অ্যানোনিমাস অ্যাপের এই ক্ষতিগুলো সম্পর্কে আপনি জানেন তো?

৪২৩ পঠিত ... ১৫:৪৮, অক্টোবর ১৫, ২০২২

Anonymous-app

মানুষ জন্মগতভাবে নার্সিসিস্ট। কারো ভেতর নার্সিসিজম কম বা বেশি থাকলেও আমরা সবাই এই স্পেক্ট্রামের অন্তর্ভুক্ত। সিগমুন্ড ফ্রয়েডমতে, সাইকোসেক্সুয়াল ডেভেলাপমেন্টের ওরাল স্টেজ[১] মানে জন্ম থেকে এক বছরের মধ্যেই শিশুর ইগো বিকাশ শুরু করে। এসময় তার মধ্যে নেগেটিভ ইমোশনের উত্থান হয়, সে অত্যন্ত ইগোসেন্ট্রিক থাকে এবং বিশ্বাস করে হি ইজ দ্য সেন্টার অব ওয়ার্ল্ড। সেই থেকে আমাদের সেলফ লাভ শুরু হয় ।

এই সেলফ লাভ বা অবসেশনের আরেকটি ভিন্ন ফর্ম হলো অ্যানোনিমাস অ্যাপ্লিকেশনগুলো। কৌতুহলী স্বভাবের প্রাণী হওয়ায় মানুষ জানতে চায় তার সম্পর্কে অন্য মানুষ কী ভাবে, কী জানতে চায় কিংবা কী জানাতে চায়। অ্যানোনিমাস কমপ্লিমেন্ট মানুষকে পজিটিভলি মোটিভেট করে, ক্যান ব্রিং দেম স্মাইল কারণ People believe that people are mostly honest when It's anonymous. একে তুলনা করা যায় একটি চার্চের কনফেশন বুথের মতো।

অ্যানোনিমাস অ্যাপ্লিকেশনগুলো ভালো লাগার আরেকটি কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে আরেকজনের অ্যাপ্রুভাল, ভ্যালিডেশন বা কম্পলিমেন্ট পাওয়া যায় যা সাধারণত নরমাল ইগোকে বুস্ট করে থাকে।

এমনকি মাঝেমাঝে কমপ্লিমেন্টকে সলিডিফাই করতে মানুষ নিজেকেও বদলাতে কার্পণ্যবোধ করে না। এটি একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, একে মেনে না নেওয়াই অস্বাভাবিক।

এমআইটির পাবলিক রিলেশন উইথ টেকনোলজির প্রফেসর শেরি টার্কল বলেন, ‘Anonymity has always been the secret sauce.’

তবে এই সিক্রেট সসের সাথে যে আনইগনোরেবল ব্যাপারটি আসে তা হলো—হিউমিলিয়েশন এবং সাইবারবুলি।

এই মুহুর্তে ngl নামের একটি অ্যাপ্লিকেশন হাইপে থাকলেও এর আগে অসংখ্য সিমিলার জিনিস সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে৷ এই অ্যাপলিকেশনগুলোর একটি কমন ফিচার হলো বাজারে আসার পর কিছুদিন এরা প্রচন্ড হাইপে থাকে, দেন দে আর লেড টু ক্র্যাশ অ্যান্ড বার্ন।

সেন্সর টাওয়ার নামের একটি অ্যাপ বিশ্লেষণ সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের জুন এবং জুলাইয়ের প্রথমার্ধে ngl  যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন বার ডাউনলোড করা হয়েছে। জুন মাসে অ্যাপল এবং গুগল প্লে স্টোরে এটি দশম সর্বোচ্চ ডাউনলোডেড অ্যাপ ছিলো।

তবে অ্যানোনিমাস অ্যাপ Sararah-র উত্থানটি আমার চমৎকার লেগেছে। আরবি শব্দ 'Sararah' অর্থ হলো Honesty বা Frankfullness.

Sararah-র নির্মাতা কম্পিউটার সায়েন্স গ্রাজুয়েট ও সৌদি ডেভলাপার জাইন আল আবিদিন তৌফিক তখন কাজ করতেন একটি তেল কোম্পানিতে। 

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যখন এই সাইটটি তৈরি করেন এর উদ্দেশ্য ছিলো অফিসে কর্মচারীদের সাথে বসের কম্যুনিকেশন ভালো করা। যেসব কথা তারা সরাসরি বলতে পারতো না কিন্তু জানানো প্রয়োজন—তার জন্য তৈরি হলো Sararah.

 তৌফিক একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “My ultimate goal was 1,000 [shared] messages.” প্রথমে এই সাইটের ৭০ জন ব্যবহারকারী থাকলেও তৌফিক যখন তার একজন ইনফ্লুয়েন্সার বন্ধুকে দিয়ে হালকা মার্কেটিং করান, এটি চারদিকে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রথমে লেবানন,তিউনিশিয়া এবং শেষে মিশরের সোশ্যাল মিডিয়া ইউজাররা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ততদিনে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে তিন মিলিয়ন।

 তৌফিক এর ডিমান্ড সেন্স করতে পেরে সাইটের পাশাপাশি হাত দেন অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতেও। ২০১৭ সালে ১৩ জুন ইংরেজিতে আপডেট করে Sararah প্রথম গুগল প্লেস্টোরে যায়। ৫ জুলাই স্ন্যাপচ্যাট তার আপডেটে Sararah কে অন্তর্ভুক্ত করে। তিন দিন পর 'Sararah' অ্যাপ স্টোরের টপ ডাউনলোডেড ১৫০০ অ্যাপে প্রবেশ করে। চার দিন পর #১০৪ ও তার দুইদিন পর #১৭ তে লাফিয়ে ওঠে।  আর এর মাত্র তিন দিন পর স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং অন্যান্য জায়ান্ট সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে হারিয়ে #১ এ পৌঁছে যায়।

তবে Sararah নিয়ে কন্ট্রোভার্সি শুরু হয় ক্যান্সার জয় করা ১২ বছরের এক স্কুলছাত্রকে তার বন্ধুরা   'কুৎসিত' এবং 'টাক' অ্যাড্রেস করে অ্যানোনিমাসলি মেসেজ দেওয়ার পর।

'Sararah' এর বিলীন হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিও ইন্ট্রেস্টিং।

 অস্ট্রেলিয়ার কুইনসল্যান্ডের এক কিশোরী অ্যানোনিমাসলি আসা বিশ্রী,নোংরা ও ট্রমাটাইজিং মেসেজ দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এ সময় সুপারওম্যানের ভূমিকায় নেমে আসেন ওই কিশোরীর মা ক্যাটরিনা কলিন্স। তিনি বলেন, “No parent can stomach this abuse of their children and I cannot even imagine losing my beautiful, sweet girl to suicide. This is why we need to protect our children.”

এরপরই তিনি ৪,৭০,০০০ স্বাক্ষর জোগাড় করে মামলা করলে গুগল এবং অ্যাপল তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে অ্যাপ্লিকেশনটি নামিয়ে নেয় ।

Askfm, Yik Yak, LMK—র মতো আরো অনেক অ্যানোনিমাস অ্যাপ্লিকেশন বিভিন্ন  সময়ে সামাজিক মাধ্যমে রাজত্ব করেছে। Yik Yak -এ পাওয়া বোমা হামলা ও হত্যার হুমকির রেশ ধরে বেশ কয়েকটি স্কুল পর্যন্ত খালি করতে হয়েছিলো [২] Yolo এবং LMK অ্যাপ্লিকেশনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন আত্মহত্যাকারী কিশোরের মা ।

মেজর সিলিকন ভ্যালি প্লেয়ারদের হিউজ ইনভেস্টমেন্ট থাকার পরও ২০১৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় ‘Secret’ নামের আরেকটি অ্যানোনিমাস অ্যাপ। বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠাতার একজন ডেভিড বিটো মিডিয়ামে অ্যাপ্লিকেশনটি বন্ধ হয়ে যাবার ব্যাপারে বলেন,“anonymity is the ultimate double-edged sword.” [৩]

...

মানুষ কেনো অ্যানোনিমাসলি এতো প্রতিহিংসাপরায়ণ, নীচু বার্তা দেয় তা বোঝা অসম্ভব নয়। আমেরিকান সাইকোলজিস্ট ফিলিপ জিম্বার্দো তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, অ্যানিনোমিটির সাথে অ্যাবিউজিভ বিহেভিয়ারের সরাসরি সম্পর্ক আছে।

একজন নাম,পরিচয়,চেহারাবিহীন মানুষ আরেকজন মানুষের প্রতি অত্যন্ত রুড, অ্যাগ্রেসিভ এবং মীন আচরণ করে। এই প্ল্যাটফর্মটি তার জন্য একটি সুপারপাওয়ার হয়ে দাঁড়ায় যার মাধ্যমে একজন মানুষ সেসব কথাই বলতে পারে—— যা উইথ রিয়েল আইডেন্টিটি, সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

অনলাইন বিহেভিয়ার স্পেশালিস্ট জন সুয়েলার এই ঘটনাটিকে বলেন ‘online disinhibition effect’

এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ যখন তার আসল পরিচয় থেকে দূরে থাকে তখন সে তার কথা বার্তার জন্য অ্যাকাউন্টেবল বা রেসপন্সিবল ফিল করে না। কারণ অ্যানিমোসিটির ফলে প্রশ্নকর্তাকে সরাসরি জাজ করার কেউ না থাকায় সে-ও সিকিউর বোধ করে।

মায়া অ্যাঞ্জেলোর একটি কথা এখানে বেশ রিলেভেন্ট।

‘People will forget what you said. People will forget what you did. But people will never forget how you made them feel.’

এই অ্যাপ্লিকেশন বা সাইট ব্যবহারকারীদের ৯০%  মানুষ এমন বিদ্বেষমূলক, কুরুচিপূর্ণ কিছু মেসেজ পান যে সেখান থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতেও বেশ সময় লাগে। যাদের সহজেই মেন্টাল ব্রেকডাউন হয় বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার আছে তাদেরকে জাপ্টে ধরে এপিসোডিক ডিপ্রেশন। ফান কিংবা কিউরিওসিটি কোটায় এই অ্যাপ ব্যবহার করলেও সেটা পরবর্তীতে আর কোনোটাই থাকে না।

মানুষ যে এখানে কেবল নেগেটিভ মেসেজ-ই পান, তা নয়। ভীষণ চমৎকার, মোটিভেটিং মেসেজ এখানে আসলেও মানুষের আত্মসম্মান বা সেলফ ইস্টিম নেগেটিভ ফিডব্যাকের প্রতি ভালনারেবল। আমাদের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ সময়ই ভালোর চেয়ে বেশি খারাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ঠিক যে কারণে রিলেশনশিপ ভেঙে যাবার পর ওই পার্টিকুলার জেন্ডারের সবাইকে সন্দেহ বা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখা হয়, নিয়ার সিমিলার কারণেই অ্যানোনিমাসলি আসা ইনস্পায়ারিং মেসেজের চেয়ে  হিউমিলিয়েটিং মেসেজগুলোর মাধ্যমে তীব্র নেগেটিভ ইমোশন তৈরি হয়। এটা হচ্ছে মানুষের বেসিক ইনস্টিংক্ট— নেগেটিভ বায়াস।

....

মানুষের প্রতি মানুষের কেন এত ঘৃণা—এ প্রশ্নের কোনো সংক্ষিপ্ত উত্তর নেই ।

মানুষ তার নিজের সমস্যার এস্কেপগোট বা বলির পাঁঠা হিসেবে আরেকজকে ঘৃণা করতে পারে। সমস্যার কারণ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে গিল্ট ট্রিপে ভোগার চেয়ে আরেকজনের দিকে সেটা পয়েন্ট করা তুলনামূলক সহজ এবং এতে নিজেও হালকা থাকা যায়।

তবে বেশিরভাগ হেট্রেডের মূল কারণ হয় ইনসিকিউরিটি। মানুষ যখন দেখে আরেকজনের এমন কিছু আছে যা তার নেই—এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটি সে মেনে নিতে পারছে না— তখন সে হিংসা করে। এই আনকন্ট্রোলেবল এবং তীব্র হিংসা থেকে জন্ম হয় ঘৃণার। এক হিসেবে  হিংসাকে ঘৃণার বাবা বা দাদাও বলা যায়।

মানুষের ইনস্টিংক্ট নিয়ে আদি আমেরিকান একটি অ্যানেকডট আছে। একবার এক দাদা তার নাতিকে  বলছিলেন, ‘তোমার ভেতর দুটি নেকড়ে সবসময় যুদ্ধ করছে। এর মধ্যে একটি শান্তি,প্রেম এবং দয়ার নেকড়ে। আরেকটি ভয়,লোভ এবং ঘৃণার নেকড়ে।‘

নাতিটি জিজ্ঞেস করে, ’কোন নেকড়েটি জিতবে?’

দাদা উত্তর দেয়, ’তুমি যেটাকে খাওয়াবে (That you'll feed)‘

৪২৩ পঠিত ... ১৫:৪৮, অক্টোবর ১৫, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top