মুসোলিনির রাজ্যে বাইসাইকেল থিভস

১৯১ পঠিত ... ১৬:৫২, এপ্রিল ২৬, ২০২৩

Musolinir-rajje (1)

বেনিতো মুসোলিনি ছিলেন ইতালির বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিজমের জনক। আগের সব সাম্যমুখী সমাজে-রাজনীতির অচল চিন্তাকে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন; বৈপ্লবিক এক উন্নয়ন চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে। ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুসোলিনির সমর্থক ফ্যাসিজম চেতনায় উদ্দীপ্ত তরুণেরা রোমের রাস্তায় মিছিল করে সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯২২ সালে তাকে ক্ষমতায় আনে।

1

ইতালির এক জনসভায় বক্তৃতার সময় বেনিতো মুসোলিনি

মুসোলিনি শ্রেণী সংগ্রাম আর সাম্যবাদ অপছন্দ করতেন। একসময় সমাজতন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন সমাজবাদী দলের পত্রিকা আভান্তির সাংবাদিকও। কিন্তু সমাজবাদী দল তাকে বহিষ্কার করেছিলো; তার নতুন জাতীয়তাবাদী চিন্তা 'ফ্যাসিজম'-এর কারণে।

১৯১৯ সালে তিনি ফ্যাসিজমের ধারণার মাধ্যমে গড়ে তোলেন মুসোলিনি ভক্ত সংহতি। তার এই প্রখর জাতীয়তাবাদ রাজনীতি বিরোধী দল পছন্দ করে না। সম্পদের ওপর সবার সমান অধিকার স্বীকার করে না। কেবল যারা ফ্যাসিজমের পক্ষের লোক তারা থাকবে সমাজের উঁচু তলায়; আর জনগণ থাকবে অনুগত কর্মী হিসেবে; আর শীর্ষ নেতৃত্বের সর্বময় কতৃত্ব উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করতেন ফ্যাসিজমের সমর্থকেরা।

মুসোলিনি একই সংগে ছয়-সাতটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজ হাতে রেখেছিলেন। তিনি চোখ ধাঁধানো উন্নয়নে বিশ্বাস রাখতেন। সি প্লেন, প্রমোদতরী দিয়ে ভড়কে দিয়েছিলেন মানুষকে। রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ; রেল যোগাযোগের উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মুসোলিনির মিডিয়া বলতো, আপনি মুসোলিনিকে স্বৈরাচার বলুন আর যাই বলুন; মুসোলিনির ট্রেন ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে।2

ইতালির বলোনিয়া শহরের জনসভায়, ১৯৩৪ সালে

মুসোলিনি সবচেয়ে বেশি আদর করতেন পত্রিকার সম্পাদকদের; সংস্কৃতি কর্মীদের আর ক্রীড়াবিদদের। পত্রিকাগুলোর ট্রেড ইউনিয়ন তুলে দিয়ে; সরকারি প্রণোদনায় সমবায় মডেলে মিডিয়া হয়ে ওঠে মুসোলিনির ভালোবাসার যৌথ খামার। 

অপেরা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক জোট আর ক্রীড়াবিদ জোট মুসোলিনির অত্যন্ত ভক্ত হয়ে ওঠেন। মুসোলিনি নিজেই উপস্থিত থাকতেন অপেরা থিয়েটারে কিংবা স্টেডিয়ামে। মাঝে মাঝে দুকলি গানও শুনিয়ে দিতে পারতেন ভক্তদের।

মুসোলিনি ক্যাথোলিক চার্চেরও মন জয় করেছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে সাম্যচিন্তার লোকেদের যে বিরোধ; মুসোলিনি তার অবসান ঘটান ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের মন জয় করে। ভ্যাটিক্যান সিটি তৈরির পবিত্র দায়িত্ব তিনি পালন করে ঈশ্বরের আশীর্বাদের বরপুত্র হয়ে ওঠেন।

উন্নয়নের প্রয়োজনে নানারকম আইন সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে ও মুসোলিনি মডেলের প্রেস ফ্রিডম উপহার দিয়ে একদলীয় শাসন গড়তে হয় তাকে। উন্নয়ন বিরোধীদের শায়েস্তা করতে তার বিশেষ পোশাকের ওভরা নামের দেশপ্রেমিক গোপন পুলিশেরা  বাধ্য হয়েছিলো বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড ঘটাতে। দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে আগাছা পরিষ্কার তো করতেই হয়। অভিমত ছিলো উন্নয়নের পক্ষের মানুষদের।

মুসোলিনির ফ্যাসিজমের আদর্শে উজ্জীবিতরা দ্রুতই ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে সম্ভ্রান্ত সমাজ তৈরি করে। রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ হয়ে ওঠে উজ্জ্বলতর।

সেসময় কী খেলার স্টেডিয়ামে; কী অপেরার আসরে; কী পারসোনাল ল্যাপ ডান্সের আসরে; ফ্যাসিজমের এলিটেরা থাকতো সর্বদা হাসিখুশী। তাদের সুন্দর পোশাক, নধর শরীর, চকচকে গাল দেখে মনে হতো এরা নিটশের সেই অভিজাত রক্তের মানুষ; যাদের ঈশ্বর জন্ম দিয়েছেন নেতৃত্ব দেবার জন্য।

বিলাসী গাড়ী হাঁকিয়ে এরা যখন শহরের মাঝ দিয়ে যেতো; তখন বাস স্টপে দাঁড়ানো নীল কলারওয়ালা মানুষের সারি; কিংবা বাইসাইকেলে ছুটে চলা বরফ বৃষ্টিতে জড়োসড়ো ছোট খাট মানুষেরা লুকিয়ে সেই ফ্যাসিজমের উজ্জ্বল পুরুষদের দেখে বুঝতো; ঈশ্বর কিছু মানুষকে হোয়াইট কলার হিসেবে জন্ম দেয়।

3

ফেল্ডম্যান বার্তা, মুসোলিনির নৃশংসতার শিকারের অন্যতম। ১৯৪০ সালে মধ্য ইতালির ল্যান্সিয়ানো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় তোলা ছবি

এই সাদা রংটির প্রতি নিটশের বরপুত্রদের খুব আকর্ষণ ছিলো। তাদের স্ত্রীরা সাদা হাইহিল জুতো, সাদা ব্যাগ, সাদা নেকলেস এমনকি সাদা রং-এর টেলিফোন ব্যবহার করতো। সেই সাথে সফল পুরুষদের বাড়তি বান্ধবীরাও সাদা হ্যাট পরে সমুদ্রবিলাসে যেতো। সফল পুরুষদের সঙ্গে বাড়তি বন্ধুত্ব জনপ্রিয় হওয়ায় রোমের অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠে আনন্দ নারীদের ময়ুর প্রাসাদ।

সে সময়ের চলচ্চিত্রজুড়ে থাকতো কেবল সফল মানুষের গল্প। গ্ল্যামারাস এসব হোয়াইট টেলিফোন চলচ্চিত্র দেখে ঘর্মাক্ত নীল কলারের মানুষেরা ফ্যান্টাসির জগতে চলে যেতো; তারা কল্পনা করতো মুসোলিনি নামের ঈশ্বরের; যে ব্যাপ্টিজম করে মানুষকে নীল কলার থেকে সাদাকলার পরিয়ে দিতে পারে।

মিডিয়ায়; অপেরায়; ক্রীড়াঙ্গনে সর্বত্র ছিলো মুসোলিনির প্রতি মুগ্ধতার ভীষণ উল্লাস। জাতির আশা-আকাংক্ষার প্রতীক এক অলৌকিক মহানায়ক হয়ে ওঠেন তিনি।

তার সামরিক যুদ্ধ জয়ের গল্প আজ আর নাই বা বললাম।

১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির স্বপ্নের নায়ক মুসোলিনি দেশ শাসন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাতসিবাদের জনক হিটলারকে সমর্থন করে; যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সের অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে ক্রমাগত রণহুংকার দিয়ে; যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন ইতালির নয়নের মণি মুসোলিনি। কিন্তু নানা ফ্রন্টে হিটলারের পরাজয় আর  সবশেষে যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স সিসিলি দ্বীপ আক্রমণ করলে; মুসোলিনির জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার গড়া গ্র্যান্ড ফ্যাসিজম কাউন্সিল এই একনায়কের ওপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে। তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান।

4

১৯৪৩ সালের ২৫ জুলাই, সাধারণ ইতালিয়রা মুসোলিনির ভাস্কর্য ভেঙে ফ্যাসিজমের পতনের উল্লাস করছে

এইভাবে ইতালির উন্নয়নের শত্রুরা যারা সবসময় ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত করেছে; বিদেশী প্রভুর কাছে ধর্ণা দিয়েছে মুসোলিনিকে উৎখাত করার জন্য; সেই সুশীল-কুচক্রী সমাজবাদীদের অশুভ আঁতাতে মুসোলিনির উন্নয়নের সোনার সংসার তছনছ হয়ে যায়। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সুইজারল্যান্ডে যাবার পথে উন্নয়নের শত্রুর হাতে প্রাণ হারান এই প্রবাদপ্রতিম একনায়ক।

 

বাইসাইকেল থিভস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালিতে মুসোলিনির রেখে যাওয়া সমাজে বাস করে; রিচ্চি নামের এক নীল কলারওয়ালা যুবক; যে তার স্ত্রী মারিয়া; ছেলে কিশোর ব্রুনো আর একটি নবজাত সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে একটি বাইসাইকেল বন্ধক রেখেছিলো।

5

প্রতিদিন সে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের সামনে গিয়ে চাকরির খোঁজে বসে থাকতো যদি তার ডাক পড়ে। একদিন ডাক পড়ে ঠিকই; চাকরির পূর্বশর্ত একটি সাইকেল থাকতে হবে; কারণ সে পেয়েছে বিজ্ঞাপনী পোস্টার লাগানোর কাজ।

মারিয়া বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দিশেহারা। তাই সে এক আধ্যাত্মিক নারীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। সে মানত করেছিলো স্বামীর চাকরির জন্য।

রিচ্চি এসে নতুন চাকরির খবর দিলে মারিয়া খুব খুশি হয়; কিন্তু এই চাকরিতে সাইকেল লাগবে শুনে বিক্ষুব্ধ হয়, কেন সাইকেল বন্ধক রেখেছিলে! এরপর বিয়ের সময় মায়ের বাড়ি থেকে আনা বেডশিটগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে যায় বন্ধক দিতে। বন্ধকী কারবারি চাদরের বিনিময়ে যে লিরা (ইতালীয় মুদ্রা) দেয়; তা সুদসহ দিয়ে সেখান থেকে সাইকেল ছাড়িয়ে নেয়। দেখতে পায় তাদের বন্ধক রাখা চাদরগুলো রোমের ভাগ্যহত মানুষের জমা রাখা সারি সারি চাদর রাখার শেলফের সব উঁচুতে ঠাঁই পেলো। বন্ধকী কারবারির আড়তে অসংখ্য মানুষ তার পছন্দের জিনিস বন্ধক রাখতে এসেছে।

ফেরার পথে মারিয়া সেই আধ্যাত্মিক নারীর আস্তানায় যায়। রিচ্চি তাকে জোর করে ফিরিয়ে আনে; সে এসব তুকতাক-কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না । তুকতাকের আসরে অসংখ্য নিয়তিবাদী অসহায় মানুষের ভিড়। আধ্যাত্মিক নারী হাত তুলে শুধু বলে, ‘গড আমাকে আলো দাও যেন দেখতে পাই।'

পরদিন খুব ভোরবেলা ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়ে রিচ্চি। মাসে মাসে বাঁধা বেতনের নিশ্চয়তা; ওভারটাইমের বাড়তি উপার্জনের হাতছানি; রিচ্চি আর মারিয়ার অনেক দিনের হারিয়ে ফেলা স্বপ্ন আর রোমান্টিসিজম যেন ফিরিয়ে দেয়। পাখি ডাকা ভোরে উঠে, স্বামী আর ছেলের জন্য ডিমের স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়।

6

ছেলে ব্রুনো একটি পেট্রোলপাম্পে কাজ করে। তাকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে অফিস থেকে মই সংগ্রহ করে সিনেমার পোস্টার লাগাতে যায়। সে যখন পোস্টার লাগাতে উঁচু মইয়ে ওঠে; তখন এক বাইসাইকেল চোর এসে সাইকেল চালিয়ে চলে যায়; চোরের সহযোগী রিচ্চিকে ঐদিকে গেছে বলে ভুল দিকে নিয়ে যায়। মুসোলিনির রাজ্যে চোরের সংঘবদ্ধ চক্র বেশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে চুরি করে।

পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ রিচ্চিকে পাত্তা দেয় না; একটা সাইকেল খুঁজতে পুরো টিম লাগানো কী সম্ভব বলে ধমক দিয়ে ফেরত পাঠায় রিচ্চিকে। মুসোলিনির রেখে যাওয়া রাজকীয় পুলিশ এসব নীল কলারের আর্তনাদ শুনবে কেন!

শ্রমিকদের পার্টি অফিসে রিচ্চি যায় এক বন্ধুর খোঁজে। মারিয়াও সেখানে আসে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে। বন্ধু একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। তাকে সাইকেল চুরির কথা জানালে সে পরদিন লোকজন নিয়ে চোরাই সাইকেল বিক্রির বাজারে যাবার আশ্বাস দেয়।

7

অসহায় রিচ্চি সেই আধ্যাত্মিক বৃদ্ধার আস্তানায় যায়; অসহায়ত্ব মানুষকে কুসংস্কারের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে দেয় বলেই হয়তো। জানতে চায়, তিনি কী বলতে পারবেন; বাইসাইকেল চোরটি কোথায়? বৃদ্ধা বলে, খোঁজো, পেতেও পারো; আবার নাও পেতে পারো। নজরানার কিছু লিরা দিয়ে রিচ্চি বেরিয়ে পড়ে।

বন্ধু আর তার লোকজন নিয়ে চোরাই বাজারে  অনেক খোঁজাখুঁজি করে সাইকেল না পেয়ে; বন্ধুকে সেখানে রেখে রিচ্চি আরেক চোরাই বাজারে সাইকেল খুঁজতে যায়। সঙ্গে ব্রুনো ছায়ার মতো। সেখানেই দূর থেকে দেখে তার  সাইকেল নিয়ে সেই চোর এক অশীতিপর বুড়োর সঙ্গে কথা বলছে। রিচ্চি চোর চোর বলে তেড়ে গেলে; চোরটি আবার সাইকেল চালিয়ে হাওয়া হয়ে যায়।

পরে ওই বুড়োকে অনুসরণ করে একটি চার্চে পৌঁছে যায় রিচ্চি। সাইকেল উদ্ধার অভিযানে ব্রুনো তার বাবার সঙ্গে প্রাণপণ চেষ্টায় অক্লান্ত। চার্চে তিল ধারণের জায়গা নেই। সেখানে হৃদয় শুদ্ধ করে তবে পৃথিবী ছাড়ার আদর্শের বয়ান করছে। চোরের সহযোগী বুড়োটির পাশে বসে রিচ্চি তাকে চেপে ধরে। বুড়োটি অগত্যা সাইকেল চোরের বাড়ির ঠিকানা দেয়। সঙ্গে যেতে বললে বুড়োটি চোখে ধূলো দিয়ে সটকে পড়ে।

বাপ-ছেলে চার্চ থেকে বেরিয়ে বুড়োটিকে আর খুঁজে পায় না। হতাশ রিচ্চি ব্রুনোকে চড় বসিয়ে দেয়। ব্রুনো প্রতিবাদ করে। ভয় দেখায়, মাকে বলে দেবে যে বাবা তার গায়ে হাত তুলেছে। রিচ্চি জিজ্ঞেস করে ক্ষিদে পেয়েছে; পিৎজা খাবে কিনা! ব্রুনো ‘হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়ায়। রিচি দেখে নেয় পকেটে কয় টাকা আছে। তারপর বলে, মরতে যখন হবেই একসময়; চলো আজ একটু আনন্দে বাঁচি।

8

রেস্টুরেন্টে কাতর চেহারার চোখ জুলজুলে একটা লোক গান গেয়ে সবাইকে বিনোদন দিচ্ছে। বাজনা বাজাচ্ছে শীর্ণ শরীরের বাজিয়েরা। খাবার টেবিলে ব্রুনো বসে দেখে দূরের টেবিলে একটা ধনী পরিবারের বাচ্চা খাচ্ছে। সেই টেবিলে রাশি রাশি খাবার। মুসোলিনির ব্যাপ্টিজমে সাদাকলার পরিবারটির শিশুর সঙ্গে বারবার চোখাচোখি হয় ব্রুনোর। পাশাপাশি দুটি টেবিলে দুই ইতালি যেন।  

রিচ্চি ওয়াইন আর খাবার অর্ডার দেয়। খাবার এলে বাপ বেটা খায়। ব্রুনোকে ওয়াইন খেতে দিয়ে রিচ্চি হেসে বলে, তোমার মা যদি এই দৃশ্য দেখতো! তারপর আকণ্ঠ ওয়াইন পান করে রিচ্চি বলে, ‘পৃথিবীতে সব সমস্যাকে জয় করা যায়; শুধু মৃত্যু ছাড়া। যদি চাকরিটা করতে পারতাম তাহলে বেতন ওভার টাইম মিলিয়ে কতো উপার্জন হতো জানো!’ ব্রুনোকে পেন্সিল এগিয়ে দেয়, টিস্যু পেপারের ওপর তার ‘মানি ইন হোপে’র হিসাব করার জন্য। ব্রুনোকে বারবার সেই উৎসবমুখর দূরের টেবিলের দিকে তাকাতে দেখে রিচ্চি বলে, ওরকম খাবার খেতে গেলে মাসে এক লাখ লিরা কামাতে হয়। 

পরদিন চোরের ঠিকানায় তাকে খুঁজতে যাবার পথে বাইসাইকেল চোরকে হঠাৎ দেখে তেড়ে যায় রিচ্চি। চোর দৌড়ে গিয়ে ঢোকে আনন্দপসারিনীদের লালবাতি গৃহে। রিচ্চি সেখানে গিয়ে দেখে সেখানে সখি পরিবেষ্টিত হয়ে আছে চোর। সখিরা বাধা দিলেও রিচ্চি তাকে বাইরে নিয়ে আসে। সাইকেল চোরের মহল্লার লোকেরা এগিয়ে আসে; ঘন হয়ে আসে চোরের সমর্থনে; বাড়ির জানালা খুলে চোরের মা চেঁচায়, আমার ছেলের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। মহল্লার সানগ্লাস পরা বড় ভাই; তাদের সহমত ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেখে বাইসাইকেল চোর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে কাতরানোর অভিনয় করতে থাকে। সানগ্লাস পরা বড় ভাই ও সহমত ভাইয়েরা রিচ্চিকে চ্যালেঞ্জ করে, ‘আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে; অযথা ভালো ছেলেটাকে চোর বলে মানহানি করছেন। ভয় দেখায়, আপনি মানহানি মামলায় পড়ে যাবেন তো!’

ব্রুনো দৌড়ে গিয়ে এক পুলিশকে ডেকে নিয়ে আসে, পুলিশ জিজ্ঞেস করে একই কথা; ‘আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে যে সে চোর!’

পুলিশ আইনের শাসন উপহার দিতে রিচ্চিকে চোরের বাড়িতে যায় তল্লাশী করতে। চোরের মা বলে, ‘তার ছেলে নিষ্পাপ-নিষ্কলুষ।' ঘরে চোরাই টায়ারের দিকে রিচ্চি তাকালে; চোরের মা বড় গলা করে বলে, ছেলেটার গাড়ি ছিলো আগে। পারলে তাকে চাকরি দিয়ে সহযোগিতা করুন। চোরের মাকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে পুলিশ শুরু করে তার ছক, চোরকে কী পেছন থেকে ঠিক দেখতে পেয়েছিলেন; কী করে বুঝলেন যে এই চোরই সেই চোর; প্রমাণ ছাড়া কথা বললে কী হবে বোঝেন তো! নীচে মহল্লার লোকের ভিড় দেখেছেন; আপনি তো উলটো কেসে পড়ে যাবেন মিথ্যা অপবাদ দেবার অভিযোগে।

 চোরের বাড়ি থেকে বের হবার মুহূর্তে রিচ্চি লক্ষ করে; চোরের বোন কোনো দোকান থেকে বেশ কিছু সৌখিন সামগ্রী চুরি করে এনে; আগে চুরি করা ছোট্ট পাহাড়ের ওপর ঢেলে দিলো। বাইরে অপেক্ষমান চোরের খনি বিজয়ের উল্লাসে রিচ্চিকে খাট্টাতামাশা করতে শুরু করে। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা পুলিশ রিচ্চিকে চলে যাবার পরামর্শ রাখে। ব্রুনোকে ডেকে নিয়ে রিচ্চি চোরের মহল্লা থেকে বের হবার সময় চোরেরা শিয়াল পালের মতো হুক্কা হুয়া করতে থাকে, ‘আর জানি তরে এই মহল্লায় না দেখি।'

9

একটু এগিয়ে এসে বিশাল স্টেডিয়ামের সামনে ক্লান্ত হয়ে ব্রুনো রাস্তার ফুটপাথে বসে পড়ে। স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা হচ্ছে। দর্শকের গগন বিদারী উল্লাস। স্টেডিয়ামের সামনে সারি সারি সাইকেল। রিচ্চির সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত; একটি সাইকেলহীন জীবন মানেই বেকারত্বের আঁধার-সমুদ্রে পুরো সংসার নিয়ে ডুবে মরা। পাশের নির্জন গলিতে একটি নিঃসঙ্গ সাইকেলের দিকে বার বার তাকায় দ্বিধান্বিত রিচ্চি; যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কয়েকবার পায়চারী করে চকিতে কী যেন ভেবে ব্রুনোকে টাকা দিয়ে বলে, ‘তুমি বাসে চড়ে গিয়ে একটু দূরে নেমে আমার জন্য অপেক্ষা করো!’ ব্রুনো বিস্ফারিত চোখে তাকায়; বাবার ধমক শুনে বাসে উঠতে গিয়েও ভীড়ের কারণে উঠতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে।

সে চেয়ে চেয়ে দেখে বাবা একটা সাইকেলে চড়ে দ্রুত চলে যাবার চেষ্টা করছে! আর লোকজন চোর চোর বলে তাকে ধাওয়া করছে। একসময় সাইকেল থেকে পড়ে যায় বাবা। গণপিটুনী চলতে থাকে। ব্রুনো গিয়ে বাবার কোটের একপাশে ধরে বাবা বাবা আর্তনাদে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। সে অশ্রুধারা যেন রুমাল দিয়ে মুছেও শেষ করতে পারে না ব্রুনো; কী হচ্ছে কী হবে অজানা আশংকায় ছোট্ট বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে। তার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে যায় হাতে নাতে চোর ধরার উল্লাসে।

উপস্থিত জনতা বাইসাইকেল থিফ বাবাকে পুলিশে দেবার পরামর্শ দেয়। সাইকেলের হৃদয়বান মালিক ‘এক দেবশিশু আর তার উপায়হীন বাবা’র অসহায়ত্ব যেন খানিকটা আঁচ করতে পারে। সে বলে, ‘আমি ঝামেলা বাড়াতে চাই না; সাইকেল ফেরত পেয়েছি এই বেশ।'

10
গ্লানির আলো আঁধারীতে বাবার সংগে অনিশ্চয়তার পথে হাঁটতে থাকে ব্রুনো। এই জন-অরণ্যে ভাগ্য তাদের কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানে না!

 

(বাইসাইকেল থিভস, ‘Ladri di biciclette’ ইতালির কথাসাহিত্যিক লুইগি বার্তোলিনির উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রকার ভিত্তোরিও ডি সিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র)

 

১৯১ পঠিত ... ১৬:৫২, এপ্রিল ২৬, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top