কবি উইলিয়াম ব্লেক লিখেছেন, খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো সত্য উচ্চারণ; মিথ্যার চেয়েও ক্ষতিকর।
একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলায়, আইভি রহমানের রক্তাক্ত শাড়ি পরা শরীর; আমাকে ঘুমাতে দেয়নি অনেক রাত। কারণ এই মানুষটির ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে কয়েকবার দেখা হয়েছে। উনার কাছ থেকে শিষ্টাচার, দেশকে ভালোবাসা, পরমতসহিষ্ণুতার চারুপাঠ পেয়েছি। সেই মানুষটি যখন সেই নাইন ইলেভেনের টুইন টাওয়ার হামলার পর পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে বদলে যাওয়া স্বদেশে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের গ্রেনেডের আঘাতে নিহত হলেন; তখন সেই বেদনার ভার বহন করা সত্যিই কঠিন।
স্টয়িক দর্শনে বলা হয়েছে, রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে রাক্ষস হয়ে গেলে; মানবতার পতন ঘটে। আমার চেয়ে আইভি রহমানের মৃত্যুতে বেশি বেদনাক্রান্ত হয়েছিলেন যিনি, তার ছেলে মি পাপনের মধ্যে কোনো প্রতিশোধস্পৃহা না দেখে; কিংবা রাজীব গান্ধী হত্যার আসামীকে ক্ষমা করে দিয়ে তাঁর ছেলে মেয়ে রাহুল ও প্রিয়াংকাকে মহৎ হতে দেখে; সভ্যতার আশা জাগে। এই পৃথিবী পুরোটাই এখনও চোখে বদলে চোখ নেয়া রাক্ষসের অধিকারে চলে যায়নি।
কিন্তু বাংলাদেশটা রাক্ষসের অধিকারে চলে গেছে। একুশে অগাস্টের জামায়াত-বিএনপি রাক্ষসের প্রতিশোধ নিতে নিতে আওয়ামী লীগের রাক্ষস হয়ে ওঠা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
নাট্যকার সেলিম আল দীন তার ‘হরগজ’ নাটকে টর্নেডোতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া গ্রামে মৃতের সারি দেখে বিলাপ করেছিলেন, এ কোন সর্বনাশা মৃতদেহের অংক কষা!
বাংলাদেশ প্রতিশোধ স্পৃহায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া হরগজ যেন। পনেরো অগাস্টে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড আর একুশে অগাস্টে শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা; এই দুই দানবীয় আঘাতের প্রতিশোধ নিতে নিতে নিতে, লীগের কোটালপুত্র ‘প্রদীপ’ একা হাতে ক্রসফায়ারে দুই-তিনশ মানুষ মেরে ফেলা; কাউন্সিলর একরামের ক্রসফায়ারের অডিও টেপ হাওয়ায় ভেসে ভেসে প্রতিশোধের বুলেট আর একরাম কন্যার, আব্বু তুমি কী কান্না করতেছোর বিষাদসিন্ধু, গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীর কন্যাশিশু প্রেসক্লাবের সামনে বসে অশ্রুসিক্ত চোখে হারিয়ে যাওয়া পিতার ফিরে আসার অপেক্ষা করা; পুলিশ ও এলিট ফোর্স প্রধানের আরও হত্যার হুংকার, গোয়েন্দা সংস্থার আরও নরমাংসের লোভ; ফেসবুকে প্রতিশোধের গ্লাডিয়েটরে আওয়ামী লীগ ও বিজেপি কর্মীদের সোল্লাস আকুতি, আসামীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যাও। দাড়ি-টুপি থাকলেই তাকে জঙ্গী তকমা দিয়ে ফেসবুকে প্রকাশ্যে মোদীর নির্বাচনী প্রচারণা করা গেরুয়াভক্তের ‘জঙ্গী বিরোধী অভিযানে চলো’ ; এইসব অহোরাত্র রাক্ষসের উল্লাসের মৃত্যু উপত্যকাই বাংলাদেশ।
দেশের মালিক সেজে আওয়ামী লীগের নানা ফন্দি ফিকিরে সরকারি চাকরিগুলো খেয়ে দেয়ার অভিলাষটিতে বাগড়া দেয়া ঐ কোটা সংস্কার আন্দোলনের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সন্তানের প্রতিবাদ ভেঙ্গে দিতে ‘রাজাকার’ তকমা দিয়ে পুলিশ ও সশস্ত্র ছাত্রলীগ লেলিয়ে দেয়া; নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শিশু-কিশোর-কিশোরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পেটমোটা যুবলীগের ঠগীর হেলমেট পরে হাতুড়ি দিয়ে রক্তাক্ত করা বাংলাদেশের অমল কিশোরের হাতে ‘অবাক সূর্যোদয়’; যে সূর্যোদয় ফিস ফিস করে বলে, আমরা চিনে গেছি মায়াদয়াহীন ফ্যাসিস্ট সরকারকে!
কেবল ব্যাংক খেকোদের নিয়ে কার্টুন আঁকার অপরাধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের দড়ি পরিইয়ে ’আয়না ঘরে’ নিয়ে যাওয়া কার্টুনিস্ট কিশোর গোয়েন্দা নির্যাতনের আঘাতে আজও কানে শুনতে পায় না। কেবল স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করায় লেখক মুশতাককে ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালানোর পর পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু; আর কত রক্ত তৃষ্ণা মিটলে ‘পনেরো অগাস্ট ও একুশে অগাস্টে’-র হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ নেয়া শেষ হবে! কোথায় থামবে এই স্বদেশী উপনিবেশের ‘হারকিউলিসে’-র হননযজ্ঞ।
যারা টেলিভিশনে আওয়ামী লীগের শাসনামলে হত্যা-গুম-নির্যাতনের জাস্টিফিকেশন দিয়েছে; পনেরো অগাস্ট, একুশে অগাস্টের স্থির চিত্র ও ফুটেজ দেখিয়ে দেখিয়ে; তারা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ভঙ্গিতেই যখন গত পনেরো বছর ধরে একবিংশের মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রত্যক্ষ সহযোগী হয়ে উঠলেন; বিনিময়ে কিছু প্লট পদক পদবী প্রকল্প, গণভবনের পিঠাপুলির আসলে ক্ষমতার সঙ্গে সেলফি; কিংবা চাটার্ড বিমানে করে চাটার দল হবার সৌভাগ্য অর্জন! কিন্তু এতে সত্যের কী কোন এদিক ওদিক হলো। মীরজাফর-জগতশেঠ-ঘষেটি বেগম-গোলাম আজম-নিজামী-সাঈদি-খন্দকার মুশতাক ইত্যাদি কোলাবরেটরের সঙ্গে কিছুমাত্র পার্থক্য কী রইলো সমকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় বিদূষকদের!
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার ‘কোয়ালিশন ইয়ারস’ আত্মজৈবনিকে ওয়ান ইলেভেনের সেনা শাসক জেনারেল মইন উকে দিল্লিতে ডেকে ঘোড়ায় চড়ে সেইফ এক্সিটের বিনিময়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো-র প্রামাণিক সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে গেলে; বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন, প্রথমে ভারতকে বাংলাদেশের স্বামী বলে ডেকে ও পরে ‘আমি ভারতে গিয়ে বলে এসেছি শেখ হাসিনাকে যে করেই হোক ক্ষমতায় রাখতে হবে’ জাতীয় স্বীকারোক্তি করলে; এটা দেশের সাধারণ মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়; ১৯৭১ সালে পাকিস্তান উপনিবেশের ভূত তাড়িয়ে ভারতীয় উপনিবেশের ভূতের রাজার বর নিয়েই বাংলাদেশের মসনদে বসতে হয়।
আওয়ামী লীগের নেতারা দিল্লিতে গিয়ে বিজেপি দপ্তরে বৈঠক করে ঘোষণা করলেন, আওয়ামী লীগ-বিজেপি (হিন্দুত্ববাদী) একসঙ্গে কাজ করবে। ঠিক সেই বিএনপি-জামাত (ইসলামপন্থী) জোটের মতো ব্যাপার। কট্টরপন্থা তা হিন্দু ধর্ম ব্যবহার করে হোক কিংবা ইসলাম ধর্ম ব্যবহার করে হোক; গণতান্ত্রিক উদারনৈতিক সমাজের জন্য তা একই রকম অশনি সংকেত।
গুজরাটের কসাই নামে গোটা বিশ্ব মিডিয়ায় পরিচিত মোদীজী ভারতের অভ্যন্তরে কলকাতায় গেলেও ছাত্র-ছাত্রীরা এর প্রতিবাদে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করে। কিন্তু বিজেপি সাহস পায়না তাদের গায়ে হাত তুলতে। অথচ মোদীর ঢাকা সফরের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ করলে, বিজেপির রাখি হাতে বেঁধে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের পেটায়। কুমিল্লায় প্রতিবাদী মাদ্রাসার কিশোরের ওপর গুলি চালিয়ে কমপক্ষে ১৭ জনকে হত্যা করে বাংলাদেশের পুলিশ।
অথচ স্বাধীনতার পরে জাতির জনক প্রশাসন ও পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, মনে রেখো এদেশের মানুষ তোমার ভাই কিংবা পরিবারের সদস্য। তাদের সঙ্গে আচরণে ঔপনিবেশিক প্রভুর মতো আচরণ করোনা। মনে রেখো ওদের টাকায় তোমাদের বেতন হয়।
শিয়াদের প্রতিবছর শোক পালনের মতো করে বছরের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে কিছু ফাইল ফটো দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকের যে শোকের কান্না; এই কান্না আর সেই ২০০৮ সাল পর্যন্ত যেভাবে সাধারণ মানুষকে আচ্ছন্ন করতো; আলোড়িত করতো; আর তা করেনা; অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই।
কারণ পাহাড়ের ঢালে জ্যোতস্না রাতে চন্দ্রাহত রাক্ষসের কান্না কিংবা ‘অরিজিন্যাল সিনে’ নরভোজির কান্নাকে নেহাত কুমিরের অশ্রুপাতের মতোই দেখায়। ঐ যে সর্বনাশা লাশের অংক কষে; কেবল দলীয় লাশের জন্য কান্না আর ভিন্নমতের লাশের জন্য উল্লাস; এই পুনরাবৃত্তিকর শঠতায় বেরিয়ে গেছে হিংস্র দাঁত; যে দাঁতে সজীব হয়েছে মহাশ্মশান।
বিভিন্ন দিবসে শোকের কান্না দেখে, লেডি ম্যাকবেথের রক্তমাখা হাত ধোয়ার চিত্রকল্পই যেন মনে আসে। অনাদিকাল ধরে ‘ভিক্টিম কার্ড প্লে’ করে কী আর লুকিয়ে ফেলা যায়, ক্রসফায়ার-গুম-ডিএসএ-এর রুমালের ফাঁস-হেলমেট-হাতুড়ি-শটগানের নৃশংসতা আর জনমানুষের ভোটের অধিকার খেয়ে ফেলার নরভোজী যুগ।
আইভী রহমানের মৃত্যু শোক কেবল তাকে মানায়; যে লাশের গায়ে দলের বা ধর্মের বা গোত্রের জার্সি পরায় না; যে পরম ভালোবাসায় ও মমতায় মানুষের মৃত্যুতে নীরবে অশ্রুপাত করে; বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য নিভৃতে প্রার্থনা করে।
'The unfortunate one, who only has to be commanded to every meal by Alexander.'--Diogenes.
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন