাস্তিক। আপনি প্রকৃতিবিরুদ্ধ কথা বলছেন। ১০২ পারসেন্ট চার্চওলার দেশে আপনি এত সাহস পান কিভাবে?' কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে ইংরেজিতে লেখতো, 'toe nastek, toka hottaa karta hoba' তারপরে তাদেরকে এসে কেউ মেরে দিয়ে যেতো।

ইতোমধ্যে ১৫৯১ সালে জিয়োভানি মসেনিগো নামের একজন ব্রুনোর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে ব্রুনোকে ভেনিসে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালো। একসময় ব্রুনোর অনেক কথাবার্তা মসেনিগোর কাছে চার্চবিরোধী মনে হওয়ায় সে তার বাবার সাথে পরামর্শ করলো পুলিশের হাতে ৫৭ ধারায় টাইট দিয়ে দেবে ব্রুনোকে। টাইট বলতে ব্রুনোকে খালি বলতে হবে সে যা বলছে এগুলি বিদেশীদের ষড়যন্ত্র, সে ভুল বলেছে, তাকে দেশের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে ৫০ টাকার দলিলে লিখে দিয়ে আসতে হবে যে সে ধার্মিক, সে চার্চ মানে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে না বরং সৌরজগতের সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ব্রুনো যখন ১৫৯২ সালে জার্মানি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন ফাইনালি মসেনিগো গুটিবাজী করে তাকে পুলিশের কাছে ৫৭ ধারায় ধরিয়ে দেয়। এরপর পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে মাইর দিয়ে জাহাজে করে রোমের জেলে পাঠিয়ে দেয়, যেটা আসলে মসেনিগোর টাইট দেয়ার প্ল্যানে ছিলো না। রোমে ব্রুনো সাত বছর জেল খাটে। এর মধ্যে ব্রুনোর নামে ২৯টা অভিযোগ দায়ের হয় চার্চবিরোধী কর্মকান্ডের। ১৫৯৭ সালে ব্রুনোর সব বই সেন্সর করা হয়। তখনো অনেকে ফেসবুকে ব্রুনোর সাপোর্টে কথা বলায় তাদের হুমকি, নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে টাইট দেয়া হয়।

ব্রুনোর অনেক সমর্থক এর মধ্যে ফেসবুকে 'ব্রুনো ভাই ক্রিশ্চিয়ান, উনি রীতিমত কনভেন্ট থেকে পড়াশোনা করা প্রিস্ট। উনাকে বাঁচতে দিন।' এসব লিখে পোস্ট দেয়। এমনকি কিছু কিছু আপ্পিরা এসে বলে, 'ব্রুনো ভাই অনেক কিউট, উনার হাসি অনেক সুন্দর। উনি তো কিছু বলেনাই। কোপার্নিকাসই তো আগে বলেছে যে পৃথিবীর চারপাশে সুর্য ঘোরে না। এই দেখেন চার্চের সামনে কিউট ব্রুনো ভাইয়ের ছবি, পোপের সাথে ব্রুনো ভাইয়ের ছবি। উনাকে মারবেন না। বাকি কেউ নাস্তিক হইলে তাকে মারেন প্লিজ।' তখন কিছু গাধা ছিলো যারা মানুষের মত ফেসবুক চালাতে পারতো। কিন্তু আশেপাশে কি হচ্ছে এরা জানতো না, বুঝতো না। এরা কমেন্ট করতো 'দেশের সবাই কি এমন খারাপ বলেন? এইরকম উগ্র মানুষ বেশি হলে কোটিতে একটা। এদের কথা হুমকি এত পাত্তা দেয়ার কি আছে? এগুলি করে আপনারা এদেরকে লাই দিচ্ছেন।' মানে অনেকটা এমন, আমি দেখি নাই তার মানে হয় নাই এমন কিছু।

অবশেষে ১৬০০ সালের ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ জর্দানো ব্রুনোকে উলঙ্গ করে হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো। সে সময় অনেকেই আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে স্টোরি দিল, কেউ কেউ লাইভে গেলো।

এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানালে তখনো সেই ইউজারবেসের লোকজন ফেসবুকে প্রচার করে যায়, 'মেরে ফেলা ছাপুট করি না, কিন্তু চার্চ নিয়ে কথা বলা কি ছাপুট করা যায় বলেন? তবে পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে এইটা যারা মানবে না তাদের মেরে ফেললে প্রতিবাদ করা উচিৎ না, তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে করা বলে, চার্চের বিরুদ্ধে কথা বলে।'

দশ বছরে পরে আরেক বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এক মস্ত টেলিস্কোপ বানিয়ে আকাশের দিকে তাকান এবং এভিডেন্স দেখান যে, পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এমনকি অনেক গ্রহের উপগ্রহও আছে যারা সেই গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘোরে, পৃথিবীকে নয়। কিন্তু ঐ যে লোকজন! তারা আবার হাজির। 'পৃথিবী ঘুরতেই পারে না। এইটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। পৃথিবী ঘুরলে আপনার বাপ-মা এক বিছানায় থাকতে পারতো? আপনার জন্ম হইতো? অনেক আগে এইরকম বেফাঁস কথা বলায় ভূত নামক এক জাতির সবাই ডায়রিয়াতে ভুগে বাথরুমে ঘুরতে ঘুরতে মারা গেছে। তাই এইরাম কথা বললে আপনারেও মাইরা দেয়া খারাপ কিছু না।'

তখন অনেকে বললো, 'এইযে আপনারা যে ঘুষ খান, চুরি করেন, এইসব করাতে তো ফজলি আর হাড়িভাঙ্গা জাতিও করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে? আপনাদের কি তাইলে মেরে ফেলা উচিত না?" তখন জবাব আসতো 'toe nastek. amerekar ped azent'.

গ্যালিলিওকেও এক পর্যায়ে গৃহবন্দী করে ফেলা হলো বিজ্ঞানের মতবাদ প্রকাশ করার দায়। এভাবেই তিনি মারা যান।

প্রায় ৪০০ বছর পরে।

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে এইটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এর মধ্যে মানুষ চাঁদে গিয়েছে, মঙ্গলে রোবট পাঠিয়েছে। কিন্তু সেই ফেসবুক ইউজারবেজ পরিবর্তন হয়নি।

২০০০ সালে পোপ জন পল এক চিঠিতে তখনকার সেই ইউজারদেরকে ট্রল করে এক চিঠিতে অনুশোচনা করে লিখেন, 'ব্রুনোকে এভাবে মারা ঠিক হয় নাই। আমি এবং চার্চ খুবই দুঃখিত। কিন্তু তবুও ব্রুনোর বিরুদ্ধে আনিত চার্জ অফিশিয়ালি খালাস করা যাবে না।'

কিন্তু বেহায়া পৃথিবী তবুও এখনো সূর্যের চারপাশে ঘোরা বন্ধ করে নাই। ছিঃ!

লেখা: সুদীপ্ত কর

১২৪০ পঠিত ... ২৩:০০, জুলাই ০৬, ২০২০

আরও

 
 

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top