আপনি যে পেঁয়াজওয়ালার কাছ থেকে পেঁয়াজ কেনেন, আপনি কি সে পেঁয়াজওয়ালাপন্থী হয়ে যান! আপনি যে লনকাপড় বিক্রেতার কাছে কাপড় কেনেন; আপনি কি সে লনকাপড়ওয়ালা হয়ে যান! কাজেই ভারত বা পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রের পন্থী হবার কোন বাস্তবসম্মত কারণ নেই।
চীন, সৌদি আরব, এমেরিকা, ইউরোপ; এরা বিনিয়োগ করে, টাকা ধার দেয়, রেমিটেন্স উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়; তাদের সে অর্থনৈতিক সামর্থ্য রয়েছে। সুতরাং কেউ তাদের পন্থী হলে তবু কিছুটা বুঝতে পারি। কিন্তু যে ভারতের বা পাকিস্তানের দুপয়সা দিয়ে সাহায্য করার মুরোদ নেই; বরং বাংলাদেশের বাজারে দুটো পেঁয়াজ, লনকাপড় বেচলে যাদের সাহায্য হয়; তাদের আবার পন্থী হয় মানুষ কোন আক্কেলে।
পূর্ববঙ্গ ছিলো মুঘল ও নবাবী আমলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ইকোনমিক পাওয়ার হাউজ; মুঘল আমলে চীনকে টপকে দক্ষিণ এশিয়া যে পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলো; তার মূল অর্থনৈতিক শক্তির উৎস ছিলো পূর্ববঙ্গ; আজকের বাংলাদেশ।
বৃটিশ আমলে স্থানীয় কোলাবরেটরদের জমিদার বানিয়ে; পূর্ববঙ্গের সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরদের পীড়ন ও নির্যাতনের মাধ্যমে দরিদ্র ও দুস্থ বানিয়ে ফেলা হয়। সেই যে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেলো এই জনপদের মানুষ; যে কারণে পেঁয়াজ ও কাপড় বিক্রেতার পন্থী হবার মতো একটা হাস্যকর ব্যাপার আজও বাংলাদেশ সমাজের অল্পকিছু মানুষের মধ্যে জারি রয়েছে।
বাংলাদেশ এমন একটা দেশ; যে দেশের মাটিতে সোনা ফলে পরিশ্রমী কৃষক ও কৃষাণীর জাদুর ছোয়ায়। সেলাই ভাই-বোনেরা কঠোর পরিশ্রম করে গার্মেন্টস খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। শ্রমজীবী মানুষেরা আরব বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে দেশের জন্য রেমিটেন্স জোগাড় করে। ফলে বার বার দেশলুণ্ঠন হবার পরেও বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়ায়। ভারতে ধনী-দরিদ্রের যে বিশাল ব্যবধান, পাকিস্তানে অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা; তা বাংলাদেশে কখনোই নেই। ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করেছে দ্রুততার সঙ্গে।
ভারত ও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ; যাদের ক্ষমতা কাঠামো ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই; যারা স্বীয় দেশের এস্টাবলিশমেন্টের পীড়নে ক্লিষ্ট; তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের চলচ্চিত্র, পাকিস্তানের ড্রামা সিরিয়াল, উভয় দেশের সংগীত-সাহিত্য বাংলাদেশের মানুষ পছন্দ করে। এই দুই দেশের নাগরিকেরও বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি-সংগীত-চিত্রকর্মের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। ইন্টারনেটের উন্মুক্ত পৃথিবীতে কৃত্রিম সীমান্তরেখা মুছে দিয়ে যে বিশ্বনাগরিক তৈরি হচ্ছে; তাদের জগত সংকীর্ণ কোন আদিম ঘেরাটোপে পড়ে নেই।
কিন্তু ভারত-পাকিস্তানপন্থী হবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ উপস্থিত নেই বাস্তবে। দক্ষিণ এশিয়ার এই গরিবের গ্রামে এক গরিব আরেক গরিবের পন্থী হয় কেমন করে।
বৃটিশ আমলে জমিদারের নির্যাতনে মানসিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর মাঝে; ইসলাম ধর্মপরিচয়কে ছোটো ভাবার আর ইসলাম ধর্মকে আশ্রয় হিসেবে আঁকড়ে ধরা দুটি চিন্তাগোত্র তৈরি হয়েছে। ফলে জগলুলের এক ছেলে পথিকৃত বাতেন নাম ধারণ করে সংস্কৃতি মামা হয়েছে। সে পেঁয়াজ বিক্রেতাপন্থী হয়েছে; আর এক ছেলে বাতেন বিন জগলুল নাম ধারণ করে ইসলাম মামা হয়েছে; সে কাপড় বিক্রেতাপন্থী হয়েছে। অথচ জগলুলের বাড়িতে দাওয়াত হলে মাছ-মাংস-সবজিসহ বহুপদের তরকারি দিয়ে সে মেহমানদারি করে। কিন্তু পথিকৃত বাতেন পেঁয়াজওয়ালার বাসায় পোস্তভর্তা ভাত খেয়ে ভাবে, আহা কী কালচার! আর বাতেন বিন জগলুল কাপড় বিক্রেতার বাসায় এক পদের বিরিয়ানি খেয়ে ভাবে, আহা কী কালচার!
পথিকৃত বাতেন আর বাতেন বিন জগলুলকে একটু কষ্ট করে ইংরেজি শিখতে হবে। ইংরেজি চলচ্চিত্র, ড্রামা সিরিয়াল, ডকুমেন্টারি দেখে দৃষ্টিসীমা প্রসারিত করতে হবে। তাহলে সে বুঝতে পারবে কি সব কাঁচা ভারতীয় চলচ্চিত্র আর পাকিস্তানি ড্রামা সিরিয়াল দেখে তারা আহাউহু করে। নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির কাছাকাছি নাটক ও চলচ্চিত্র দেখতেই হয়, এখন বাংলাদেশেই ভালো চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মিত হচ্ছে।
যারা কপি ক্যাট, যাদের নিজের বাবা-মাকে যথেষ্ট স্মার্ট মনে হয় না; তারা বরং এমেরিকা ও ইউরোপের স্মার্টনেস কপি করলে পারে। কিসব ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর মার্কা পেয়াজওয়ালা ও কাপড়ওয়ালা সেজে ঘোরাঘুরি আর পন্থী হওয়া।
বাংলাদেশে অজানা কারণে ইংরেজি শিক্ষাকে দুর্বল করে দিয়ে পাতকুয়াপন্থী কিছু লোকজন তৈরি হয়েছে। ফলে দৃষ্টিসীমায় বিশ্ববীক্ষা ধরা না দিয়ে গোমাতাপুরের গোবর ছোঁড়ার উতসব আর গোমাংসপুরের কাদা ছোঁড়ার উতসব-এ সীমাবদ্ধ হয়েছে পথিকৃত বাতেন সমাজ ও বাতেন বিন জগলুল সমাজ।
পূর্ববঙ্গের কৃষকের সম্পদ লুটে বৃটিশদের যে সেরেস্তাদার, মুন্সীরা কলকাতায় জমিদার বাড়ি তৈরি করেছিলো; আর পাঞ্জাবের কৃষকের সম্পদ লুটে বৃটিশদের যে সেরেস্তাদার, মুন্সীরা লাহোরে জমিদার বাড়ি তৈরি করেছিলো; এদের কোন আভিজাত্য নেই; বস্তাপচা জমিদার মানসে কখনোই কোন সফিস্টিকেশন থাকে না। অযথা পথিকৃত বাতেন কলকাতায় আর বাতেন বিন জগলুল লাহোরে এরিস্টোক্রেসি খুঁজে হয়রান। এরিস্টোক্রেসি মানে সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং; সৌখিন হওয়া কিন্তু বিলাসী না হওয়া; নিজের সম্পদের প্রাচুর্য লুকিয়ে হৃদয়ের সম্পদ চর্চা করা। সফিস্টিকেশন মানে প্রতিটি মানুষকে মর্যাদার চোখে দেখা। এই কালচারটা আপনি ইউরোপে পাবেন; তুরস্কেও চোখে পড়বে। এ আমাদের বাংলাদেশেই ছিলো। কিন্তু রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীর দুর্নীতি বসন্ত রোগে তারা স্বদেশের মুখমণ্ডলে অসংখ্য দাগ রেখে গেছে। সম্পদ প্রদর্শনীর কুৎসিত জঙ্গলে সৎ মানুষ নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। কাস্ট সিস্টেমে বা শ্রেণী বৈষম্যে ক্ষত-বিক্ষত সমাজে তাই পথিকৃত বাতেন ও বাতেন বিন জগলুল হিন্দুত্ববাদ ও ইসলামপন্থার কেতন উড়িয়ে প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। বিশেষ কিছু হয়ে উঠতে মরিয়া তারা। তাই তো পেয়াজওয়ালাপন্থী ও কাপড়ওয়ালাপন্থী বাইনারি চর্চা করে শিং ঘষাঘষি করে। বিশেষ বা বিরাট না হয়ে সমাজের সবার মাঝে একজন বা অন্যতম হয়ে বাঁচতে শেখাটাই আধুনিক মানুষ হবার প্রথম লক্ষণ।



পাঠকের মন্তব্য