প্যালেস্টাইন ট্র্যাজেডিতে একজন ইহুদি তরুণী লেখক, ট্রমা বিশেষজ্ঞ ড গ্যাবর মতে, বৃটিশ সাংসদ স্যার গেরাল্ড কাউফমান-এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিলাম। তাদের যে ডিলেমা; তা আমাকে নিজস্ব স্মৃতির কাছে নিয়ে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর; সিভিল সার্ভিসে আমার এক বড় ভাই আমাকে মন্ত্রী কল্পরঞ্জন চাকমার প্রেস এটাচে করে দেন। উদ্দেশ্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কাজে মন্ত্রীকে সাহায্য করা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ রাখা। আমি জানি বৃটিশেরা ভারতবর্ষ বিভাগের সময় সবচেয়ে কম ভূখণ্ড দিয়ে গেছে আমাদের ভাগে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে তাই কোন এলাকাকে বিশেষ এলাকা করে রাখার বিলাসিতা আমাদের নেই। সবাইকে মিলে মিশে বহুত্ববাদী এক সমাজ রচনা করতে হবে।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন সরকারি গাড়িতে ঘুরতাম, সার্কিট হাউজে থাকতাম, কোথাও আদিবাসীদের মুখোমুখি হতাম; তাদের চোখে আমি ঘৃণা দেখেছি। ফিলিস্তিনিদের চোখে যে ঘৃণা জমা হয়ে থাকে ইজরায়েলিদের জন্য।
ইহুদি ট্রমা বিশেষজ্ঞ তার বর্ণনায় যখন বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাত্র এক বছর বয়সে ক্যানাডায় শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছিলেন; একই বয়সে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ভারতে শরণার্থী হয়েছিলাম। ঐ ইহুদি ডাক্তার অনেক স্বপ্নের স্বাধীন ইজরাইলে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন দেখে "স্বাধীন দেশের স্বপ্ন" উনার মিটে গিয়েছিলো; একই রকমের প্রতিক্রিয়া আমার মনের মধ্যে ঘটে; পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ওপর ঘটা নির্যাতনগুলোর বর্ণনা শুনে।
প্রশ্ন জেগেছে; পৃথিবীর ইতিহাস কী তবে ঠিক এরকম; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকস্টে ৬০ লাখ শহীদের শোক-অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যাওয়া ইহুদিরা কী করে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফিলিস্তিনিদের ওপর "নাকবা" নামের নিষ্ঠুর প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। নাতসির নির্যাতন থেকে তাহলে কী শিখেছে তারা; ফিলিস্তিনিদের জীবনে নাতসির মতো দুঃস্বপ্ন হাজির করা! আমরা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত স্নাত হয়ে; খুনে পাকিস্তানি সেনার মতোই হাজির হয়ে গেলাম পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনে! সভ্যতার এ কোন বিষচক্র।
পাহাড়িরা শান্তিচুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। শান্তিচুক্তির প্রথম বর্ষপূর্তিতে তারা কেউ সরকারি জনসভায় আসেনি। তারা একটি পৃথক প্রতিবাদী মঞ্চ বানালে পুলিশ তা ভেঙ্গে দিয়েছিলো। আমি একটি গাড়িতে বসে যখন এ দৃশ্য দেখছিলাম; তখন আমার মনে ইহুদি তরুণী লেখকের মতোই বেদনা এসেছিলো।
রুমাতে আদিবাসীরা যখন তীর ধনুক ছুঁড়ছিলো, দৌড়ে স্পিড বোটে উঠতে উঠতে মনে হয়েছিলো আমি ইজরাইলের কোন সরকারি কর্মকর্তা ফিলিস্তিনিদের ওপর আধিপত্যের অংশ। পানছড়িতে আদিবাসীরা হামলা করলে সেনাবাহিনী এসে মন্ত্রী ও আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এরপর আমাকে "বিষণ্ণতার শহর"-এর লেখক হিসেবে চেনেন এমন একজন সেনা কর্মকর্তা বলছিলেন, আপনি যে সুযোগ পেলেই আমাদের সমালোচনা করেন; আজ আমরা না থাকলে কে বাঁচাতো আপনাদের।
আমি কখনোই ভেউ ভেউ আবেগে ভাসা লোক নই। শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে সরকারি আলিশান বাংলোতে আসা বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা-কর্মীদের বিলাসিতার প্রতি নেশা দেখে আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম; এরা মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়ানো লোক; এরাও সুযোগ পেলে আধিপত্যবাদী হবে। রোহিঙ্গারা শরণার্থী হবার পর তাদের ওপর যে বিদ্বেষ প্রকাশ করেছে কিছু পাহাড়ি মানুষ; আমি অবাক হয়েছি সভ্যতার এই বিষ-প্রতিক্রিয়া দেখে।
এই যে হিউম্যান সাইকি; আজ যে নির্যাতিত, কাল সে ক্ষমতা পেলে নির্যাতক হবে; এরমধ্যে আমি সভ্যতার দিশা পাই না।
বাংলাদেশে বৃটিশ শাসনের লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী পাওয়া হিন্দু জমিদারেরা নির্যাতক হয়ে উঠেছিলেন। পরে তারা উচ্ছেদ হলে তা নিয়ে অনেক গল্প-চলচ্চিত্র আছে; যাতে অশ্রুসজল হই আমরা; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর গল্প-চলচ্চিত্র দেখে যেমন সারাজীবন কাঁদলাম। মুক্তিযুদ্ধের ওপর গল্প-চলচ্চিত্র দেখে যেমন এখনো কাঁদি। হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন উচ্ছেদ নিয়ে আমি নিয়মিত লেখালেখি করি; ‘নয়ন জলে ভাসি’। কিন্তু ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে যখন হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে সেই নাতসি, পাকিস্তানি খুনেদের মনোভাবের এক্সরে রিপোর্ট দেখলাম; তখন সভ্যতার প্রশ্নে আরো হতাশ হলাম।
আমি তো জীবনকে সাদা-কালোয় দেখি না; নাতসি-পাকিস্তানি খুনে সেনা, ইজরায়েলি খুনে সেনা, ভারতীয় খুনে গোয়েন্দা সংস্থা; এরা তো তাদের জাতির প্রতিনিধিত্বশীল নন। খুনের জাতই হচ্ছে খুনী হওয়া।
যারা এসব বিষাক্ত খুনের নেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মস্তিষ্কের মধ্যে সভ্যতার বিনির্মাণ করে সুখে আছেন; এমন মানুষের সংখ্য নেহাত কম নয়।
আমি নাতসি-ইজরায়েলি-পাকিস্তানি-বাংলাদেশি ও ভারতীয় খুনেদের মাঝে কিছু লোককে চিহ্নিত করে; তাদের পরিবারগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি; প্রকৃতি কী করে নিউটনের তৃতীয় সূত্র প্রয়োগ করে। ঠিক ঠিক মিলে যায় তাদের অসুস্থতা-হাসপাতালের বিছানায় শীর্ণ শরীর, সন্তানদের জীবনে খুনে পুরুষের ঋণ চুকানোর ঘটনাগুলো দেখি। এতে আমি খুশি হইনা। সাবধান হই ও সাবধান করি।
এই যে যারা ফেসবুকে ধর্ম-গোত্র-দল-শ্রেণীর ভিত্তিতে ঘৃণা বিদ্বেষের পসরা সাজিয়ে বসেন; এরা কিন্তু অসুখী মানুষ; এদের ব্যক্তিগত জীবনে ট্র্যাজেডি আছে। প্রত্যেকটি তিক্ত মানুষ আসলে তিক্ততা চর্চার মাঝ দিয়ে জীবনের ট্র্যাজেডিকে আরও ঘণীভূত করে।
আপনি রোমে গিয়ে চেক ইন দিন, ভি আইপি লাউঞ্জে বসে কফি খান, কিংবা মধুমতীর পাড়ে গিয়ে ইলিশ পোলাও রান্না করুন, অথবা ওমরাহ-তীর্থে গিয়ে ভালো ভালো কথা বলুন; আপনার বিদ্বেষের অসুখ যে আপনাকে একমুহূর্ত সুখি হতে দেয় না; সে আমরা জানি।
নিজের কনশানসটাকে ক্লিয়ার রেখে, খুনকে খুন-আধিপত্যবাদকে অন্যায় বলে যারা; এরা হচ্ছে চিন্তার জগতে অগ্রসর মানুষ। আর চিন্তার জগতে যারা অনগ্রসর; তারা চক দিয়ে "আমরা বনাম ওরা" এঁকে নিয়ে অবিমৃষ্য ঘেউ ঘেউ করে।
ইজরায়েল-ফিলিস্তিনি ইস্যুতে কোন খবরের লিংকে ইহুদিদের ওরকম বিদ্বেষের বিষে তেতো মন্তব্য দেখিনি; যেরকম মন্তব্য করেছে গেরুয়াচিল ও হীরক নগরের পোগোতিচিলেরা। পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা মানুষগুলোর প্রশ্বাসের সীমায় আমাদের বসবাস করতে হয়; এই দুর্ভাগ্য ফিলিস্তিনীদের বেদনার চেয়ে কম কিছু নয়।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন