প্লিজ, চকবাজারের আগুনকে চকবাজারেই রাখুন!

২৩১৯ পঠিত ... ১৫:১৫, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯

মধ্যরাতে শহীদ মিনারে ফুল দিচ্ছে সবাই। একজন হন্তদন্ত হয়ে এসে জানায়, চকবাজার পুড়ছে। শাল জাড়ানো এক বরেণ্য ব্যক্তি বলেন, প্যানিক ছড়াবেন না। আগুন নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে; দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্ব পালন করছে; এমন তো নয় আমরা সবাই এক বালতি করে পানি হাতে চক বাজারের দিকে দৌঁড়ালেই আগুন নিভে যাবে। 

বরেণ্য ব্যক্তি ভাষা শহীদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য মুখে ফুটিয়ে বেদিতে ফুল দেন। টিভি ক্যামেরার দিকে শোকের চোখে তাকান। ফুল দেয়া হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় কীভাবে ভাষা শহীদ দিবসের শোকের সঙ্গে গর্বের অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেন টিভিতে দেয়া লাইভ ইন্টারভিউতে। 

আরেকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক এসে অনুরোধ করে, আমাকে একটা বাইট দিয়ে যান স্যার। 

বরেণ্য ব্যক্তি স্মিত মুখে বলেন, এক্ষুণি তো একজনকে দিলাম; আপনি অন্য কাউকে ইন্টারভিউ করুন। আজ রাতেও একটা টকশো আছে; বিকেলে আছে বইমেলায় মোড়ক উন্মোচন। যাই একটু জিরিয়ে নিই। 

সকালের দিকে এক আপা হন্তদন্ত হয়ে কবিতা পাঠের আসরে যাচ্ছেন। একজন খবর দেয়, আপা চকবাজারের আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। 

আপা চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আগুন আবার এ পর্যন্ত চলে আসবে না তো। 

--না আপা এইখানে আগুন আসতে পারবে না। 

--তাহলে ঠিক আছে। 

আপার স্বরচিত কবিতা পাঠের সময় অন্য দুজন কবি পিছে বসে চকবাজারের আগুন নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছিলো। 

--চট করে চকবাজারে আগুন নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলি নাকি! 

আরেক কবি ধমক দেয়, একুশের কবিতা পাঠের আসরে ওটা বড্ড বেমানান শোনাবে। এখানে সংস্কৃতির আগুনের বিষয়টাই মানানসই। 

বইমেলা জমে উঠেছে। একুশের বর্ণমালার শাড়ি-ফতুয়া পরে তরুণ-তরুণীরা হাঁটছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা ছন্দপতন। চকবাজারে লাশের সংখ্যা বাড়ছে; বার্ন ইউনিটে আহতরা আসছে। অনেক তরুণ প্রাণের টানে রক্ত দিতে সেখানে দৌঁড়াচ্ছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক সংগঠকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন; একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের ছন্দটা ধরে রাখতে। 

একটি জীবনমুখী গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের সময়, লেখক বলছে, খেটে খাওয়া ছোটখাট মানুষেরাই আমার সাহিত্যের উপজীব্য; এই যারা রিক্সা বা ভ্যান চালায়, মুটে মজুর, দারিদ্র্যে বিশীর্ণ যাদের জীবন। 

একজন দর্শক বলে, এমন মানুষেরাই তো আজ চকবাজারের আগুনে পুড়ে মরেছে। 

উপস্থাপক অনুরোধ করে, বিষয়ে থাকুন, উপন্যাসের আলোচনায় থাকুন। 

দিনের অপর একটি আলোচনা সভা শুরুর সময় এক আলোচক এসে সংগঠককে জিজ্ঞেস করে, আলোচনার বিষয় কী ভাষার গতিশীলতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না কী চকবাজারের আগুন প্রসঙ্গটা আসবে! 

সংগঠক বলে, বিষয়ে থাকুন; ভাষার গতিশীলতার মধ্যে থাকুন। 

আলোচক বলে, মানুষের মুখেরই তো ভাষা; সেই মানুষ পুড়েছে যখন। 

সংগঠক আলোচকের পিঠে থাবা দিয়ে বলে, শুরুতে এক মিনিট নীরবতা পালন হবে চকবাজারের নিহতদের স্মরণে। ফলে ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি বিষয়ে থাকুন। 

পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই অনেকে তাদের একুশে উদযাপনের সেলফি; আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্য ড্রাফট করে রাখা স্ট্যাটাস, নতুন গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন আর অটোগ্রাফ দেবার ছবি ফেসবুকে আপলোড করে ফেলে। ভাবখানা এমন কোথাও এমন কিছু ঘটেনি যে একুশে'র আনুষ্ঠানিকতা পালনে কোন ব্যত্যয় ঘটতে হবে। 

ফেসবুক যেহেতু রিয়্যাল টাইমে যে কোন ঘটনার প্রতিক্রিয়ার মাধ্যম; তাই সেখানে চকবাজারের এই ট্র্যাজেডি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখে, যেহেতু গরিব মানুষ মরেছে, তারা কেউ সেলিব্রেটি নয়; কেবল সংখ্যা; সুতরাং তাদের শোকে মধ্যবিত্ত আর ধনিক শ্রেণীর দিবস পালন থেমে থাকবে কেন! এরা পারেও; হৃদয়হীন খোলস কতগুলো! 

অমনি সম্বিত ফিরে পায় হৃদয়হীন খোলসেরা। তারা চেষ্টা করে, এবার আর একুশে'র নির্ধারিত বিষয়ে না থেকে চকবাজারের জন্য শোক প্রকাশের বিষয়ে ফিরে আসতে। 

এতে করে জন্ম নিতে থাকে, একের পর এক পুষিয়ে দেয়া স্ট্যাটাস। 

--যখনই চকবাজারে আগুন ধরার খবরটা পেয়েছি; আর ঘুমাতে পারিনি; সারারাত জেগেই ছিলাম। 

"হ্যাশট্যাগ সারারাত জেগে"ই ছিলাম ট্রেন্ডের পর "হ্যাশট্যাগ কিছুতেই মনটাকে শান্ত করতে পারছি না" ট্রেন্ড স্ট্যাটাসগুলোতে শোকের ঢেউ তৈরি করে। 

"নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে চকবাজার ট্র্যাজেডি; এরপর যেন এমন ট্র্যাজেডি আর না ঘটে"; একথা লিখে একজন স্ট্যাটাস দিতেই; স্ট্যাটাসদাতার সহমত ভাই এসে একটু সংশোধন করে দেয়, ভাই বাক্যের শুরুতে মনুষ্য সৃষ্ট ট্র্যাজেডি করে দেন; কারণ এখানে প্রশাসনের কিছুই তো করার ছিলো না। জনগণই দায়ী; মানে বিস্ফোরিত গ্যাসের সিলিন্ডার দায়ী; কিংবা দায়ী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার; আবার কারখানার রাসায়নিক দ্রব্যও দায়ী হতে পারে; কিন্তু কোনভাবেই সরকার দায়ী নয়। 

এবারে একেবারে চলতি বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে জীবনমুখী সাহিত্যের আরেক লেখক তার নতুন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তৈরির ফাঁকে একটা চমক লাগা বিজ্ঞাপন দিয়ে দেয়। 

"শোষিতের বেদনা গাথা; বঞ্চিতের অবহেলিত জীবন; নিপীড়তের কান্নায় ঠাসা উপন্যাস, "চকবাজারে পুড়ে যায় মোমের ডানা" আসবে বইমেলার শেষ দিন। আপনার কপি সংগ্রহ করুন।"

২৩১৯ পঠিত ... ১৫:১৫, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top