৫ আগস্ট দুপুরের আগে ললিতা কল্পনাও করতে পারেনি বুবু থাকবেন না। ও তো ধরেই নিয়েছিল রুপকল্প ২০৪১ পর্যন্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তার। অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রজেক্টে কনসালটেন্সি, হাবির কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট, আর সংস্কৃতিজগতের স্কুল খুইলাছেরে মওলা নিয়ে জীবনটা হয়ে উঠেছিল একদম জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো।
হাতির পুলের কাঁঠাল গাছ ঘেরা ছোট্ট ভাড়া বাসাটা থেকে এই যে গুলশানের চার হাজার বর্গফুটের রাজপ্রাসাদে উঠে আসা; গাজিপুরের খাস জমিতে বাগানবাড়িতে মিডিয়ার সন্দ্বীপ ও বিমলাদের নিয়ে নক্সী সানকিতে নানারকম ভর্তা বিলাস; তারপর বিকেলে বারান্দায় বসে পুরোনো সেই দিনের কথা গাইতে গাইতে চারুকলার বকুলতলার প্রেম, ছবির হাটের লাল চা, টিউশনির টাকা পেয়ে প্রবর্তনায় গিয়ে পয়লা বৈশাখের জন্য শাড়ি কেনা; ভোরের কাগজের কনট্রিবিউটরদের সেই গরম পুরি আর চায়ের উত্তুঙ্গ আড্ডাগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। বৃষ্টিতে রিকশা করে ফেরার সময় আলতো করে প্রজাপতি চুম্বন এঁকে দেওয়া আনন্দসাঁঝ।
গণভবনে পিঠাপুলির দাওয়াত পাওয়ার পর থেকেই হাবি পাওয়ার অ্যান্ড অ্যানার্জির কুইক রেন্টাল প্রজেক্ট পেয়ে গেল। নিজের জন্য জুটে গেল এটু আইয়ের কনসালটেন্সি। দোয়েল ল্যাপটপ খেয়ে তলপেটে ও ঘাড়ে চর্বি জমতেই কিনতে হলো ট্রেডমিল; ভিগান হতে হলো। ফেসবুকে মেল শভিনিজম, মিসোজিনি, গ্লাস সিলিং এই কয়টা ইংরেজি শব্দ বলার পরেই অনেক ভক্ত জুটে গেল। সিনথিয়া, ফওজিয়া, অতন্দ্রিলা, কৈকেয়ী এসে জিজ্ঞেস করল, কী করলে আপনার মতো হতে পারব ললিতা?
এর কদিন পরেই বুবুর হাত থেকে নারী অধিকারের পক্ষে কাজ করার জন্য আজীবন সম্মাননা পদক জুটে গেল। সাড়ে চুয়াত্তর টিভি ও সময় অসময় টিভিতে ডাক পড়তে শুরু করল। এসব ইন্টারভিউয়ের জন্য কিছু ক্যাচওয়ার্ডস থাকে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি, জঙ্গী-মৌলবাদী ইত্যাদি। এই শব্দগুলো দিয়ে কতকগুলো বাক্য গঠনের পর ভক্তেরা ফেসবুক কমেন্টে এসে বলতে লাগল, আপনাকে সংসদে দেখতে চাই ললিতা!
ললিতার তখন দুই রকম কস্টিউমের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পোশাক আবার শেক্সপিয়ারের পরিবারের পোশাক। রবীন্দ্র সংগীত শুনে মাথা দোলানোর জন্য ঊনবিংশ শতকের পোশাক আর লন্ডনে গিয়ে চেক ইন দেওয়ার জন্য বিংশ শতকের পোশাক।
এইসব সংস্কৃতি- খালার জীবনের আনন্দ ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরমাননন্দ নিয়ে জীবন চলছিল ভালোই। কিন্তু ১৫ জুলাই রাতে কী যেন হলো, সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স (ক্রাই)- এর হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে একটা স্টিকার এল, তুমি কে আমি কে বাঙালি। ঘুমের ঘোরে সেটা পোস্ট করে ঘুমিয়ে যায় ললিতা।
১৬ জুলাই ক্রাইয়ের মেসেজ আসে, রংপুরের আবু সাঈদ শিবির ছিল। ব্যস্ত থাকায় ওটার মাথামুন্ডু না বুঝেই ফেসবুকে লিখে দেয় ললিতা। ১৭-১৮ জুলাই গ্রুপ মেসেজ আসে, ছাত্র আন্দোলনে শিবির ঢুকেছে।
অমনি ললিতা লিখে দেয়, আমার মাটি আমার মা পাকিস্তান-আফঘানিস্তান হবে না।
১৯ জুলাই বিজেপি বিপ্লবী বুবুর পোস্ট ভেসে ওঠে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত হয়ে কৃষ্ণচূড়ার ফুল হেসে ওঠার গল্প দিয়ে।
কিন্তু ছাত্র আন্দোলন থামে না। এই জেনারেশনটা কেমন যেন, ওয়েস্টার্ন আউটফিট ও হিজাব পরা মেয়েরা একসঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল করে; দাড়ি টুপি-ওয়ালা তরুণের সঙ্গে টি-শার্ট পরা তরুণ সহাস্যে বৈষম্যবিরোধী লড়াই করে। মুসলমান মা রাজপথে নেমে এসে বলে, আমার ছেলেকে আন্দোলনে উৎসাহ দিতে এসেছি; হিন্দু মা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেকে বলে, একদম ভয় পাবি না খোকা! এইভাবে ২০২৪ এর মা আচম্বিতে দেশমাতৃকা হয়ে ওঠে।
এই নতুন সমাজে হিন্দু-মুসলমান কুঁচকুঁচানি করে বিদ্বেষ বেচা লোকগুলো ক্রমশ মিসম্যাচ হয়ে যেতে শুরু করে।
তবুও কেমিক্যাল আলী ফোন করে ললিতাকে সাহস দেয়, এই তরুণেরা ড্রাগড। চিন্তা নেই, আমার পকেটে এত গুলি আছে যে তা ফুরাবে না লক্ষ্মীটি। ললিতা এবার কুমির শোক পালনে বুবুর নির্দেশে প্রোপিক কালো করে।
পলক তার পেপসোডেন্ট ঝলক দিয়ে বলে, ইনফরমেশন সুপারহাইওয়েতে পানি ঢুকে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে।
ফ্রুয়েরার বুবু তবু কোটাল পুত্রদের ডেকে বলে, বল প্রয়োগ করো। রাজপথে দাঁড়াতে দেবে না কাউকে। ভারতের গদি মিডিয়া বুবুকে চাই বুবুকে চাই রেলপথে সমুদ্রবন্দরে বুবুকে চাই গান ধরে। উত্তেজিত অর্ণব গোস্বামীর ছোটো ভাই ময়ূখ স্টুডিওর মধ্যে দিকবিদিক দৌড়ে বলে, বাংলাদেশ মৌলবাদির হাতে পড়ে গেছে; মোদিজি এক্ষুণি কিছু করুন।
ললিতা হঠাৎ ফেসবুকে দেখে বুবুর হেলিকপ্টারে করে পালানোর দৃশ্য। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ে সে। তখনও বিজেপি বিপ্লবীর মেসেজ আসা থামে না, সে লিখেছে ডাকাত ডাকাত, নব্বুই শতাংশ বাড়িতে ডাকাত। কিছুক্ষণ পর সে লিখতে থাকে, সীমান্তে হিন্দুদের ঢল!
ললিতা বুঝতে পারে না কী করবে তখন। ওর হাবি প্রোপিক লাল করে রাজপথে মাথায় পতাকা বেঁধে ঘুরতে শুরু করেছে। এরকম করে শাহবাগেও তরুণ মিছিলে মিশে গিয়েছিল সে। কুইক প্রোটেস্ট কুইক রেন্টালের লোক সে।
ললিতা এরপর ৩২ নম্বর, ১৫ আগস্ট, ভাস্কর্য এই ক্যাচওয়ার্ডগুলো নিয়ে কাজ করতে থাকে। ফেসবুকে লোকজন এসে মন্তব্য করে, শত শত ছাত্রছাত্রীর হত্যাকাণ্ডে টুঁ শব্দ করলেন না; বরং ওদের দুর্বৃত্ত বললেন, আর এখন নৈতিকতা, বিশুদ্ধ দেশপ্রেম নিয়ে লেকচার দিচ্ছেন!
ললিতা তখন তারাপদ রায়ের আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে কবিতা শেয়ার করে মাঝামাঝি জায়গায় আসতে চেষ্টা করে। ছাত্রদের হত্যা করাটা ঠিক হয় নাই আবার ১৫ আগস্ট লুঙ্গি ডান্স দেওয়া ঠিক হয় নাই বলে জাতিসংঘ মহাসচিবের মতো কথা বলতে শুরু করে।
কুইক বিপ্লবী হাবি বুদ্ধি দেয়, ১৫ তারিখ থিকা বুবুর পক্ষে যা লিখছ সব মুইছা দিয়া বরং এই স্বাধীনতা পেলাম বলে কাঁদো ললিতা কাঁদো।
কে একজন এসে জিজ্ঞেস করে, ললিতা তোমার একুশ দিনের ফেসবুক পোস্ট কই গেল গো বান্দুবি!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন