রাজা থেকে প্রজা বনে যাওয়া ফসফেট খনির দেশ নাউরু

৪০২ পঠিত ... ১৩:২৩, মার্চ ২৮, ২০২৩

3

ভ্যাটিকান সিটি এবং মোনাকোর পর পৃথিবীর তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র নাউরু। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে ২১ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে বসবাস করে মাত্র ১১ হাজার মানুষ। একসময় একে প্রশান্ত মহাসাগরের কুয়েত বলা হতো। কিন্তু সময়ের ফেরে আজ সেই নাউরুকেই অন্য দেশের কাছে হাত পেতে চলতে হয়। কথায় বলে, ‘বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরায়।‘ ফসফেট খনির দেশ নাউরুর ক্ষেত্রে বোধহয় এই প্রবাদবাক্যটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর।

একসময় প্রচুর পরিমাণে ফসফেটের খনি থাকায় নাউরুকে ফসফেট খনির দেশ বলা হয়। এখানে এত ফসফেট খনি থাকার কারণটিও বেশ অদ্ভুত। নাউরুর আশপাশে আর কোনো ভুখণ্ড না থাকায় কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে সামুদ্রিক পাখিদের অভয়ারণ্য ছিলো নাউরু। বিশ্রাম এবং টয়লেটের জন্য পাখিরা এই দ্বীপটিকে ব্যবহার করতো। মিলিয়ন বছর ধরে জমে থাকা পাখির মল একসময় উৎকৃষ্ট মানের ফসফেটে পরিণত হয়, যা কিনা কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। নাউরুতে থাকা এমন অসংখ্য ফসফেটের টিলা নাউরুর জন্য জন্য ছিলো স্বর্ণের খনি। নাউরুতে থাকা এই ফসফেট ছিলো সবচেয়ে বিশুদ্ধ। এর একটি বড় অংশই অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হতো। ১৯০৬ সালে জার্মানরা প্রথম নাউরুতে ফসফেটের খনির সন্ধান পায়। ‘প্যাসিফিক ফসফেট কোম্পানি’ নামে এখান থেকে তারা ফসফেট উত্তোলন করতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের পর্যন্ত জার্মানরাই এখানকার সব দেখভাল করতো। তারপর বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হলে লীগ অব নেশন্সের অধীনে নাউরুর প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া হয় ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে। আর ফসফেট উত্তোলনের দায়িত্ব চলে যায় ব্রিটিশ ফসফেট কোম্পানির কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান দ্বীপটিকে দখল করে নিলেও, জাপানের পরাজয়ের ফলে যুদ্ধ শেষে এই তিন দেশ আবার নাউরুর দায়িত্ব ফিরে পায়। ১৯৬৮ সালে নাউরু স্বাধীনতা লাভ করে, আর এর পরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। এত বছরের পরাধীনতা, বঞ্চনা আর শোষণের পরেও নাউরুবাসী নিজেদের অমূল্য সম্পদ ফসফেট সংরক্ষণের ব্যাপারে মোটেও সচেতন ছিলো না। ‘ব্রিটিশ ফসফেট কমিশন’ কিনে তাকে ‘নাউরু ফসফেট কর্পোরেশন’ নাম দিয়ে পুরোদমে ফসফেট উত্তোলন চালাতে থাকে নাউরু সরকার। উত্তোলিত ফসফেট  বিক্রি করা শুরু করে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। আর ফসফেট রপ্তানি করে খুব অল্প সময়ে সহজেই নাউরুর সরকারের হাতে আসতে থাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ।  জাহাজে পণ্য তোলার জন্য বিশাল আকৃতির ক্রেনও ব্যবহার করা শুরু করে নাউরু।

গল্পের শুরুটা মূলত এখান থেকেই। ১৯৭৫ সালে নাউরুর সরকারি ব্যাংকে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার  জমা হয়। স্বাধীনতার পর এক যুগের অর্ধেক সময়ে কোনো দেশেরই এত বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়ার রেকর্ড নেই। মাত্র ৭০০০ মানুষের দেশ নাউরুর মাথাপিছু আয় তখন কেবলমাত্র কুয়েতের থেকে কম ছিলো। এত বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়ে নাউরু সরকার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যেসব বিষয়গুলো দরকারি যেমন শিক্ষাখাত, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এসবের উন্নয়ন না করে বিলাসবহুল হোটেল গলফ কোর্ট এসব বানানো শুরু করে। সাইকেল দিয়ে মাত্র ১.৫ ঘণ্টায় যে দ্বীপটি পুরো ঘুরে ফেলা সম্ভব সেখানে সে সময় স্পোর্টস কার চলতো। এছাড়া দেশে খাদ্য উৎপাদন বাদ দিয়ে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির জন্য বিমানবন্দর বানিয়ে ৭টি বোয়িং বিমানও কেনে তারা। ফসফেট কোম্পানিতে কাজ করার জন্য নাউরুর স্থানীয় অধিবাসীদের না নিয়ে চীন, ফিলিপাইন, তাইওয়ান এসব জায়গা থেকে শ্রমিক নিয়ে যাওয়া হতো। তবে এমন অবস্থা বেশিদিন চলেনি, একসময় শেষ হয়ে আসতে থাকে নাউরুর ফসফেটের যোগান, আর সরকারি লোকজনের সীমাহীন দুর্নীতির ফলে আস্তে আস্তে ঘনিয়ে আসতে থাকে নাউরুর দুর্দিন। যেহেতু ফসফেট ছাড়া নাউরুর আর কোনো আয়ের উৎস নেই অবস্থা একসময় এমন দাঁড়ায় যে নাউরু অন্য দেশের কাছ থেকে ধার করে রাষ্ট্র চালাতে শুরু করে। সবকিছুর কিন্তু এখানেই শেষ নয় অন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে ধার করা অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য উপার্জনের পথ হিসেবে একজন অর্থ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে লন্ডনভিত্তিক ব্যান্ড ‘ইউনিট ফোর প্লাস টু’ কে দিয়ে সঙ্গীত অনুষ্ঠান আয়োজন করে নাউরু ট্রাস্ট। আশা ছিলো লন্ডনে তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে রাষ্ট্র চালানোর অর্থ চলে আসবে। কয়েক সপ্তাহ চলার পর ইউনিট ফোর প্লাস টু-এর অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং  সেইসাথে নাউরুর উপর চলে আসে  ৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা। সারাজীবনের জন্য একবারে পথে বসে যায় নাউরুর জনগণ। অবস্থা এমন দাঁড়ায় নাউরুর জনগণ আগে কৃষিকাজ করে হলেও নিজেদের জন্য খাদ্য ফলাতো, কিন্তু ফসফেটের বিক্রির টাকায় ঘরে বসে টাকা পেয়ে আর কৃষিকাজের অভ্যাসও চলে যাওয়ায় খাবার আমদানি করা ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন উপায় ছিলো না তাদের সামনে। এছাড়া অপরিকল্পিত ফসফেট উত্তোলনের ফলে নাউরুতে আর বিন্দুমাত্র আবাদি জমি নেই। সকল সম্পদ বিক্রি করে দেয়ার পরও যখন অন্য দেশের ঋণ শোধ হচ্ছিল না তখন নাউরু নিজেদের দেশে বিদেশিদের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দেয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান রাশিয়ার মাফিয়ারা বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে ফেলে। ধারণা করা হচ্ছিল, এর ফলে নাউরুর অর্থনৈতিক অবস্থা আস্তে আস্তে উন্নত হবে কিন্তু ২০০১ টুইন টাওয়ার হামলার পর বহির্বিশ্বের চাপে নাউরুর নীতি পরিবর্তন করতে হয়। ফলশ্রুতিতে নাউরু ফিরে আসে তার আগের অবস্থায়। শেষমেশ অস্ট্রেলিয়া নাউরুকে সাহায্য করে তবে এর বিনিময়ে নাউরুতে তারা স্থাপন করে উদ্ধাস্তু কেন্দ্র। অস্ট্রেলিয়াতে অবৈধভাবে আসা অভিবাসীদের এখানে রাখা হয়। এই উদ্ধাস্তু কেন্দ্রগুলো এইসব অভিবাসীদের জন্য একপ্রকার দুঃস্বপ্নের মতো। কারণ খাবার পানির মতো সাধারণ বিষয়গুলো নিয়েও এখানে যুদ্ধ করতে হয়।  

রাজনীতি এবং রাজধানী কোনটিই নাউরুতে নেই। ওখানে নির্বাচন অবশ্য হয় তবে তা হয় প্রভাবশালী মানুষদের মধ্যে এক অপরের সাথে সমঝোতা করে। বর্তমানে নাউরু একটি সম্পূর্ণ সাহায্য নির্ভর দেশ। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে অস্ট্রেলিয়ার সাহায্য নির্ভর দেশ। উদ্ধাস্তু কেন্দ্র চালানোর বিনিময়ে নাউরুকে সাহায্য সহযোগিতা করে অস্ট্রেলিয়া। নাউরুর বাজেট তৈরি হয় অস্ট্রেলিয়া। নিজস্ব কোনো মুদ্রা তাদের নেই অস্ট্রেলিয়ান মুদ্রাই সেখানে চলে। দেশের অধিকাংশ মানুষই পরিশ্রম না করতে করতে স্থুলকায় আর ৪০% মানুষ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। মোটকথা নিজেদের অদক্ষতা আর দুর্নীতি একসময়কার ধনীদেশ নাউরুকে পরিণত করেছে আজকের ভাড়াটে রাষ্ট্রে।

৪০২ পঠিত ... ১৩:২৩, মার্চ ২৮, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top