শুনতে মধুর হলেও যে সত্যগুলো সত্য নয়

২৬৭৩ পঠিত ... ১৭:৪৪, জুন ২৩, ২০২২

Ai-sottogula-ki-asholei-sotti

ইন্টারনেটের হাফ কুকড ট্রুথের জমানায় অনেক জিনিস ভাইরাল হয়, যা মূলত পুরো সত্য জানলে অন্য অর্থ দাঁড়ায়। যেমন একটা হচ্ছে, বাবা দিবসে হুমায়ুন আহমেদের নামে প্রচলিত একটি উক্তি—'পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।‘

শুরুর দিকে কয়েক বছর বেদবাক্যের মতো এই উক্তি উনার নামে চালানো হয়েছে। এখন কয়েক বছর পর নতুন আরেক ট্রেন্ড। এখন এটাকে খণ্ডন করা হয়।

অথচ সত্যটা হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদ এই কথা এবং এই কথার খণ্ডন, দুইটাই করে গেছেন। ওই একই লেখায়। 

ঘটনাটা ছিল এমন, লস এঞ্জেলসে বেড়াতে এসে এক ফ্যামিলি ক্যাম্পিং-এর রাত। তাঁবুর ভেতর উনার ১২-১৩ বছর বয়সী মেয়ে শীলা আহমেদ অসুস্থ হয়ে যান। কারণ ওই পিচ্চি বয়সে শীলা আহমেদ ক্লস্ট্রোফোবিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।  

হুমায়ূন তাই মেয়েকে নিয়ে সারা রাত খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে দেন। অন্যরা তাঁবুর ভেতর ঘুমান আর মেয়ে বাবার কোলে ঘুমিয়েছেন। সকালে উঠে শীলা আহমেদ বলেন, ‘বাবা তুমি অনেক ভালো একজন মানুষ।‘

হুমায়ূন আহমেদ ওই 'ভালো মানুষ’ অভিধা খারিজ করে, ওই রাতে বাবার কর্তব্যকে ফোকাস করতে গিয়ে বলেন, ‘মা! পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই।‘

এই ঘটনা নব্বইয়ের দশকের। হুমায়ূন আহমেদ এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন ২০১১ সালের লেখায়। সেখানে তিনি নিজেই লিখেছেন শেষ প্যারায়, ‘এখন মনে হয় শীলা বুঝে গেছে—পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে। যেমন, তার বাবা।’

খেয়াল করে দেখেন, এক দশক পর ওই লেখায় উনি বরং ওই আক্ষেপসূচক রিবাটালটাই বলতে চেয়েছেন। সংসার বিচ্ছিন্ন, সন্তানদের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়া যে কোন বাবার জন্যই এই আক্ষেপ স্বাভাবিক। 

কিন্তু অনলাইনের নেট নাগরিকেরা উনার স্মৃতিচারণের মূল আক্ষেপটুকু এড়িয়ে একটা অংশ কোট করে, পক্ষে-বিপক্ষে বাহাস করে।

অথচ হুমায়ূন নিজেই দুটো পার্সপেক্টিভ লিখে, নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন যে পৃথিবীতে খারাপ বাবাও হয় (এবং নিজের উদাহরণটাই দিয়েছেন অকপটে)। 

 

ইন্টারনেটের হাফ ট্রুথের জমানায় এমন আধো আধো কোট করে আরও কয়েকটা ক্যাচাল চাউর হয়।

যেমন, সুবর্ণা মুস্তাফার সাথে হুমায়ুন ফরীদির এক রাতে ঝগড়া হয়। এরপর হুমায়ুন ফরীদি ফ্লোর থেকে ছাদ অবধি লিখেছেন, ‘সুবর্ণা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।‘ 

বেচারি সুবর্ণা মুস্তাফাকে অনেকবার এই ঘটনা নিয়ে এই প্রশ্ন শুনতে দেখেছি। একবার টিভি ইন্টারভিউতে দেখলাম, বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘এই ঘটনা যে কে চাউর করলো এমন ভুলভাবে!’ 

উনার ভাষ্যে মূল কাহিনী ছিলো, উনাদের বাসায় ইন্টারিয়র পেইন্টিং করা হবে নতুন করে। তো হুমায়ুন ফরীদির কাজ ছিল আগের পেইন্টিং-এর উপর ওইখানে আলাদা চুনের প্রলেপ দেয়া। ওইদিন রংমিস্ত্রী আসার আগে হুমায়ুন ফরীদি নিজের নাম, সুবর্ণা মুস্তাফার নাম আর ভালোবাসি লিখেন চুন দিয়ে। মানে চুনকামের কাজটা এমনিতেই করা লাগতো। 

কিন্তু এই ব্যাপারটা কম বোরিং করতে গিয়ে এবং ইমপ্রেস করতে গিয়ে উনি এটা করেন। আঁকাবুকি করার সময় দু'জনই ছিলেন। আগের রাতে ঝগড়া করে, পরদিন 'ভালোবাসি' বলে দেয়াল ভরিয়ে দিয়ে অভিমান ভাঙানোর ব্যাপার ছিল না!

এনিওয়ে, এটা তো তাও সুবর্ণার ভাষ্যে খণ্ডন। বেনিফিট অব ডাউট দিই লোকজনকে। কিন্তু, কিছু কিছু হাফ ট্রুথ তো সচেতনভাবেই চাউর হয় আই গেস।

 

যেমন জহির রায়হানের ‘আরেক ফাগুণে, আমরা দ্বিগুণ হবো।’

প্রতিবছর ভ্যালেন্টাইন দিবস আসলেই এটা চাউর হয়। এই নিয়ে কিছু ডিবেটিং ক্লাবে জুটি বিতর্ক হতেও দেখেছি। অথচ এটা ছিলো জেলখানায় আবদ্ধ রাজনৈতিক বন্দীদের একজন পাকিস্তানি জেলারকে উদ্দেশ্য করে সংলাপ।

পুরো অংশটি এমন, ‘ছেলেমেয়েদের জেলখানায় ঢোকানোর সময় নাম ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। একসময়ে বিরক্তির স্বরে বললেন, “উহ্, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়! জেলখানা তো এমনিতেই ভর্তি হয়ে আছে।"'

ও কথা শুনে একজন বললেন, 'এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।'

 

ফাগুণ এলে আরেক আদিখ্যেতা করে সাংবাদিকরা। সূভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত' এই কবিতাংশ কোট করে রিপোর্ট করতে গিয়ে।

অথচ এটা বসন্তকাল নিয়ে লিখেননি উনি। এটা একটা ডিস্টোপিয়ান সময় পেরিয়ে মানুষের জেগে উঠার বিপ্লব বোঝাতে চেয়েছেন উনি। 

তাও রূপক কবিতা অনেকভাবে পাঠ করা যায়, এই খাতিরে ধরলাম, এই বসন্তকেও লোকজন শুভদিন বুঝাইতে চায়। 

 

যেমন আল্লামা রুমির খোদাকে নিয়ে লেখা কবিতাকে আমরা এক্স-কে নিয়ে লেখা বিরহী কবিতাংশ হিসেবে চালিয়ে দেই। কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূজাপর্বের ঈশ্বরকে নিয়ে লেখা অধিকাংশ গানই এখন আমাদের প্রেমের গান।

(এই দুই ক্ষেত্রে আমি রূপককে কেন্দ্র করে একনলেজ করতে তাও রাজি) কিন্তু এর ফলে ভ্রান্তিও কম হয় না।

যেমন বিশ্বজুড়েই ভুল বোঝা একটা গান হচ্ছে বব মার্লের গাওয়া—'No Woman, No Cry.'

পুরো গানটার লিরিকের অর্থ বানিয়েছে, 'নারী নাই তো জীবনে কান্দনও নাই।’ অথচ বব মার্লের এই গানটা বরং নারীবাদী একটা গান। 

গানটা মূলত, কেনসিংটনের যে বস্তিতে বব মার্লের বেড়ে ওঠা সেখানকার সিঙ্গেল মাদারদের নিয়ে লেখা। ওই ঘেটো বস্তিতে বাপেরা বিয়ে করে বাচ্চা ফেলে চলে যেত, মায়েরা বাচ্চা পালতেন। বড় করতেন, হরেক দূর্দশা সহ্য করে, কান্নাকাটির সংসার। বব মার্লে তাই লিখেছিলেন, 'No, Woman. No Cry.' 

অনেকটা জেমসের 'দুঃখিনী দুঃখ করো না' এই ধাঁচের ভাবানুবাদ হইতে পারে। অথচ এই নারীবাদী গানকে দুনিয়া জোড়া নারীবিদ্বেষীরা ব্যবহার করে, 'মাইয়াও নাই, প্যারাও নাই' এই অর্থে।

অথচ পরের লাইনগুলো খেয়াল করলেই এই ভুলটা হয় না। বব মার্লের স্ত্রী রিটা মার্লে উনার আত্মজীবনীতেও এই গান নিয়ে লিখেছেন গানটার ব্যাপারে ভুল ধারণা শুধরে দিয়ে। 

 

কিন্তু সব হাফ কুকড ট্রুথ বিষয়ে তো আর বই লিখে সংশোধন সম্ভব না। লিখলেও পড়বে কয়জন! আমাদের স্ক্রিন টাইম আর স্ক্রিন হ্যাবিটের যে বেহাল ছিরি! চটকদার হাফ কুকড ট্রুথ ছাড়া কিছুই খাই না আমরা।

২৬৭৩ পঠিত ... ১৭:৪৪, জুন ২৩, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top