টার্নারের বাংলা প্রতিশব্দ কুন্দকার। আরবিতে বলে খররাত। ঢাকায় যারা শিং, দিয়ে জিনিস বানায় তাদের বলা হয় কুন্দকার। এ কাজ করে শুধু মুসলমানরা। এদের আলাদা কোনো শ্রেণি নেই। কসাই কিংবা কুড়িদের সঙ্গে এরা বিয়েশাদি করে না।
গরু-মহিষের শিং আগুনে গরম করে আগে নরম করা হয়। তারপর, ভারি কোনো জিনিসের চাপে সিধে করা হয়। তবে হাতির গজদন্ত আর হরিণের শিং সিবে করাত দিয়ে কেটে প্রয়োজনীয় আকারে আনা হয়। কুন্দকাররা বানায় চিরুনি, ছোটো ছোটো ডিব্বা এবং আরও নানা রকম জিনিস। শিংয়ের কারিগররা ঢাকায় পরিচিত ছিল খুন্দিগর নামে। সম্ভবত ফারসি শব্দ কুন্দিকার থেকে খুন্দিগর শব্দটির উৎপত্তি।
ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলে বাংলায় শিং দিয়ে তৈরি উপকরণের ব্যবসা ছিল রমরমা। ইংরেজ আমলে পুরান ঢাকার লালবাগের আমলিগোলা এলাকায় শিং দিয়ে বোতাম তৈরি করত ঘরে ঘরে। সে সময় বাংলার রফতানি পণ্যের তালিকায় শিংয়ের তৈরি বোতামও ছিল। এই সময়ে বোতামের সঙ্গে যুক্ত হয় শিংয়ের পানপাত্র, ছড়ি এবং ডেকোরেশন পিস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ায় শিং শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় টিকে আছে শিংয়ের শিল্পকর্ম তৈরির ৫০ বছরের পুরানো প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সালমা আক্তার। তবে এটি গড়ে তুলেছিলেন তার স্বামী হুমায়ুন কবির।
আমলিগোলার এক লোক শিং দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করতেন। শিং দিয়ে এটা-সেটা বানিয়ে বিক্রি করতেন বাজারে। হুমায়ুন তার কাছ থেকে শিংজাত পণ্য সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেন। এক সময় শিং দিয়ে পণ্য বানানোর কায়দাও শিখে নেন তিনি। লোকটি মারা গেলে হুমায়ুন নিজেই শিং দিয়ে তৈরি করা শুরু করেন ঘর সাজানোর নানা উপকরণ। হুমায়ুন মারা যাওয়ার পর ব্যবসার হাল ধরেন তার স্ত্রী সালমা আক্তার। ২২ বছর ধরে ব্যবসাটি পরিচালন করছেন তিনি।
শিংয়ের চিরুনি নিয়ে আছে কবিরাজি, এইটা হলো বিয়ের চিরুনি। যে মেয়ের বিয়ে হয় না, সে সাত দিন এই চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে চিরুনিটা পানিতে ফেলে দিলে বিয়ে হয়ে যায়। এ চিরুনির দাম ৫০১ টাকা। বিয়ে না হওয়া মেয়েদের এই চিরুনির খুব কদর ছিল এক সময়। যুগ পালটেছে, মানুষ অনেক বুঝতে শিখেছে, তবুও প্রতিদিনই কিছু না কিছু চিরুনির কাস্টমার আসেন। অবিবাহিত ছেলেদের বেলায় এই চিরুনি কাজ করবে কিনা? জানতে চাইলে অবাক হন সালমা আক্তার। তাই তো, কোনো ছেলে তো আজ পর্যন্ত এই চিরুনি কেনেনি। না, এটা শুধু মেয়েদের জন্য। বলেন তিনি।
আমলিগোলা ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন অংশে মহিষের শিংয়ের চিরুনি ও বোতাম তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছিল সেই সময়। প্রতিদিন এসব জিনিসপত্র আমলিগোলা থেকে চকবাজারে এনে বিক্রি করা হতো।
তথ্যসূত্র: ঢাকার প্রাচীন পেশা ও তার বিবর্তন, ইমরান উজ জামান
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন