এসেছে নতুন সেলেব, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান

৬০৩ পঠিত ... ১৭:২২, মার্চ ২২, ২০২২

Celebrity

 

এলগরিদম শাসিত পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই ঘটতেছে যা আগেকার পৃথিবীর মানুষ কল্পনাও করতে পারে নাই। যেমন: আপনি কোনো সেলেব্রিটির বিগ ফ্যান, -ডাই হার্ড ফ্যান- কেবল এই একটা পরিচয়েও আপনি সেলেব্রিটি হতে পারেন। শুধু ফ্যান হয়াও যে সেলিব্রিটি হওয়া যায় বর্তমান যুগের পূর্বে  পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর নাই।   

ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

এরকম গুরুতর একটি শ্রেণির অস্তিত্ব আছে অথচ তাদের পরিচায়ক কোনো নাম নাই; তাও ইন্টারনেটের সর্বব্যাপ্তির এই যুগে! বর্তমানে সংখ্যায় অল্প হইলেও যেকোনো সমাজে, ডিজিটাল কালচারের ডাইনামিক্সে এদের কিন্তু ভূমিকা আছে এবং দিন দিন সেই ভূমিকা বাড়তে থাকবে৷ কারণ এই শ্রেণি সদা ক্রমবর্ধমান। এই লেখা নতুন এই গজায়মান শ্রেণিকে নিয়ে।    

যতদূর জানি, ইংরেজিতে গজায়মান এই শ্রেণির পরিচায়ক কোনো শব্দ নাই। অনেক রকম কি-ওয়ার্ড দিয়া খুজেও ইংরেজিতে এই শ্রেণি নিয়া কোনো লেখা বা নামের সন্ধান আমি পাই নাই। ফলত, পপ কালচারে উৎসাহী একজন ভাষাপ্রেমী হিসাবে, নতুন শব্দ সৃষ্টি করাকে ঈমানী দায়িত্ব হিসাবে নিলাম। তাছাড়া আমার একটা স্বপ্ন  জীবদ্দশায় বাংলা ভাষায় অন্তত শ' খানেক নতুন শব্দ বানায়ে যাবো।

আপাতত ২টা শব্দ প্রস্তাব করি। নাম দুইটা বাংলা ও ইংরেজিতেও একই।

১. ফ্যানেব্রিটি 

২. ফ্যানেব

ফ্যানেব্রিটি হইলেন এমন ফ্যান যিনি নিজেই একজন সেলেব্রিটি। ফ্যান+ সেলেব্রিটি= ফ্যানেব্রিটি অর্থাৎ নতুন শব্দগঠনের সবচে  সহজ পদ্ধতিতে  শব্দটি  বানানো হইলো। ভাষাতত্ত্বে এই পদ্ধতির নাম পোর্টম্যানটো, বাংলায় 'পিণ্ডারিশব্দ'।   

ফ্যানেব শব্দটা ইংলিশ শব্দ সেলেব-এর অনুসরণে তৈরি। আমাদের দেশে ফ্যানেব্রিটির চাইতে 'ফ্যানেব' সম্ভবত কম রিলেটেবল। কারণ সেলেব- এর চাইতে সেলেব্রিটি শব্দটা দেশে বেশি প্রচলিত। আমি কিন্তু  ফ্যানেব-এর পক্ষেই ভোট দেবো। ছোট, পাঞ্চি শব্দ আমার পছন্দ। তাছাড়া ভালো জিনিস তো চালু করতে হবে, নাকি? এই লেখার বাকি অংশে তাই আমি ফ্যানেব ও সেলেব শব্দ দুইটা ব্যবহার করবো।  

 

ফ্যানেব ও সেলেবের সম্পর্ক

ফ্যান হয়েই যিনি সেলেব তাকেই আপাতত আমি বলতেছি ফ্যানেব। অর্থাৎ তিনি যে সেলেব হইছেন, তার প্রধান বা অন্যতম কারণ তিনি কোনো বড় সেলেবের ফ্যান- বিগ ফ্যান। ফ্যানেবের স্বভাব-চরিত্র বুঝতে আমাদেরকে বুঝতে হবে ফ্যানেব ও সেলেবের মধ্যকার সম্পর্ক।  

তো, ফ্যানেব ও সেলেবের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন?

এক কথায়, ফ্যানেব ও সেলের সম্পর্ক  সিমবায়োটিক - এক ধরনের মিথোজীবিতার সম্পর্ক। যেকোনো মিথজীবিতার সম্পর্কে সদস্যরা একে অপরকে পরিপুষ্ট করে; পরস্পরের জন্যে কাজ করে।  

এক্ষেত্রে ফ্যানেব নিজেই একজন ক্ষুদ্র সেলেব হওয়ায় একসঙ্গে  দুইটা কাজ করে। নিজের ফ্যানদের  মধ্যে বিগ সেলেবের প্রতি ভক্তি ও 'কারণ' উৎপাদন করে। এই অর্থে, ফ্যানেবরা সেলেবদের নিয়ে অরিজিনাল কন্টেন্ট তৈরি করে।

অন্যদিকে, বিগ সেলেবরাও ফ্যানেবদেরকে পরোক্ষে প্রমোট করে, কারণ ফ্যানেবরা প্রতিনিয়ত  নতুন নতুন ফ্যান নিয়া আসে। আর বিগ সেলেবের প্রতিনিয়ত নতুন ফ্যান দরকার। সংখ্যাটা যত বিশালই হোক, ফ্যানদের একটা বড় অংশ কিছু দিন পরেই আগ্রহ হারায়ে, ইনেফেক্টিভ, নন-এঙ্গেইজড হয়া পড়ে। ফলে বিশাল ফ্যানবেজে নিয়মিত নতুন নতুন ফ্যান ইঞ্জেক্ট করা জরুরি। ফলে এই  মিথোজীবিতা সেলেব ও ফ্যানেব উভয়ের জন্যেই এক রকম 'উইন-উইন' অবস্থা৷  

 

ফ্যানেবের মোডাস অপারেন্ডি ও ভবিষ্যৎ

ফ্যানেব হওয়া তুলনামূলক সহজ। যদি বাজারে কিছুমাত্রায় প্রতিযোগিতা আছে কিন্তু  হিসাব করে কৌশল ঠিক করা জটিল ব্যাপার না। তাছাড়া ফ্যানেবের ( এক্ষেত্রে এ্যাসপায়ারিং ফ্যানেবের) একটা সুবিধা হইতেছে, তার কন্টেন্টের বিষয়ে সবসময়ই পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ আছে; যেহেতু বিগ সেলেব তার কন্টেন্টের বিষয়। বিগ সেলেবদের ফ্যানবেইজ এত বিশাল যে তাদেরকে নিয়ে কিছু বললেই পাব্লিকের মনোযোগ পাওয়া যাবে। (মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সেলেবদের নিয়া যত বেশি সম্ভব নিউজ পাব্লিশ করে। কেন করে? ঠিক একই কারণে। সেলেবদের নিউজ করলেই অডিয়েন্সের এটেনশন পাওয়া যায়।) 

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুই-একটা উদাহরণ দিতে পারি।

আমি ব্যক্তির নাম নেবো না। ব্যক্তি এক্ষেত্রে আমার আগ্রহের কেন্দ্র না। বরং ব্যক্তির আচরণে যে প্যাটার্ন ও প্রবণতা দেখি, -প্রায়শ যা আসলে  সামষ্টিক প্রবণতার প্রতিফলন-, আমার আগ্রহ সেইখানে। আমি একজন জনপ্রিয় ফিকশন রাইটারকে চিনি মেসিকে নিয়ে যিনি প্রতিনিয়ত লিখে যান। তার লেখা গভীরভাবে খেয়াল করে দেখেছি তিনি ফুটবলের ফ্যানও না আসলে। খালি মেসিকে নিয়ে লিখেন; 'জাদুকর' মেসিকে নিয়ে লেখেন। কেন লেখেন?

উত্তরটা অনুমান করা কঠিন না। মেসির বিশাল ডাই-হার্ড ফ্যানবেজ থেকে তার নিজের দিকে কিছু অডিয়েন্স নিতে চান; ট্রাফিক ডাইভার্শন।

আমি সাকিব আল হাসানের এমন ফ্যানেব দেখছি। জয়া আহসানের ফ্যানেব দেখছি।  আপনি চোখ কান খোলা রাখলে এমন ফ্যানেব  আশেপাশেই  প্রচুর দেখবেন। আমার মায়োপিক চোখে মনে হইছে, বাংলাদেশের ফ্যানেবদের সংখ্যা ক্রীড়া ও বিনোদন সাংবাদিকদের মধ্যে সবচে বেশি। এই ফ্যানেবরা অনেক সময় সাংবাদিকের চেয়ে পিআর-এর  ভূমিকা বেশি পালন করে। এইসব কর্মকাণ্ড ভালো না মন্দ-এই নৈতিক আলাপে না গিয়ে তাদের কর্মপদ্ধতিটা আমি বুঝতে চাই। 

অদূর ভবিষ্যতে ফ্যানেবদের সেলেবের পিআর-এর ভূমিকা নেয়ায় আরেকটা অনিবার্য ঘটনা ঘটবে। সেলেব-ফ্যানেবের সম্পর্কের বিবর্তনে, অনেক ট্রায়াল-অ্যান্ড-এররের পরে, একটা পর্যায়ে দেখা যাবে অনেক ফ্যানেব তার সেলেবের এজেন্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ সেলেবের পাব্লিক ও কমার্শিয়াল অনেক সিদ্ধান্ত ও লেনদেনের অংশ হয়ে উঠবে ফ্যানেব। সেলেবের কাছে পৌছাতে চাইলে  ফ্যানেবের ভায়া হয়ে যেতে হবে। আর সেলেব-ফ্যানেবের মিথোজীবিতা এই পর্যায়ে যখন পৌছে যাবে, ততদিনে দেখা যাবে ফ্যানেব নামে একটা পেশাজীবী তৈরি হবে; অর্থাৎ এখনকার সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের মতো তারাও মাইক্রো সেলেব হয়ে উঠবেন এবং এটিকে কেউ কেউ জীবিকা হিসেবে বেছে নেবেন।  

সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকটিভ থাকলে, জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে, আপনি একজন অ্যাটেনশন মার্চেন্ট। মনোযোগের, অডিয়েন্স আইবলের সওদায় নামছেন আপনি। আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রত্যেকেই একেকজন এটেনশন মার্চেন্ট। ফলে নাম্বার কাউন্টস, নাম্বার ম্যাটার্স। লাইক, কমেন্টস, শেয়ার> অডিয়েন্স রিচ> কালচারাল ও ফিন্যানশিয়াল ক্যাপিটাল- এই ধারাক্রমে অনলাইন গেইমটা চলে।

ইনফ্লুয়েন্সার ইকোনমি এখনও শৈশবে। মেটাভার্স টাইপ  শব্দ হয়তো এখনও গালভরা শোনায়, কিন্তু আগামীর পৃথিবী মূলত ভার্চুয়াল জগত-নির্ভর হইতে যাইতেছে৷ এই লেখা মেটাভার্স নিয়া না; কিন্তু প্রাসঙ্গিক দুই-একটা কথা বলে নিলে ইনফ্লুয়েন্সার ইকোনমি বুঝতে সুবিধা হবে। 

প্রথমত যেটা বোঝা দরকার: মেটাভার্স প্লেস না, মেটাভার্স টাইম। 

 আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এ সিঙ্গুলারিটি বলে একটা আইডিয়া আছে। এইটা সেই মূহুর্ত যখন এআই মানুষের চেয়ে স্মার্ট; যখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইজ গ্রেটার দ্যান হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স। 

মেটাভার্স সময়ের সেই মুহূর্ত যখন আমাদের ডিজিটাল জীবন, আমাদের ফিজিক্যাল জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্ববহ। এই অর্থে মেটাভার্স প্লেস না, মেটাভার্স মূলত সময়।

এইটা রাতারাতি কোনো রুপান্তর না। হুটহাট কোনো আবিষ্কারও না। এইটা গ্র্যাজুয়াল চেঞ্জ যা গত বিশ বছর ধরে ঘটতেছে। এবং দিন দিন আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশ ডিজিটাল হইতেছে৷

উদাহরণ দিই: 

কাজ- চলে যাইতেছে ফ্যাক্টরি থেকে ল্যাপটপে; বোর্ডরুম থেকে জুমে।

বন্ধু- প্রতিবেশি থেকে ফলোয়ার। সমমনা লোকদের আপনি কোথায় খুজে পান এখন? ফেসবুকে, টুইটারে, রেডিটে বা ইন্সটাগ্রামে।

গেইমস- ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্য যেকোনো আউটডোর গেইমের চে এখন বিশ্বজুড়ে ছেলেমেয়েরা কয়েকগুণ বেশি খেলে ভিডিওগেইম। 

আইডেন্টিটি- মেকাপের নতুন নাম ফিল্টার। আপনার নিজেরে ব্রডকাস্ট করার পারসোনাল বিলবোর্ড হইতেছে এখন ‘স্টোরিজ’। 

কোনটা বেশি ম্যাটার করে? রিয়েল লাইফে আপনি দেখতে কেমন সেইটা নাকি সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখতে কেমন সেটা? 

উত্তরটা আপনার না জানার কথা না৷

সবকিছু ডিজিটাল হইতে যাইতেছে: আপনার বন্ধুবান্ধব, আপনার চাকরি, আপনার আইডেন্টিটি। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির আগমনের ফলে আপনার সম্পদও হইতে যাইতেছে অনলাইন।

এইভাবে যত দিন যাবে সমাজের, জীবনের সর্বস্তরে ডিজিটাল ইনফ্লুয়েন্সারদের ভূমিকা ও প্রভাব তত বাড়তে থাকবে। পশ্চিমে এমনকি বাংলাদেশেও (যদিও আকারে ছোট) অলরেডি একটা প্রফেশনাল, ফুল-টাইমার ইনফ্লুয়েন্সার ক্লাস তৈরি হইছে।

আমার ধারণা, এমনটা হওয়াও অসম্ভব নয় যে, একসময় প্রত্যেকটা মিডিয়া কোম্পানি হয়ে যাবে ই-কমার্স। আর প্রত্যেকটা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে মিডিয়া কোম্পানি। হাইপার-কানেক্টিভিটির ডিজিটাল জামানায় ফেইমের ফিউচার মূলত ফ্যান। আর এমন অর্থনৈতিক জলবায়ুতে ইনফ্লুয়েন্সার আর পিআর-এর মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা ফ্যানেব নামক মাইক্রো সেলেব ক্লাসের ভূমিকাও দিন দিন আরও ডিসাইসিভ হয়া উঠবে।  

৬০৩ পঠিত ... ১৭:২২, মার্চ ২২, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top