বঙ্গবন্ধুর চাওয়াগুলো

৬৮৫ পঠিত ... ২০:২০, আগস্ট ১৫, ২০২২

Bongobondhur-chawagulo

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন মানুষ; যিনি জানতেন, নাও তোমার হাতগুলো ভরে উঠবে; দাও তোমার আত্মাটা ভরে উঠবে। খুব ছোটবেলায় যে ছেলে নিজের বাড়ীর গোলার ধান ক্ষুধার্তকে দিয়ে আসে; তার মধ্যে যে কোন পার্থিব চাওয়ার আকুতি নেই; সে তো আর বলে দেয়ার অবকাশ থাকে না। সমাজের কিছু মানুষ ভরপেট খাবে আর কিছু মানুষ না খেয়ে থাকবে; এ এক অসহনীয় বাস্তবতা মনে হয়েছিলো তাঁর কাছে। খুব শৈশবে সাম্যচিন্তাটি সহজাতভাবে ভেতরে এসে যাওয়ায়; সেখান থেকেই অধিকার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে এক অদম্য জননেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব।একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সামাজিক সাম্যই ছিলো তাঁর একমাত্র অভিলক্ষ্য। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই তাঁকে লড়তে হয়েছিলো পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে।   

তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার আদলে কয়েকজন গ্রাম্য সামন্ত জোতদার, অস্ত্রবাজ সেনা চৌকিদার আর তাদের বেছে নেয়া কিছু গোলাম বৃটিশদের মত সাহেব হয়ে উঠতে চেয়েছিলো রাতারাতি। পাঞ্জাবের গমক্ষেত থেকে উঠে এসে শেয়াল রাজা বনে যাবার এই যে স্যুটেড-ব্যুটেড কলোনিয়াল ফ্যাশন প্যারেড আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের দস্যুবৃত্তি; একে না করে দেন বঙ্গবন্ধু। এই যে পশ্চিম পাকিস্তানের একদল অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত ক্ষমতা কাঠামো, এরা বৃটিশ সাহেবদের মতো বাংলো বানিয়ে, এক হাতে স্কচ অন্য হাতে তসবিহ নিয়ে নিওএলিট মুজরা বসিয়েছিলো; সেসবের খরচ মেটাতে হতো ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক-শ্রমিককে। পাকিস্তানী নব্য এলিটদের পেটে বোমা মারলেও একটু প্রজ্ঞার ছিঁটেফোটা বেরুতো না মুখ দিয়ে। বঙ্গবন্ধু এগুলো নিজ চোখে যখন দেখতেন; তখনই প্রতিজ্ঞা করেন, এই শেয়াল পালের ধান্দাবাজ গ্যাং-টি ভেঙ্গে দেবেন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে, অধিকার বঞ্চিত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে; অনলবর্ষী বাগ্মিতা দিয়ে।    

সেসময় পূর্ব-পাকিস্তানের অন্য যারা পশ্চিম পাকিস্তানে যেতো, তারা ক্ষমতা কাঠামোর বিলাসী জীবন দেখে খুব গোপনে ঐ শেয়াল জীবনটি পছন্দ করে ফেলে। গরীবের হক মেরে তাদের রক্তে স্কচ পান, ধর্মের মুখোশ, একটু ঠাঁট-বাঁট এগুলো খুব টানে পূর্ব পাকিস্তানের শেয়ালকে; যারা সুযোগের অভাবে ভদ্রলোক। মুখে মুজিব ভাই, অন্তরে আমার একখান বাংলো চাই স্বপ্নই টানে পূর্ব পাকিস্তানের ধানক্ষেত থেকে উঠে যাওয়া শেয়ালদের। বঙ্গবন্ধু প্রথমে চেষ্টা করলেন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাঝ দিয়ে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নিয়ে পুরো পাকিস্তানের অধিকার বঞ্চিত মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানের লুণ্ঠকদের হাত থেকে বাঁচাতে। সেনাশাসক আর তাদের পোষা সারমেয়দের লুণ্ঠনের সিন্ডিকেটটি ভেঙে দিতে। কারণ তৎকালীন বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু প্রদেশের মানুষের সামনেও বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোন মুক্তির ঠিকানা ছিলো না। যে মুক্তি তাদের আজো মেলেনি। বিপদ বুঝে ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুরো পাকিস্তান শাসনের ম্যান্ডেট পাওয়া জননায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার পরিকল্পনা করে। বঙ্গবন্ধু এই পরিকল্পনাটি বুঝে সেটিও যুগপত রাজনৈতিকভাবে ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মোকাবেলার প্রস্তুতি নেন।বাংলাদেশের জনমানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন ৭ মার্চের ঔন্দ্রজালিক ভাষণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধটি যেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গৃহযুদ্ধের তকমা না পায় সেজন্য তিনি গ্রেফতার বরণ করেন। রাজনীতি যদি দাবা খেলা হয়; সেখানে একটি চালেও ভুল করেননি শেখ মুজিব।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের ঋজুতার কারণে তাঁকে হত্যা করার সাহস পায়নি পাকিস্তানীরা। বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যান। তাদের সামনে দুটো উদ্দেশ্য; বাংলাদেশকে ঘাতক দখলদার মুক্ত করা এবং তাদের নেতাকে মুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের নামটি এখানে উল্লেখ অপরিহার্য যিনি নানামুখী ষড়যন্ত্রের মাঝে লক্ষ্যে স্থির থাকেন। মুক্তিযুদ্ধে কিছু মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ থাকলেও বেশীরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সেই প্রাণের বন্ধুরা, মাটির মানুষেরা যারা কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।আর প্রতিবেশী দেশ ভারতের মানবিক ও সামরিক সহযোগিতা এ মুক্তির যুদ্ধে বন্ধুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে যায় ইতিহাসে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান।নয়মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু ফিরে দেখেন তিরিশ লাখ শহীদের বধ্যভূমি, দুই লাখ নির্যাতিতা নারীর অবর্ণনীয় ট্র্যাজেডি, পোড়ো বাড়ী, রিক্ত মাঠ। শূন্যহাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিতসা-শিক্ষার মৌলিক চাহিদা পূরণে কী করবেন; এই দুঃশ্চিন্তা তাঁর অসংখ্য বিনিদ্র রাত্রি যাপনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।   

সাম্যবাদের আদর্শিক সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মস্কোর সখ্য বাংলাদেশকে আরেকটি কিউবা করে তোলে কিনা এই আশংকায় যুক্তরাষ্ট্র তখন সম্ভব সব রকমের অসহযোগিতা শুরু করে বাংলাদেশের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যেহেতু বাংলার কৃষক-শ্রমিক সবসময় ছিলো; উনি ভয় পাননি কোনো চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় মধ্যবিত্তের একটি অংশকে নিয়ে যারা পাকিস্তানে গ্রাম্য শেয়াল সাহেবদের বাংলো আর বিলাসী জীবন দেখে এসেছিলো। বঙ্গবন্ধু খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, গণভবনে ‘চাটার দল’এসে চাটছে; আর বেরিয়ে গিয়ে সম্পদ লুণ্ঠন করছে। এর-ওর বাড়ী দখল করছে; হয় বাংলো বানাচ্ছে বা দখল করা বাড়িটাকেই বাংলো বানিয়ে স্বদেশী শেয়াল রাজা হয়ে উঠছে। ওদিকে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা কেন পাকিস্তানের সেনা চৌকিদারদের মত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না তা নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। যুদ্ধাহত একটি দেশে একটি মুহূর্ত শান্তি এই শেয়াল গ্যাং দেয়নি বঙ্গবন্ধুকে। উনি ভেবে পান না এই চোরের খনি নিয়ে উনি কী করবেন! বিশ্বাস করার মতো মানুষের দুর্ভিক্ষে উনি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও দেশজ নব্যবিপ্লবীদের থামিয়ে একটু দেশ গড়ার কাজ করতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আসেন। কারণ এছাড়া কোনো উপায় ছিলোনা। মধ্যবিত্ত মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে ধর্মব্যবসায়ী; যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক দেশজ দালাল থেকে শুরু করে উদ্দেশ্যহীন বিপ্লবীর দল দেশ স্বাধীন হতে না হতেই কী পেলাম কী পেলাম রব তোলে। এই যে এতো কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা, পতাকা, মানচিত্র, সংবিধান এগুলো যেন কিছুই নয়; কী বাংলো পেলাম, কী গাড়ীতে চড়লাম, কোন চাকরীতে পদায়িত হলাম এরকম অসংখ্য লোভের অযৌক্তিক কোলাহলে মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন; সারাক্ষণ গুজবের স্বীকার মুখরোচক সমালোচনার ট্র্যাজিক নায়ক। খুনীরা তার আসে পাশেই ঘুরতো; সেযুগের সেলফি তুলতো মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে।

মুজিব ভাইয়ের বাড়ীর নুন খেয়ে বেরিয়েই বাইরে ভয়াবহ সব গুণ গেয়ে বেড়াতো। শেখ মুজিব যেন আরবের শেখ হয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু সেই অপরিবর্তনীয় মানুষ, লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরে বেতের চেয়ারে বসে সেই একই মধ্যবিত্ত জীবনে, স্ত্রী তাঁর যথারীতি জীবন সংগ্রামে। কারণ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলেও সেই টুঙ্গিপাড়ার মুজিব; যিনি স্বকীয়তা আর সততা থেকে কীভাবে মানুষ বিচ্যুত হতে পারে; তা দেখে বিস্মিত হতেন। জীবনের এই কালো পৃষ্ঠা তাঁর অজানা। ঔদার্য্য আর সরলতা যদি কোন অপরাধ হয়; বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই সেই অপরাধের অপরাধী। মানুষকে নিজের চেয়েও ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, মুজিব সেই অপরাধের অপরাধী। তাই তো ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ভোরে দেশজ ঘাতকেরাই তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। বাংলাদেশ ব-দ্বীপের সবুজ জমিনে মুক্তির মহানায়ককে খুন করে ফেলে কৃতঘ্ন ঘাতকেরা। সাম্যভাবনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মৃত্যু ঘটে। প্রথমে পাকিস্তানের মতো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও পরে মুজিবের সাম্যের দর্শন মুছে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ঘরানার পুঁজিবাদী পঙ্গু রাষ্ট্র হয়ে ওঠে এটি। এরপর ক্রমে ক্রমে অশিক্ষা আর সংস্কৃতিহীনতায় সৌদী আরবের মত ‘টাকা আছে—রুচি নাই, লোভ আছে—মানবিকতা নেই’এমন একটি নরভোজী সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনা দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন ধোয়া বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যদিও সেটি বিদ্যমান স্থূল সমাজ বাস্তবতায় একরকম দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জ।বাংলার কৃষক-শ্রমিক, নির্লোভ এখনো নষ্ট না হওয়া যে তারুণ্যের শক্তি অবশিষ্ট আছে; তারা যদি বঙ্গবন্ধুর সাম্যের সমাজ, মানবিক সুষম সমাজ, মানুষ পরিচয়ে অবিভাজিত ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ার স্বপ্নটিকে আত্মস্থ করতে পারে; হয়তো ধীরে ধীরে সভ্যতায় পদার্পণ এখনও সম্ভব।

৬৮৫ পঠিত ... ২০:২০, আগস্ট ১৫, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top