তাবাসসুম কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে অনার্স শেষ করলো। IELTS এ ৮.৫ স্কোর নিয়ে অক্সফোর্ডে অ্যাপ্লাই করার কিছুদিন পরই ডাক আসলো। এবার যাওয়ার পালা।
প্রথমেই যিনি ইনিয়ে বিনিয়ে সমস্যার কথা বললেন, তিনি হচ্ছেন তাবাসসুমের বাবা।
'শেখ মুজিবের যখন বিয়ে হয় উনার বয়স ছিলো বারো বছর। আর স্ত্রী রেণুর বয়স তিন বছর।'
'তাই নাকি আব্বা! জানতাম না তো।'
'আবার যদি ফিজিক্সের কথাই বলো, তাহলে পিয়েরে কুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কখনো বিয়ে, ভালোবাসা এসবের মধ্যেই যাবেন না। এগুলোকে তিনি ধরতেন ডিসট্র্যাকশন হিসেবে। অথচ মাদাম কুরি তাঁর এই ধারণা বদলে দিয়ে তৈরি করলেন যুগান্তকারী ইতিহাস। স্বামী স্ত্রী একসাথে নোবেল পেলেন।'
'জ্বি আব্বা শুনেছি এইটা।'
'আমি আর তোমার মা চাচ্ছি অক্সফোর্ডে যাওয়ার আগে তুমি বিয়ে করে স্বামীসহ যাও। তাছাড়া একা গেলে কোনো অভিভাবকও থাকবে না, আমাদেরও নানান চিন্তা।'
'জ্বি আব্বা অবশ্যই।'
তাবাসসুম আব্বা-আম্মার পছন্দের পাত্রের অপেক্ষায় আছে। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য পাত্র পাওয়া গেলো। খুবই ধার্মিক ছেলে, সবসময় টুপি পাঞ্জাবি পরে, ধর্মের সুন্নত ও মেনে চলার চেষ্টা করে।
তাবাসসুম খুশিমনে বিয়ে করলো। এরপর স্বামীর হাত ধরে অক্সফোর্ডে যাবার পালা।
পাসপোর্ট হাতে আসার দিন তাবাসসুমের শ্বাশুড়ি বললেন, 'মেয়ে মানুষের আসল পরীক্ষা হইলো স্বামীর সেবা ও সন্তান পালন। বেশি শিক্ষিত হইলে স্ত্রীরা স্বামীকে মানতে চায় না। অথচ স্বামীর এখতিয়ারে চলতে না পারলে বিবাহ করার কী দরকার?'
তাবাসসুমের মনে হলো, আসলেই তো সত্যি কথা! স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। কিসের অক্সফোর্ড কিসের কি! তাবাসসুম সবকিছু ক্যান্সেল করে সংসারে মন দিলো।
বিয়ের এগারো মাস পর কোল জুড়ে একটা মেয়ে সন্তান আসলো। যদিও এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান ছিলো না।
শ্বশুর মহাশয় বললেন, 'মরার আগে দাদুভাইকে দেখে যাইতে পারতাম যদি! আহা!'
ব্যস, যেই কথা সেই কাজ।
পরের তিন বছরে আরও দুই সন্তান আসলো ঘরজুড়ে। সব কাজ তাবাসসুমের একাই করতে হয়। তিন বাচ্চার দেখাশোনা, সংসারে রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, সবই।
শিং মাছ কুটতে কুটতে মাঝেমাঝে তাবাসসুমের অক্সফোর্ডের কথা মনে পড়ে। তখন সে দৌড়ে গিয়ে স্বামীর পায়ে চুমু খায়। এইতো অক্সফোর্ড! জীবনের সব না পাওয়া কেটে যায় নিমিষেই ।
তাবাসসুমের স্বামী নাহিদ উল্লাহ তখন ফেসবুকে চ্যাট করতে করতে হাসছিলো। তাবাসসুম ভাবলো খেদমতে সন্তুষ্টির হাসি। খুশিতে মন ভরে গেলো তাবাসসুমের। এইতো জীবনের প্রাপ্তি!
একদিন তাবাসসুমকে তার শাশুড়ি সকাল সকাল ছাদে ডাকলেন।
'তোমাকে একটা কথা বলা দরকার বউমা।'
'জ্বি মা বলেন।'
'তুমি তো আসলে তিন বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকো। নাহিদের তেমন যত্ন নিতে পারো না। শরীরটা ভেঙে গেলো আমার ছেলেটার।'
তাবাসসুমের মনে অপরাধবোধ কাজ করলো। মন খারাপ করে বললো, 'জ্বি মা ঠিক কথাই বলছেন।'
'আমি আর তোমার শ্বশুর ঠিক করেছি, নাহিদকে আরও তিনটা বিয়ে দিবো। পাত্রীও আলহামদুলিল্লাহ ঠিক করা শেষ। তাহলে আর সেবা যত্নের অভাব হবে না। তাছাড়া ইসলামেও চার বিয়ে সুন্নত ছেলেদের।'
খুশিতে তাবাসসুমের চোখে পানি চলে আসলো। এতদিন সেবা যত্ন থেকে বঞ্চিত করেছে স্বামীকে, এখন তা পূরণ হতে যাচ্ছে। স্বামীর খুশি ছাড়া একজন স্ত্রীর আর বেশি কী চাওয়ার থাকতে পারে?
তাবাসসুম উচ্ছ্বসিত গদগদ গলায় বললো, 'জ্বি আম্মা অবশ্যই।'
খুব শীঘ্রই কাজী ডেকে একই স্টেজে নাহিদ উল্লাহর তিন বিয়ে পড়ানো হলো। তাবাসসুম নিজের হাতে নাহিদকে সুগন্ধি মেখে মিষ্টিমুখ করালো।
তাবাসসুমের পাঁচ বছরের মেয়ে নতুন তিন বউয়ের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো, 'আম্মু ওরা কারা?'
'ওরা তোমার খালামনি, বাবু।'
তাবাসসুম দেখলো নাহিদ হাসছে। প্রাণখোলা সেই হাসি। তাবাসসুমের হৃদয় ঠান্ডা হয়ে গেলো। মনে হলো, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী কেউ নাই।
বিড়বিড় করে তাবাসসুম বললো, 'আমি অক্সফোর্ড পেয়েছি। স্বামীই আমার অক্সফোর্ড!'
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন