তুল্লো রানি বিমান থেকে নামতেই তাকে ফুলমাল্যে নেচে গেয়ে বরণ করে ইসকনের ভক্ত ও ভক্তিরা। বিজিত দোভাল করজোড়ে দাঁড়িয়ে নমস্কারের স্থির চিত্র। অগ্নিবীণা সিক্রি বরণ ডালা থেকে সিঁদুর তর্জনিতে লাগিয়ে তুল্লো রানির কপালে একটা রক্তিম টান এঁকে দেয়।
তুল্লো রানি হরে হরে কৃষ্ণ বলে উঠলে; ইসকন ভক্তরা হরে হরে কৃষ্ণ বলে। পেছনে দাঁড়ানো ভাজপা নেতৃত্ব সমস্বরে বলে, জয় শ্রীরাম।
অগ্নিবীণা সিক্রি কলকাতা থেকে আসা সাংবাদিক অসুর ভট্টাচার্যকে পরিচয় করিয়ে দেয় তুল্লো রানির সঙ্গে। অসুর ঘাড় কাত করে নমস্তে বলে কাঁধের ঝোলা থেকে একটা বই বের করে তুল্লো রানিকে উপহার দেয়। ফরগটেন হাভেলিজ অফ বাংলাদেশ গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বৃটিশকে তেলাঞ্জলি দিয়ে জমিদারি লাভ করেছিল যে জগতশেঠ রাশির লোকেরা; পূর্ববঙ্গের সদ্য ভূমি হারানো কৃষক ও আড়ং হারানো কারিগরদের রক্ত শুষে যারা বড় বড় জমিদার বাড়ি বানিয়েছিল; সেইসব জমিদার বাড়ি হারিয়ে কলকাতায় গড়ে তোলা সেকেন্ড হোমে যারা ভগ্ন ও ক্ষয়িষ্ণু দুর্দশাময় জীবন কাটিয়েছে; তাদের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে লেখা এই বইটি। অসুর ভট্টাচার্য এই মাস্টারপিস গ্রন্থে বাংলাদেশের সেইসব জমিদারি ও হাভেলি পুনরুদ্ধারের রুপকল্প হাজির করেছে।
অগ্নিবীণা সিক্রি তুল্লো রানিকে অনুরোধ করে তার ভারত ভ্রমণের সময়টাতে অসুর ভট্টাচার্যকে গাইড হিসেবে রেখে দিতে। বিজিত দোভাল অসুরকে তুলে দেয় তুল্লো রানির জুরিগাড়িতে।
যাবার পথে মসজিদগুলো তেরপল দিয়ে ঢাকা দেখে তুল্লো জিজ্ঞেস করে, এ অবস্থা কেন!
: হোলির সুবিধার জন্য ঢেকে রাখা হয়েছে।
ছাব্বা ছবির বিরাট পোস্টার দেখে তুল্লো জিজ্ঞেস করে, শহরে নতুন ছবি নাকি!
: ছবি মানে! ঐতিহাসিক ছবি; ৩০০ বছর আগে এক মুঘল শাসক কীভাবে হিন্দু নির্যাতন করেছিল, কীভাবে সব মন্দির ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল; সব আছে এই ছবিতে। অথচ ঐ সময়ের এক মারাঠি শাসক কত মায়াবি ও সন্ত ছিলেন; তা তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দু শাসকেরা আসলে অত্যন্ত মায়াবি হয়; মোদিকে দেখে তো তোমার বোঝা উচিত।
তুল্লো রানি চোখ গোল গোল করে শুনতে থাকে। তারপর বলে, হিন্দু ধর্মটি অত্যন্ত পরমত সহিষ্ণু; আর ইসলাম ধর্ম একেবারে ভিন্নমত নিতে পারে না।
: মুসলমানেরা চারটে করে বিয়ে করে; আর অসংখ্য বাচ্চা নেয়।
তুল্লো রানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখে হিজাব পরে হাঁটতে থাকা এক নারীকে রঙ ছুড়ে মারছে কপালে লাল তিলক আঁকা কয়েকজন যুবক।
তুল্লো অসুরকে জিজ্ঞেস করে, এটা কী হলো!
: হোলির সময়, একটু রঙ খেললে, একটু জয় শ্রীরাম বলে নেচে যেতে মুসলিম মেয়েটির এত আপত্তি কেন! ও কী ভারতকে ভালোবাসে না! পাকিস্তানের প্রতি এত ভালোবাসা যখন; ওখানে চলে গেলেই তো পারে। ভাত খাবে ভারতের আর গুণ গাবে পাকিস্তানের তা তো হয় না।
একটা বস্তি এলাকা দেখে তুল্লো রানি জিজ্ঞেস করে, মোদি সরকার কি গরিবী দূর করতে পারছে না!
: ওটা আসলে ১৯৪৭ সালের জাদুঘর। সেই যে জমি বাড়ি হারিয়ে পূর্ব বঙ্গ থেকে উচ্ছেদ হয়ে মানুষ এসেছিল; তারা কী মানবেতর জীবন-যাপন করে ঐ চেয়ে দেখো!
: বাংলাদেশের নতুন সরকারের আমলে কী অবস্থা!
: ওটাকে আর বাংলাদেশ বলো না, পূর্ব পাকিস্তান বলো। ওখানে খালি দাড়ি টুপি আর হিজাব। হাসিনা ক্ষমতায় না থাকা মানেই বাংলাদেশ মৌলবাদী দেশ হয়ে যাওয়া।
: ইউনূস তো নোবেল বিজয়ী, তার তো সুনাম আছে বিশ্বে।
: মুসলমান নোবেল পুরস্কার পেলেও মুঘল থেকে যায়। সে তো চীনের সঙ্গে খুব দহরম মহরম করছে। ভারতের সেকুলার স্পিরিট থেকে মুখ ফিরিয়ে পাকিস্তানের কট্টর ইসলামপন্থার প্রতি তার আগ্রহ বেশি। ওখানে খেলাফত কায়েমের চেষ্টা চলছে। তাই তো হাসিনার পতনের পর হিন্দুরা ভালো নেই সেখানে। ভালো নেই সেকুলার সমাজ।
: ভারতের সেকুলার সমাজ কেমন আছে!
: ভারতের সেকুলার সমাজ তো পাকিস্তানি হয়ে গেছে। হিন্দুদের জন্য তাদের মায়া নেই; শুধু মুসলমানের দুঃখে কাঁদে। তুমি খ্রিস্টান থেকে হিন্দু হয়ে হিন্দুত্ববাদকে যেভাবে বরণ করেছ; তা দেখে ভারতের সেকুলার সমাজের লজ্জা পাওয়া উচিত।
এবার তুল্লো রানির মুখে একটু হাসি ফুটে। সে একের পর এক অফিশিয়াল মিটিং সারতে থাকে। প্রতিটি মিটিং-এ বরণ ডালা থাকে, ফুল-চন্দন থাকে, দিয়া থাকে। প্রত্যেকটা অফিস যেন এক একটা মন্দির হয়ে উঠেছে। জায়ান্ট স্ক্রিনে বাংলাদেশের একটা রেস্টুরেন্টে আগুনের ছবিকে মন্দিরে আগুন হিসেবে দেখানো হয়, ক্রিকেটার মাশরাফির বাড়িতে হামলাকে ক্রিকেটার লিটনের বাড়িতে হামলা হিসেবে দেখানো হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী মিছিলকে হিন্দু শরণার্থী মিছিল হিসেবে দেখানো হয়। গেরুয়া পতাকা নিয়ে যুবলীগ খেলাফতি সেজে মিছিলের ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলো বার বার দেখাতে দেখাতে প্রায় বিবর্ণ হয়ে গেছে।
হঠাৎ অসুর ভট্টাচার্য এসে মনে করিয়ে দেয় মিডিয়া ইন্টারভিউ এপয়েনমেন্টের কথা। অসুর গদি মিডিয়ার সাংবাদিকদের প্রস্তুত করেছে।
গদি মিডিয়ার এক সাংবাদিক তুল্লো জিজ্ঞেস করে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন চলছে; সে বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কী ভাবছে?
: এই নির্যাতন তো আজ থেকে নয়; মুঘল আমল থেকে চলছে; বৃটিশ আমলে গড়ে তোলা হাভেলিগুলো ছেড়ে হিন্দু জমিদারদের পালাতে হয়েছে; খুবই দুঃখজনক এই হিন্দু নির্যাতন।
ইউনূস প্রশাসন মৌলবাদিদের খপ্পরে; সেটা ভারত ও এমেরিকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান কী এ বিষয়ে?
: আমরা খেলাফত ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স অনুসরণ করি। এমেরিকা কিংবা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় এমেরিকার নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এমন আইডিওলজিকে আমরা নিরুতসাহিত করি।
ইটারভিউ শেষে অসুর ভট্টাচার্য বলে, বাংলাদেশ সম্পর্কে এটুকু বলে ছেড়ে দেবে তা ভাবিনি। যাক সামনে সময় পড়ে আছে; মহাভারত রচনা করা যাবে। আমার স্ত্রী শাশ্বতী তোমার জন্য থানকুনি পাতার ঝোল, পোস্ত ভর্তা, পটলের দোলমা, মৌরালা মাছের ঝোল করে পাঠিয়েছে; একটু মুখে নিলে খুব খুশি হবে সে। সে যশোরের মেয়ে; ওর ঠাকুদ্দা ১৯৭১ সালে রাজাকারদের হামলার মুখে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছিল ভারতে। এখনও সে বাংলাদেশের জন্য কাঁদে।
তুল্লো রানির গালের দু'পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
টিভি স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, ছাব্বা ছবি দেখে উত্তেজিত দর্শক আওরঙ্গজেবের সমাধি ভাঙতে জড়ো হয়েছে; নাগপুরে মুসলমানদের বাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কারফিউটা একটু দেরি করে দেওয়া হয়; রিপাবলিক টিভির অর্ণব গোস্বামী কবিতা বলছে, কিছুটা পুড়ুক পোড়া ভালো; তাতে যদি ফোটে গুজরাটের আলো।
(পুনশ্চঃ ভারতের প্রাত্যহিক উস্কানি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের মুসলমানেরা যদি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-পাহাড়ি মানুষের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ একটি জনপদ গড়তে পারে; সেটাই হবে ভারতীয় স্যাঁতসেতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। চোখের বদলে চোখের নেশায় অন্ধ ভারতের বিপরীতে সম্প্রীতিময় চক্ষুষ্মান বাংলাদেশই আমাদের অঙ্গীকার।)
পাঠকের মন্তব্য