কম্পিউটার আপনাকে কী বলে ডাকবে? আপনি? তুমি? নাকি তুই?

৩৬৮ পঠিত ... ১৬:১৭, মে ১৪, ২০২২

Jogoter-sokol-machine

ইংরেজিতে হয়তো এভাবে চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু বাংলা ভাষায় তুই-তুমি-আপনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সঙ্গত কারণেই। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে যখন কেউ File অপশনে গিয়ে Save-এ ক্লিক করেন, তখন তার কাছে এটি কেবলই Save, কিন্তু যদি Save-এর বাংলা করতে হয়, তাহলে শুধু ‘সংরক্ষণ’ শব্দটি দিয়ে কাজ সারা গেলেও সত্যিকার অর্থে নির্দেশটির অর্থ দাঁড়ায় হয় ‘সংরক্ষণ কর’, অথবা ‘সংরক্ষণ করো’ অথবা ‘সংরক্ষণ করুন’। এখন কাউকে যদি Save ক্রিয়াপদটির অনুবাদ করতে হয়, তিনি সেক্ষেত্রে কোনটি বেছে নিবেন? তুই? তুমি? আপনি?

ফাইল Save করতে বলে কম্পিউটারকে হয়তো ‘তুই’ হিসেবে ‘সংরক্ষণ কর’ করে বলাই যায়, যদিও এতে কিছুটা অস্বস্তি হয়; কিন্তু ‘তুমি’ করে ‘সংরক্ষণ করো’ বলতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু, কম্পিউটারকে আপনি করে ‘সংরক্ষণ করুন’ বলতে নিশ্চয়ই অনেকটা খাপছাড়া লাগে। ভাবা যায়, কম্পিউটারকে নানা নির্দেশ দিচ্ছি ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করে?

এর উল্টোপিঠেই কম্পিউটার কিন্তু মাঝেমধ্যে আপনাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। যেমন, কোনো ফাইলে কাজ করতে করতে হুট করে বন্ধ করতে গেলে জিজ্ঞাসা করে Save your changes to this file? অর্থাৎ, বাংলাতে অনুবাদ করলে হতে পারে: ‘আপনি কি এই ফাইলটির পরিবর্তনগুলো সংরক্ষণ করতে চান?’

যদি কম্পিউটারকে তুই করে বলার ‘সুযোগ’ দিই তাহলে এই বাক্যটির অনুবাদ হবে এমন: ‘তুই কি এই ফাইলটির পরিবর্তনগুলো সংরক্ষণ করতে চাস?' কিংবা তুমি করে বলার ‘অনুমতি’ দিলে বাক্যটি দাঁড়ায় এমন: ‘তুমি কি এই ফাইলটির পরিবর্তন সংরক্ষণ করতে চাও?’

এখন, কম্পিউটারকে যখন নির্দেশ দিচ্ছি, তখন আপনি করে কিছু বলতে গেলে যে অস্বস্তি লাগে, ঠিক তেমনই অস্বস্তি লাগে যদি কম্পিউটার যখন কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করে তখন যদি তুই করে বলে। এখন তো ভয়েস কমান্ড দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। অস্বস্তি লাগবে না যদি ওয়াশিং মেশিনকে বলি, ‘অনুগ্রহ করে কাপড়গুলো ধুয়ে দিন’ এবং মেশিনটি যদি পাল্টা বলে, ‘কাপড় ধোয়া শেষ। এগুলো বের করে বাইরে শুকাতে দে’?

এই যে অস্বস্তির ব্যাপারটা, এটা কি কেবলই কম্পিউটার যে একটা যন্ত্রবিশেষ সে কারণে? একজন জ্যেষ্ঠ মানুষকে যখন আমরা আপনি করে বলি এবং তিনি যখন আমাদেরকে তুই করে বলেন, শুনতে অস্বস্তি হয় না; কিন্তু কনিষ্ঠ একজনকে যদি আপনি করে বলতে হয় এবং তিনি যদি উল্টো তুই করে বলেন, তাহলে যে অস্বস্তিটি হয়, সেই একই রকমের অস্বস্তি কি কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, নাকি এটা ভিন্ন ধরনের অস্বস্তি?

আপাতদৃষ্টিতে কম্পিউটারকে আপনি করে বলা কিংবা কম্পিউটারের আমাদেরকে তুই করে বলার বিষয়টি কারো কারো কাছে অপ্রাসঙ্গিক বা বাড়াবাড়ি ধরনের কষ্টকল্পনা বা এমন কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু ধরুন, বিশ বছর পর হয়তো মেশিনই হয়তো অনেক বড় ভূমিকা, বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে, মূল ভূমিকা পালন করতে পারে। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে আপনারা কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সিডিসির কথা শুনেছেন, যে (এই যে দেখেন, এখানে কিন্তু যিনি লিখিনি) কিনা মানুষের পক্ষে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নেয় (নেন কিন্তু লিখিনি এখানে)। বলা যায়, মানুষের দৈনন্দিন অনেক কাজকর্ম ও সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে সিডিসি। এখন মনে করেন, আমি রোগী হিসেবে বসে আছি একটি চেম্বারে যেখানে অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কম্পিউটার আমাকে দেখে ওষুধ দিবে, কারণ ডাক্তারের বিকল্প হিসেবে কম্পিউটারই এসব কাজ করে। সেক্ষেত্রে আমি কি বলবো যে, ‘কাল থেকে মাথাব্যাথা, অনুগ্রহ করে ওষুধ দিন’ নাকি তুই বা তুমি করে বলবো? কিংবা ধরুন, মরুভূমি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি একটা কাজে যেখানে একটা মানবিক রোবটই মূলত সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে এবং তার ক্ষমতা মোটামুটি সচিব পর্যায়ের ক্ষমতার সমান। তাকে কি আপনি করে বলবো, নাকি তুমি বা তুই করে? কিংবা এটাও ধরুন যে, মাটি কাটছে একজন রোবট শ্রমিক, তাকে কি আপনি করবে বলবো? কিংবা, এই রোবট শ্রমিক কি আমাদেরকে তুই করে বলতে পারবে?

আজিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজ যারা পড়েছেন, তারা দেখবেন সিরিজের ‘প্রিলিউড টু ফাউন্ডেশন’ বইতে হ্যারি সেলডন যখন চ্যাটার হামিনের প্রভাবে এবং ডেমারজেলের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, একদম শেষ দৃশ্যে হ্যারি সেলডন যখন বুঝতে পারে চ্যাটার হামিন বা ডেমারজেল এবং আর. ডানীল আলীভো মূলত একই ব্যক্তি এবং সেটি হচ্ছে একটি রোবট, তখন হ্যারি সেলডন জিজ্ঞাসা করেন, 'কারণ তুমি আসলে মানুষ নও, হামিন/ডেমারজেল, তাই না? তুমি রোবট।'

ডেমারজেল রোবট এবং হ্যারি সেলডন একজন মানুষ/বড় বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর পরস্পরকে প্রথমে আপনি ও পরে তুমি করে সম্বোধন করেছেন। এমনকি হ্যারি সেলডন যখন বুঝতে পারলেন যে, ডর্স ভেনাবিলিও একজন রোবট, তখনও তিনি পূর্বের মতোই ডর্সকে সম্মান করেছেন, বিয়ে করেছেন। সম্বোধনও পূর্বের মতোই ছিলো।

মানুষ ও কম্পিউটারের ভাষিক সম্পর্ক, আরও বিস্তৃত পরিসরে বললে, মেশিন ও মানুষের ভাষিক সম্পর্ক, বাংলা ভাষায় কী হবে সেটা সম্ভবত একটা বড় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনও হতে পারে, মেশিনের মধ্যেই একটা শ্রেণি-অবস্থান তৈরি হতে পারে। বেতনের হিসেবে সম্পর্ক ঠিক করা হলে এমনও হতে পারে, যেসব মেশিন (ধরা যাক, রোবট) গ্রেড ১ থেকে গ্রেড ৬ পর্যন্ত রোবটকে আমাদের আপনি করে বলতে হতে পারে, গ্রেড ৭ থেকে ১৩ পর্যন্ত রোবটকে তুমি করে বলা যাবে এবং গ্রেড ১৪ থেকে গ্রেড ২০ পর্যন্ত রোবটকে তুই করে বলা যেতে পারে। এমনও হতে পারে, গ্রেড ১-এর রোবট গ্রেড ৮-এর রোবটকে তুমি করে এবং গ্রেড ১৭-এর রোবটকে তুই করে বলছে। কিংবা, গ্রেড ৯-এর রোবট গ্রেড ৩-এর রোবটকে আপনি করে বলছে, যদিও হয়তো প্রোডাকশনের হিসেবে গ্রেড ৯-এর জন্ম গ্রেড ৩-এর আগে। হয়তো এভাবেই তখন নির্দেশ জারি করা হবে। ক্ষমতা কাঠামোর সাথে মিল রেখেও সম্বোধনরীতি তৈরি করা হতে পারে।

কথাগুলো হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু ২০/৩০ বছর পর যদি বেঁচে থাকেন, কথাগুলোকে মিলিয়ে নিবেন। আমাদের সাহিত্যিক ও অনুবাদকেরা রীতিমতো এই ‘তুই-তুমি-আপনি’ নিয়ে বাহাসে জড়াবেন। আমরা উভয় পক্ষের কথা শুনে মাথা নেড়ে বলবো, ‘সবার কথাতেই যুক্তি আছে’। এ-বিষয়ে বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা রীতিমতো কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যাবো।

তবে, ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, জগতের সকল মানুষ ও মেশিন সুখী হোক।

৩৬৮ পঠিত ... ১৬:১৭, মে ১৪, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top