সুবোধ তুই পালিয়ে যা, গণতন্ত্র সহসা মুক্তি পাবে না : নূর হোসেন

৩২১৮ পঠিত ... ১৬:৪৯, নভেম্বর ১০, ২০১৭

ভোরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে সুবোধ। যে রাতে তাদের গ্রামে হামলা হলো; সম্ভ্রমহানির ভয়ে ওর বোন নদীতে নেমেছিলো; সেই বিষাদ যমুনা সাঁতরে ক্লান্ত সুবোধ। তারপর কত পথ হেঁটে দৌড়ে দৌড়ে চারপাশ থেকে "সুবোধ তুই পালিয়ে যা" হুঁশিয়ারী শুনে শুনে সুবোধ সিদ্ধান্ত নিয়েছে; আজ ভোরের ট্রেনের নীচেই ঝাঁপ দেবে সে। 

ট্রেনটা আসছিলো; ঝমঝম শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছিলো সুবোধের শরীর; পিছুটান বলতে ছিলো শৈশব স্মৃতি; তারা তেড়ে ফুঁড়ে আসতে থাকে। ট্রেন কাছাকাছি এলে সুবোধ চোখ বন্ধ করে ঝাঁপ দেয়। পেছন থেকে একটা লোক জাপটে ধরে সুবোধকে সরিয়ে দিয়ে নিজে ট্রেনের নীচে চলে যায়। ধাক্কা খেয়ে সুবোধ একপাশে পড়ে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে লোকটার জন্য। কী আশ্চর্য ব্যাপার; ট্রেন পেরিয়ে গেলে একটা লোককে রেললাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। 

লোকটা লুঙ্গি পরা; খালি গায়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। তার বুকে লেখা "স্বৈরাচার নিপাত যাক"। এবার সে ঘুরে দাঁড়ায়। তার পিঠে লেখা "গণতন্ত্র মুক্তি পাক"। 

সুবোধ অনেকদিন পর এসব লেখা দেখে প্রাণখুলে হাসতে থাকে। লোকটা একটু রেগে গিয়ে বলে, হাসো হাসো হাসবাই তো। তোমরা ইয়াং পোলাপান আর এইসব শ্লোগানের মর্যাদা কী কইরা বুঝবা! 

সুবোধ বলে, নিজের বোনের সম্ভ্রমের মর্যাদাই রক্ষা করতে পারলাম না; আপনের শ্লোগানের মর্যাদা দিয়া কী কাঁচকলা হইবো! 

লোকটা বলে, তোমরা বাচ্চা পোলাপান; আমারে নিশ্চয়ই চিনবা না। 

--চিনি আপনারে; আপনে নূর হোসেন; দুনিয়ার সবচাইতে বোকা লোকগুলির একটা।

--অই পোলা নিজে তো বোকার মতন ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়া মরতেছিলা; আমারে বোকা কও কেন!

--বোকা কই এই জন্যে যে আপনি যে স্বৈরাচারের গুলিতে প্রাণ দিছিলেন; তিনি এখন বিশেষ দূত। আর আপনের মৃত্যুদিবসে "গণতন্ত্র" যে বাণী দিছে, সেইখানে আপনার হত্যাকারীরে স্বৈরাচারী শাসক বইলা ছাইড়া দিছে; নাম কইয়া হ্যারে বিব্রত করে নাই।

--অ বুঝছি একাত্তরের হানাদার কইয়া যেমন আগের "গণতন্ত্র" খুনীগো নাম লুকাইতো।

--একই খেলা চলছে হরদম। যেমন খুশি গণতন্ত্র সাজো।

নূর হোসেন মুষড়ে পড়ে। বেদনা ভারাক্রান্ত মুখে বলে, ভালো কিছু কও; মন ভালো করা খুশির খবর দেও।

--জিডিপি গ্রোথ বুঝেন, ঐডা অনেক বেশি।

--বুজলাম না সহজ কিছু কও।

--আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। ফ্লাইওভারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একটা পদ্মা সেতু হইতাছে; আরও হইবো!

--খুবই খুশির সংবাদ। তা এতো খুশি থুইয়া তুই ট্রেনের নীচে মরতে গেছিলি কা!

--প্রথম দিন একদল লোক পিক আপে কইরা মন্দিরের মাল-সামান তুইলা নিয়া গেলো; এরপর আমগো পাড়ায় আগুণ দিলো, বাড়ি বাড়ি হামলা করলো। বোনডা সম্ভ্রম বাঁচাইতে নদীতে ঝাঁপ দিলো; বাপে কইলো, সুবোধ তুই পলায়ে যা; সময় খারাপ। আমি তো পলাইলাম। ওদিকে মন্ত্রী বলছেন, লোকজন নাকি নিজে নিজেই মিসিং হয়; এতে উনাদের অসুবিধা হয়। উনাদের যাতে আর অসুবিধা না থাকে; তাই মরতে নিছিলাম।

--কস কী সুবোধ!

--আপনে যে স্বৈরাচারের গুলিতে প্রাণ দিলেন; সে নিজে ইসলামরে রাষ্ট্রধর্ম কইরা অহনো "অনুভূতি"র বানিজ্য চালাইয়া যাইতেছে। এইবার সে এক হুজুরের হস্ত মুবারক চুম্বন কইরা গণতন্ত্র হেফাজত কইরা আসছে।

--ওরে সুবোধ একই খেলা চলছে হরদম। তা আমারে কী কেউ মনে করে!

--খাইয়া-দাইয়া আর কাম নাই কারো; দিনে পাঁচওয়াক্ত যেইসব ইতিহাস হুজুর ইনাইয়া বিনাইয়া ইতিহাসের ফতোয়া দেয়; তারা আপনের ইতিহাসটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকাইয়া উন্নয়নের তজবিহ টিপে। 

নূর হোসেনের চোখ ছলছল করে। ভেজা গলায় বলে, যুগের পর যুগ আমগো মতন ভেড়া আগাইয়া দিয়া সিংহ মামারা খেলা দেখে আর ঘুরাইয়া ফিরাইয়া জঙ্গল শাসন করে। 

সুবোধ অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, নূর হোসেনের বুকে-পিঠে নতুন লেখা ভেসে উঠেছে, গণতন্ত্র নিপাত যাক-স্বৈরাচার মুক্তি পাক।

৩২১৮ পঠিত ... ১৬:৪৯, নভেম্বর ১০, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top