বাংলাদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই যখন বিদূষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ; প্লট-পদক-পদবীর লোভের কাছে সমর্পিত তাদের বিবেক। ক্রসফায়ারের মানবতা বিরোধী অপরাধকে মৌন সমর্থনে ‘একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মতো’ নরভোজি স্বরুপ উন্মোচন করেছেন; মুখমণ্ডল থেকে খসে পড়েছে প্রগতির মেক আপ; অমসৃণ প্রতিক্রিয়াশীলতায় ঝুলে যাওয়া ত্বক-জাঢ্য জরদগব এক ডেড ইন্টেলেকচুয়াল'স সোসাইটি যেন।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে অপ্রাপ্তবয়স্ক খাদিজাতুল কুবরার বিরুদ্ধে হীন উইচহান্টিং-এর কালো মামলা হলে; সরকারি কোটাল পুত্রেরা কুবরার বয়স ১৮ পেরোনোর অপেক্ষা করে করে; ১৭ বছর বয়সে সংঘটিত কথিত অপরাধের অজুহাতে কারাগারে নিক্ষেপ করে সদ্য কৈশোর পেরোনো এই বাংলাদেশ কন্যাটিকে।
ডেইলি স্টারে তার সেই কথিত অপরাধ সম্পর্কে জেনে বিস্মিত হতে হয়। ১৭ বছর বয়সে করোনাকালে একটি ওয়েব শো হোস্ট করেছিল কুবরা। সেই শোতে একজন অতিথি ক্ষমতাসীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। অতিথির সে বক্তব্যে রুষ্ট পুলিশ কুবরার বিরুদ্ধে মামলা করে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে; কে অপরাধী; কে অপরাধী নয়; তা নির্ধারণের ও কথিত অপরাধীকে কারাগারে নিক্ষেপের।
কুবরার দুর্ভাগ্য দৈবচয়নে তার দিকে চোখ পড়েছে কোটাল পুত্রদের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের খুনে সেনাদের দোসরেরা রাজাকার আলবদর আল-শামস যেরকম পাকিস্তানশাহীর সমালোচকদের তালিকা করে খুনে সেনাদের হাতে তুলে দিতো; বাংলাদেশকালে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ‘দেজাভুঁ’ যেন। ফেসবুকে কে কে সরকারের সমালোচনা করছে তার তালিকা করে আওয়ামী লীগ শাহীর খুনে কোটালপুত্রদের হাতে তুলে দেয় তাদের দোসর সিপি গ্যাং, সি আর আই, ছাত্রলীগ-যুবলীগের সদস্যরা।
কুবরা একবছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের কারাগারে রয়েছে। পুলিশ-আদালত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান চলে ক্ষমতাসীনের জঙ্গলের আইনে। সুতরাং কুবরার জামিন হয়নি। তার গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছেন কুবরার বড় বোন। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এই বাংলাদেশ কন্যা তার মা কারাগারে দেখা করতে গেলে বার বার জিজ্ঞেস করে, মা আমার কবে জামিন হবে! মা তাকে কী উত্তর দেবেন! এই জঙ্গলে সন্তানকে এসে সরকারি ভালুক ধরে নিয়ে গেলে; কারাগারে তার ওপর অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চললেও; ক্ষুদ্র প্রজা সেখানে অসহায়!
এইদেশে রাজন্যবর্গ বৃহস্পতিবারে রঙ্গভবনে সুপারি চিবাতে চিবাতে তার পরিবারের ট্র্যাজেডির গল্প এক লাখতমবার বললেও; গল্পের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত প্লট সাংবাদিক, পদক ইতিহাসবিদ, পদবী বুদ্ধিজীবী বিদূষককে অশ্রুসিক্ত হতে হয়; ডুকরে কেঁদে উঠতে পারলে সে কান্নার পুরস্কার আরো বড়।
ভাবখানা এমন যেন, যেন রাজপরিবারের স্বজন হারানোর বেদনাটাই পৃথিবীর একমাত্র বেদনা। বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে গত পনেরো বছরে ক্রসফায়ারে নিহতের কন্যার আর্তনাদ ‘আব্বু তুমি কী কান্না করতেছ’!, কারাগারে পুলিশ হেফাজতে নিহত মুশতাকের স্বজনের কান্না, ৫৭ কালো ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে কারাগারের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত মানুষের কান্না, গুম হয়ে যাওয়া মানুষ আয়নাঘরের বৈদ্যুতিক শকে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে আহাজারি করলে; সেগুলো যেন কোনো বেদনাই নয়। বেদনার গায়ে নৌকা মার্কার ছাপ দেয়া থাকে; বেদনাকে চেটে দিতে হয় চাটার দলের লকলকে জিভে।
ছোট্ট শহর হবিগঞ্জে খাদিজাতুল কুবরার সমবয়েসীরা প্রতিবাদী মানববন্ধন করলে; আমরা দেখতে পাই; বাংলাদেশের অমল কিশোরের হাতে অবাক সূর্যোদয়। এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।
ফেসবুকে এই মানবন্ধনের ছবির নীচে ক্ষমতাসীনের পালতো গ্যাং-গুলো এসে গোবর ছুঁড়ে। কলতলা সৃজন করে। মানববন্ধনের কিশোরীদের পোশাক নিয়ে ঘিন ঘিনে পুঁতি গন্ধময় জেনেটিক জিহবা বিস্তার করে। এই যে সেই থাগস অফ বেঙ্গল; এই তো সেই পেট মোটা ঠগী, বঙ্গবপাঞ্জাবি, পাকিস্তানী পাটোয়ারী পাঞ্জাবীর মতোই রেললাইনের ধারে প্রাতঃক্রিয়া সারা দাদুর নাতিরা; এখন ফেসবুকের মন্তব্যে মন্তব্যের লাইনের ধারে দাদুবিলাস করে।
কিশোর কিশোরীদের ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে’-র সময় এই পেট মোটা ঠগীরা হেলমেট পরে হাতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করেছিল বাংলাদেশ পুত্র-কন্যাদের।
সেই থেকে আমাদের নতুন প্রজন্ম জেনে গেছে, তারা অবরুদ্ধ এক রাক্ষস রাজ্যে। এখানে রাক্ষস-রাক্ষসী উল্লাস করে রঙ্গভবনের পিঠা-পুলির আসরে। এখানে ক্রসফায়ারে একা হাতে আড়াইশো-তিনশো মানুষ খুন করা প্রদীপ ‘পদক’ পেয়েছিল। নেহাত সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা না করলে, আজ চট্টগ্রামে নিশ্চয়ই ‘প্রদীপের ভাতের হোটেল’ থাকত। তীর্থ স্নান সেরে এসে মিডিয়ার সামনে বুক চেতিতে অহংকারী গ্রাম্য ঠোঁট সঞ্চালন করে নিমীলিত চক্ষে বলতো, আমরা শুধু ভাত খাওয়াই না, অস্ত্র উদ্ধারও করি!
অমনি বিদূষকেরা রবীন্দ্র-নজরুল রচনাবলী হাতে ফেসবুকের সংস্কৃতি প্রোপিক নড়িয়ে বলতো, অস্ত্র উদ্ধারে যান প্রদীপ, ডিম দেন আয়নাঘরে।
গোটা ভারতবর্ষে ইংরেজরা কেন সুতানুটি বন্দর বেছে নিয়েছিল! কারণ শ্রীখণ্ডের এই অংশে স্বল্পদামে মীরজাফর, জগতশেঠ, ঘষেটি কিনতে পাওয়া যাওয়া। এইখানে অল্পসংখ্যক খুনে সেনা দিয়ে পরাজিত করা যায় লাখ লাখ মানুষকে!
তাই বলে কী কখনোই মানুষের মুক্তির স্বপ্নকে অবদমিত করা যায়! এইখানে বারবার সূর্যসেন, তিতুমীর, প্রীতিলতা, রুমী, মেহেরুন্নেসা জেগে ওঠে, দ্রোহ করে রাক্ষসের বিরুদ্ধে। এইখানে কারগারে আটকে রাখা ক্ষুদিরাম দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যায় ফাঁসির মঞ্চের দিকে!
মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু তার মুক্তির আকাংক্ষাকে বিনাশ করা যায় না!
প্রীতিলতা কিংবা মেহেরুন্নিসার জাতিস্মর হয়ে এই ব-দ্বীপে জন্ম নেয় কুবরা! অপরাজেয় বাংলা ভাষ্কর্যের নারী মুক্তিযোদ্ধা যেন অমল ধবল পূর্ণিমা রাতে জীবন ফিরে পান। যেন দৃপ্তপায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ান হবিগঞ্জের প্রতিবাদ মিছিলে। রাক্ষসের ভয় উপেক্ষা করে তুলে ধরেন মনুষ্যত্বের প্ল্যাকার্ড, খাদিজাতুল কুবরার মুক্তি চাই!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন