হা হা ইমোর ইতিবৃত্ত

৩১৫ পঠিত ... ১৭:৫৬, অক্টোবর ১৫, ২০২৩

Ha-ha-ha

একবার কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রেঙ্গুনের বন্দরে দেখেন এক ইংরেজ দেশি কুলিদের সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করছে। শরত বাবু গিয়ে ইংরেজ সাহেবকে বলেন, ’আপনি এভাবে চড়-থাপ্পড় দিচ্ছেন কেন! এটা কোন ধরনের সভ্যতা?’ 

ইংরেজ চলে গেলে চড় খাওয়া কুলিটি হাহা করে হাসতে থাকে। শরত বাবু জিজ্ঞেস করেন, ‘হাসেন কেন! আপনাকে না চড় দিয়ে গেলো!’

কুলি তখন শরতবাবুর ওপর ক্ষেপে যায়, ‘চড় দিয়েছে বেশ করেছে; আপনার তাতে কী!’

আরেকবার এক ইংরেজ নদী পার হবার জন্য খেয়া মাঝিকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘ওহে কর্ণধার, আমায় অনুগ্রহ করে নদীটা পার করে দেবে ভাই!’

মাঝি গম্ভীর হয়ে বলে, ‘যাইতে পারুম না। অহন আমি বিশ্রাম লইতেছি।‘

নদীর ধার দিয়ে যাবার পথে ঐ এলাকার সরকার ঘটনাটা দেখে বলেন, ‘ঐ ব্যাটা পার করে দে লোকটাকে! ঢং দেখাচ্ছিস কেন, বসেই তো আছিস!’

মাঝি তখন হাহা হাসি দিয়ে ইংরেজ সাহেবকে নৌকায় করে নদী পার করে দেয়।

রাস্তায় কোন একটি মেয়েকে একা একা যেতে দেখলে, পাড়ার মোড়ের দোকানে বসে গুলতানি মারা বখাটেরা অকারণে হাহা করে হাসতে থাকে। ট্রেনে-বাসে বা যে কোন জায়গায় একজন নারীকে দেখলেই দুনিয়ার সবচেয়ে খাশটে লোকগুলোও রসিক হয়ে ওঠে। কেউ যদি সহজাত রসিক না হয়; হঠাত সে রসিক হতে চেষ্টা করলে; বেখাপ্পা বা স্থূল ভাঁড়ামি করে সে হাসাতে চেষ্টা করে। রস না জমলেও সে হাহা করতে থাকে।

ওদিকে কলেজে মেয়েদের কমনরুমের পাশ  দিয়ে কোন একটি শান্ত প্রকৃতির ছেলে যাবার সময় মেয়েরা সমস্বরে হাহা করে হেসে ওঠে।

আবার ইংলিশ মিডিয়ামের মেয়ে যার স্পোকেন ইংলিশটা আছে কিন্তু ইংলিশের কনটেন্ট নাই; সে কোন একটি বিষয় সংক্রান্ত আলোচনার আগামাথা না বুঝে; হাহা করে হেসে ঘ্যাঁত ঘ্যাঁত করে ককনি দিয়ে আলোচনা পণ্ড করে দেয়।

পড়ালেখায় স্কুলে ফাঁকি দিলে যেটা হয়; পৃথিবীর কোন সাবস্ট্যানশিয়াল আলোচনায় যোগ দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না মানুষের। সেই অক্ষমতাকে অস্বীকার করতে হাহা হাসি সৃষ্টি হয় তার ভেতরে।

ফেসবুকের হাহা হাসিটা কোন কিছু পড়ে ঠিক মতো না বোঝার পর ওপর দিয়ে আসার ওভার স্মার্টনেস বিশেষ। এরপর তা বিভাজিত হয় বিভিন্ন গোত্রীয় হাসিতে।

আওয়ামী লীগ সরকারের কোন সমালোচনা শুনলে সহমত ভাই যেমন হাহা করে হেসে ওঠে। নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা শুনলে হাহা করে হেসে ওঠে যেমন শিবব্রত দাদা। কোন সমালোচনার উত্তর যুক্তি দিয়ে দেবার সক্ষমতা না থাকলে তখন বিকল্প হিসেবে, হাহা হাসিটা এসে যায়।

বিএনপির কোন সমালোচনা শুনে একই কারণে হাসে রহমত ভাই। জামায়াতের সমালোচনা শুনে হাহা করে শরিয়ত ভাই।

অশিক্ষা ও অযৌক্তিক শৈশবের কারণেই ভেতরে প্রচুর হাহা উতপন্ন হয়। ক্লাস টেন পর্যন্ত যে খারাপ ছাত্র থাকে; হাহা ইমোজিটা ঠিক তার জন্য একমাত্র ছদ্মাবরণ যা দিয়ে সে তার বুদ্ধিহীনতা ও সাংস্কৃতিক দৈন্য ঢেকে রাখতে পারে।

আরেকটি হাহা আছে; এটা পশ্চিমে মাস্টার্স ও পিএইচডি স্টুডেন্টদের হাহা। এরা টিশার্ট ও থ্রি কোয়াটার্স শর্টস পরে; গালের মধ্যে চুইংগাম পুরে দিনমান হাহা করে বেড়ায়। বংশে প্রথম শিক্ষিতের শ্লাঘা এটি। নিজেকে তখন সব কিছুর এবাভ মনে হয়। গ্লো ক্রিম মেখে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও মনে হয় নিজেকে। বান্ধবী ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরে চিজ বলে টাইটানিক ফটো তুললে তখন তাকে কেইট উইন্সলেট মনে হয়। এরা তখন কার ইংরেজি উচ্চারণ হচ্ছে আর হচ্ছে না; একাডেমিক জার্নালে কার কয়টা পেপার পাবলিশড হয়েছে; এইগুলি আলোচনা করে হাহা করে। এদের মধ্যে একটা সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট এসে যায়। হাহা হাসিটা তারই প্রকাশ।

যে দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থাকে; সেখানে হাহা হাসিটা প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদার ক্রীতদাসের হাসি দেখে যে হাহা ইমো; ঐটিই একমাত্র কেজো হাহা ইমো।

যেমন ‘প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি অনুষ্ঠানে’-র পুরোটা দেখে একটাই প্রতিক্রিয়া হতে পারে, হাহা। বাতাবি টিভিতে দলান্ধ বুদ্ধিজীবীদের শীতকার দেখে একমাত্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে হাহা। কারণ নৈরাজ্যের জাস্টিফিকেশান ও টাইম মেশিন মেথডে অতীতের ওপর দায় চাপানোর যে সহমতীয় অযৌক্তিক অনুশীলন; তার পেছনে তো যৌক্তিক শব্দ খরচ করে লাভ নাই। সেখানে হাহা'টাই যথেষ্ট।

আমাদের সমাজে ক্ষমতাবানের প্রতি যেরকম তেলাঞ্জলির নহর বয়ে যায়; সেটাকে শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে দেবার জন্য হাহা হাসি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

বুদ্ধিগত নাকি নির্বোধ হাহা তা বিচারের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই যিনি হাসছেন তার। যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে; তা পাঠ করে এরপর বিচার করে দেখতে হবে এখানে হাহা হাসি প্রযোজ্য! নাকি অন্য কোন ইমো।

খুব সিরিয়াস লেখা সেটা যেই লিখুক; তা পড়ে হাহা হাসি পেলে মনের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ জরুরী। কারণ হলিউডের "জোকার" চলচ্চিত্রে দেখা যায়, শৈশবের তিক্ত স্মৃতির কারণে একটি যুবক কান্না পেলে তখন হাহা করে হেসে ওঠে। এটি একটি মেডিকেল কন্ডিশন। একে অবহেলা করা অনুচিত। শরীরের জ্বর হলে যেমন ওষুধ খেতে হয়; মনের জ্বর সারাতেও তেমনি ওষুধ খেতে হয়।

হাসি মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই হাসতে হবে প্রাণখুলে। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন, কম্বোডিয়ার হুনসেন, বেলারুশের লুকাশেংকোকে নিয়ে না হাসাটাই হচ্ছে অপরাধ। হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের পরিচালক সত্যজিত রায় বলেছেন, যখন একজন ফ্যাসিস্টকে তুমি কোনভাবেই  তার গদি থেকে নামাতে পারছো না; থামাতে পারছো না তার অন্যায়; তাকে বিদ্রুপে জর্জরিত করো। তাকে নিয়ে হাসো। সেইক্ষেত্রে হাহা ইমোজির চেয়ে প্রয়োজনীয় ইমো আর হয় না।

৩১৫ পঠিত ... ১৭:৫৬, অক্টোবর ১৫, ২০২৩

Top