এরশাদ : এক কোমল মনের কবির দুর্দশার করুণ উপাখ্যান

১৪৫১ পঠিত ... ০৩:৫৭, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৮

এ দেশের ছেলেবুড়ো সবাই এক নামে কাকে চেনে বলুন তো? আর কেউ নয়, সে কিন্তু আমাদের হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ! এত এত রাজনীতিবিদদের চরিত্র কেমন তা আমরা কখনোই পুরোপুরি জানতে না পারলেও, উনার চরিত্র সম্পর্কে সবাই জানি। বলুন তো কেমন? অবশ্যই সবাই একমত হবেন... তিনি একজন ফুলের মতো পবিত্র মানুষ। তিনি একজন কবি, কোমল মনের কবি।

তার কবিতায় আমরা বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সহজ-সরল রোমান্টিকতার প্রকাশ দেখতে পাই। তিনি যেমন লিখেছেন প্রেম নিয়ে, তেমনই লিখেছেন বন্যা নিয়ে। তার কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ও একাকীত্বও। এক কথায় বাংলা কবিতাজগতে তিনি যেন চালিয়েছেন স্বৈরাচারী আগ্রাসন। হ্যাঁ, এটাই এরশাদ।

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

শুধু কি কবিতাই লিখেছেন? তা নয়। এই কবি মন নিয়েই তিনি ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন প্রায় এক দশক। শিশুরা যেমন প্রিয় খেলনা ধরে রাখে, তেমনই পরম এক মমতায় গদিকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন এতটাই প্রেসিডেন্ট, এতটাই প্রেসিডেন্ট, যে নিজের বাড়ির নামটাকেও দিয়েছিলেন- প্রেসিডেন্ট পার্ক!

কবিদের জীবনে প্রেম থাকে, এরশাদের জীবনেও তার কমতি ছিল না। তবে সব ছাপিয়ে, ক্ষমতাই ছিল এই কবির প্রেম। প্রেমিকাকে যতদিন পেরেছেন, জোর করে হলেও আঁকড়ে ধরে রেখেছেন!

কবিকে যেমন প্রেমিকারা ছেড়ে যায়, তেমনি এরশাদকেও ছেড়ে গেছে ক্ষমতা। এরশাদ তবুও ভোলেননি তার প্রেমিকাকে। আর কখনো দেখা হোক না হোক, তাকে পাওয়ার আশা তিনি কখনো হারাননি, কখনো না। সেজন্য যত পল্টিই নিতে হোক, তিনি নেবেন।

অথচ তবুও, গণতন্ত্রের এই হারিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্টই পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী রাজনীতিবিদ। ২০ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, 'এখনো আমার নামে মামলা আছে। একটা দিনের জন্যও মুক্ত ছিলাম না, এখনো নেই। আমার মতো দুঃখী রাজনীতিবিদ আর কেউ নেই।'

দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে ভাবেন তিনি। সব দলকে তিনি আপন করে নিতে চান। কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি তার কোন বিদ্বেষ নেই। তিনি দেশের ক্রান্তিকালে জেলে যেতেও রাজি হয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর আওয়ামীলীগ টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার আগে তিনি বলেছিলেন, 'সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ তাঁকে থুতু দেবে। এর চেয়ে জেলে মরে যাওয়া ভালো।'

এরপর তিনি যা করেছে তার জন্য আপনারা তাকে পল্টিবাজ বলেন। অথচ তিনি অতসব ভাবেননি! তিনি দেখলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। অর্থাৎ দেশের সংসদে কোন বিরোধীদল থাকবে না। এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এই সময় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারকারী এরশাদ বললেন, 'নির্বাচনে না গেলে মানুষ থুতু দিবে।'

মানুষ পল্টিবাজ বলবে জেনেও শুধু গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আসলে পুরুষই নন... মহাপুরুষ!

১৯৮৬ সালে এরশাদকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করা হয় বিশ্বের 'রিচেস্ট প্রেসিডেন্ট অব দ্য পুওরেস্ট কান্ট্রি'। অথচ জাঁকজমকহীন এই লোকটির জীবনে কীই-বা আছে বলেন। মাত্র একটা ব্যাংকের মালিক তিনি। হয়তো তাকে নিয়ে দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়েছে। তবু তিনি নীরব। কাউকে কিছু বলেন না। কোন হুমকি-ধামকি দেন নি। শিল্পী কামরুল হাসান এরশাদকে 'বিশ্ব বেহায়া' হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন। তারপরও তিনি বেঁচে আছেন। দেশের গণতন্ত্র উদ্ধার করছেন। লজ্জাবোধের কোনো ধার ধারেন নি। দেশের সেবার কাছে এসব যে নস্যি, তা তিনি ভালোভাবে প্রমাণ করেছেন।

অথচ এই মানুষটাই কী অসহায় একবার চিন্তা করেছেন। তিনি নিজেই তার পরিচয় জানেন না! তিনি বোঝেন না-তিনি সরকারি দল, না বিরোধী দল। এক সময় যার কথায়ই উঠত বসতো হাজারো দূত, দেশের প্রয়োজনে তিনি কাজ করছেন এক 'বিশেষ দূত' হিসেবে!

কারও কথা না শুনলে আপনাকে কী করা হয়? সর্বোচ্চ বকাঝকা করা হয়। আর এরশাদ সাহেবকে সোজা হাসপাতালে পাঠানো হয়। কী মর্মান্তিক! হাসপাতালে গিয়েও কি শান্তি আছে? আপনারা তার শারীরিক অসুস্থতা বোঝেন না। বলেন 'রাজনৈতিক অসুস্থতা'।

কোমল এই কবির মন যেভাবে বিচূর্ণ হয়েছে, সেই গল্প বর্ণনা করার মতো নয়। আর পারছি না। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। তবে একটা উক্তি উল্লেখ না করলেই নয়- ২০১২ সালে এরশাদের মৃত্যু নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জাপার মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, 'হে আল্লাহ, আমাদের সবার কাছ থেকে আয়ু নিয়ে নেতার বয়স বাড়িয়ে দাও।'

উনার দুর্দশার এই পর্যায় যেন আরো দীর্ঘ হয়, সেজন্যই অমনটা চেয়েছিলেন কিনা কে জানে!

১৪৫১ পঠিত ... ০৩:৫৭, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top