গ্রাম থেকে রওনা দিয়েছি, ঢাকায় ফিরবো। ঢাকায় ফিরেই তো একদম গা ঢাকা। অনেকদিন পর এবার গিয়েছিলাম বাড়ি, আবেগের বেগটা অনেক বেশি ছিল। যাকে চিনি তার সাথে চিনির মতো ব্যবহার, আর যাকে চিনি না তার সাথে অচীন ব্যবহার করিনি, নিদেনপক্ষে মিষ্টি হাসি তো মুখে ছিলই।
একদিন ছেলেপেলেরা ধরলো, একটা লাইব্রেরি করবে। ভালো উদ্যোগ, একটু লাই দেয়া যেতেই পারে। গেলাম। জন বিশেক লোক নিয়ে ছোট্ট আয়োজন। বেশ ঘরোয়া পরিবেশ। লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা, বই পড়ার গুরুত্ব, মনন, বিকাশ, সৃজনশীলতা এ নিয়ে লতায়পাতায় অনেক কথা হলো। এরপর এলো মূল প্রসঙ্গ। যে যার সাধ্যমতো টাকা কিংবা বই দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো। আমি টাকা দেয়ায় বিশ্বাসী না, টাকা খুব বাজে জিনিস, চরিত্রহীন, যার কাছে যায় তার হয়ে বাজে।
আমি বললাম, বই দিবো। এরপর নানা আলোচনা শেষে সবাইকে বাই দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাস ধরতে হবে। ঢাকার বাস টাকায় চলে। মিস হলে অনেকগুলা টাকা লস। মনে মনে ভাবলাম, ছেলেরা একটা লাইব্রেরি করছে, বেশ কিছু ভালো বই দেয়া উচিত। বাস ছাড়ার সাথে সাথে মনে মনে হিসেব কষে ২০-২৫ টা ভালো ভালো বইয়ের একটা লিস্টও দাঁড়িয়ে গেলো। বাস হাওয়ার বেগে চলছে, জানলা দিয়ে আসা হাওয়ায় টের পেলাম।
ঘন্টাখানেক আসার পর ক্ষণিকের জন্য মনে হলো শুধু শুধু এতগুলো বই দিয়ে কি এমন বয়ে যাবে? কেউ পড়বে না। অযথা টাকা নষ্ট। লিস্টিটা ছোট হলো। বইয়ের সংখ্যা ঠেকলো আঠারোতে।
বাস চলছে। মাঝামাঝি আসার পর যাত্রাবিরতি, যাত্রীরা নেমে গেলো অনেকে, কেউ কেউ তখনও নাক ডাকায় বাস সুপারভাইজারের ডাক শুনতে পায়নি। আমি নামার দলে, তখনই প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দিলে পরে অপ্রকৃতস্থ হতে হবে। প্রকৃতির ডাক শেষ না হতেই পেটের ভিতরের পোকারা একসঙ্গে হাঁকডাক শুরু করলো। তাদের শান্ত করতে না করতেই বাস ছাড়ার ডাক চলে এলো। বাস ছাড়তে না ছাড়তেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে ভাবনায় চলে এলো বই প্রসঙ্গ। নাহ, এতগুলো বইয়ের মর্ম ওরা বুঝবে না। লিষ্ট আরও ছোট হলো। ১০টা অনেক বই।
বইয়ের লিষ্ট ছোট হওয়ার কারণে কিনা কে জানে এরপর আরামের একটা ঘুমও হলো। যাত্রাবাড়ি এসে ঘুমের যাত্রাবিরতি। উপায় ছিল না। একটা জায়গায় যদি সবগুলো গাড়ি একসঙ্গে এভাবে চিৎকার করে, স্থায়ী ঘুমের লোকদের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কথা।
মেজাজ খিছড়ে গেলো। ১০টা বই! মামার বাড়ির আবদার!! ভালো বই পাঁচখানা হলেই অনেক।
বাসায় পৌঁছাতেই বাড়িওয়ালার সাথে দেখা। নানান কলা-কুশলের আড়ালে বাড়ি ভাড়া উসুলের কথাটাও জানিয়ে দিলেন।
বাসার সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মনে হলো, বই? সে তো দুটি পুরোনো বই বাসায় অনেকদিন পড়ে আছে, পড়াও হয়নি। গ্রামের একটা লাইব্রেরিতে দানের জন্য খাসা অনুদান।
এত লম্বা জার্নির পর একটা গোসল দিয়ে ঘুমের চেয়ে উপাদেও আর কিছুই নেই।
সকালে ঘুম থেকে উঠে লাইব্রেরির কথাটা মনে পড়লো ঠিকই, কিন্তু বই দেয়ার কথাটা আর মনেই পড়লো না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন