সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সমীর রায়চৌধুরীর চিঠি

৩০১ পঠিত ... ১৬:৩৬, জানুয়ারি ১৬, ২০২২

shuneel-chithi-

 ২০/৫/১৯৬৩

সুনীল,   

তোর দীর্ঘ চিঠি পেলাম। তোর মানসিক অবস্হা জেনে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছি। শক্তিকে আমরাই এত বড় করে তুলেছি। এর মূল দায়িত্ব তোর, আমার ও মলয়ের। এবং এখনও আমার প্রতিটি বন্ধুকে বড় করেই তুলতে চাই আমি। শক্তিকে লেখার জন্য প্রাথমিক উৎসাহ তুইই দিয়েছিলি। বারেবারে বাহবা দিয়ে ‘বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি’ একথা তুইই প্রথম তুলেছিস। অর্থাৎ শুধু এই যে আজ শক্তি সেকথা নিজে বলছে। চাইবাসায় থাকতেই তোকে বাদ দিয়ে শিল্পের সিংহাসনে বসার একটা ঘোরতর প্ল্যান উৎপল ও শক্তি অনেকদিন আগেই করেছিল। আমাকেও উপস্থিত থাকতে হয়েছিল এই সব আলোচনায়। পত্রিকা বের করার প্ল্যান তখনই হয়। আন্দোলনের ব্যাপারটাও মলয় বারবার তাগাদা দিতে থাকে। আমি বরাবরই কৃত্তিবাসকে ছাড়তে পারব না জানিয়েছি। নানান সেন্টিমেন্টাল কারণে কৃত্তিবাসকে আমি আমার নিজের পত্রিকা মনে করি। অনেকের মতন ‘সুনীলের কাগজ’ মনে করা সম্ভব নয়। শক্তি ও উৎপল তোকে বাদ দিয়ে ‘জেব্রা’ বার করতে পারবে কিনা মনে হয় না। অন্তত মলয় এটা হতে দেবে না। তাছাড়া সমস্ত নীচতার মধ্যেও সূক্ষ্ম বোধশক্তির দংশন শক্তিও এড়াতে পারবে না। আমাদের মধ্যে একটা ভাঙন গড়ে উঠবে এ আমার বিশ্বাস হয় না। হলে শক্তিরই প্রচণ্ড ক্ষতি হবে। টাকাপয়সার দরকার ওর শিল্পের জন্যও, শীলাও আছে, দার্শনিক ঋণও প্রয়োজন, সমীর ও মলয়কে ও সেইসঙ্গে সুনীলকে বাদ দিলে যে মারাত্মক অবস্হায় ও পড়বে তা ও জানে। আমাকে শক্তি লিখেছে ‘জেব্রা’য় তোর লেখা থাকছে। বেরোতে নাকি মাস দুয়েক দেরি। বরং উৎপলই একটু বেশিমাত্রায় তোর বিরোধী। হয়তো ঈর্ষা, হয়তো অন্য কোনো কারণ। উৎপলকে খুশি রাখতে গিয়ে হয়তো এই সব জটিলতায় শক্তি বাধ্য হচ্ছে। মলয়ের অভিমান এই যে তুই ওকে বিন্দুমাত্র স্নেহ করিস না; নিতান্ত ছেলেমানুষী। সেবার শীলা পাটনায় ভর্তি হতে গেলে শক্তিকে পাটনায় নিয়ে যাই আমি। সেখানে মলয় ওকে এই আন্দোলন সম্পর্কে Convince করে। ছোটোগল্পে লিখেছে যে গল্পটা, তারই প্লট ও প্ল্যান মলয় শক্তিকে দেয় (ক্ষুৎকাতর আক্রমণ)। ঠিক হয় যে কলকাতায় গিয়ে পুস্তিকা বের করে ব্যাপারটা আরম্ভ হবে। আমরা সবাই থাকবো। তুইও নিশ্চয়ই । আমাদের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা না করেই শক্তি কলকাতায় ফিরেই ব্যাপারটা আরম্ভ করে দেয়। এদিকে ট্রেনিং-এ চলে আসতে হয় আমাকে। মলয় পাটনায়। কলকাতায় শক্তি একা নানানভাবে নিজের স্বপক্ষে সিংহাসন গড়ে তোলে ক্রমে। তুই ব্যাপারটায় যোগ না দেওয়ায়, যেটা ভুল-বোঝাবুঝিতে পেছিয়ে গেছে, আজ অবস্থা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা মলয়ও বলেছেত। মলয় এখন যে কোনো রকমে তোকে চায় । ফলে হয়তো তোকে এই ধরনের আক্রমণ চালাচ্ছে। অদ্ভুত সব জটিলতা। ‘ক্ষুধার্ত’ নামে একটা কবিতা সংকলন বার করতে চায় ও। আমাকে লিখেছে তোকে পদ্য পাঠাতে বলতে। ব্যাপারটা নিজেই সম্পাদনা করতে চায়, শক্তির জটিলতা এড়িয়ে। সন্দীপনও বোধহয় একটা গদ্য সংকলন বের করবে। আমি ‘চিহ্ণ’, ‘ছোটগল্প’ ও ‘জেব্রা’র জন্য ছোটগল্প পাঠিয়েছি ওদেরই অনুরোধে।

খ্যাতির প্রতি শক্তির প্রলোভন চিরদিনই আছে। ওর পরিবেশ অনুযায়ী হয়তো এটা স্বাভাবিক। আসলে মানুষ না হয়েই শিল্পী হওয়া যায়, এটাই যতো গণ্ডগোলের। ছোটোলোক, নীচ ও চোরও শিল্পী হতে পারে। শিল্পী হওয়ার জন্য বরং এসব ব্যাপার সাহায্যই করে। ফলে বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্ব নিয়ে গণ্ডোগোল বাধে।

এক মুহূর্তেই হয়তো শক্তির সমস্ত দম্ভ, অহংকার, নীচতা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায় বাংলাদেশের কাছে। এর উপযুক্ত নজিরের অভাব নেই আমার কাছে; কিন্তু শক্তির বিরুদ্ধে বা কারোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনোদিন। আমার কতকগুলো নিজস্ব আদর্শ আছে, তা ভুল বা ঠিক হোক আমি তা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই। প্রতিক্রিয়া হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।

কৃত্তিবাসের জন্যও তোর যে আদর্শ, তাকে ধরে রাখতে হবে তোকে, আশপাশের কারো চিৎকারে বিব্রত হওয়ার কিছুই নেই। কৃত্তিবাস আমরা বের করে যাবোই। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসি। শক্তি শিল্পী হিসেবে অনেক বড়ো ও মানুষের চেয়ে শিল্পকে অনেক অনেক বড়ো মনে করে। আমি শিল্পকে পৃথক মনে করতে পারি না।   

প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক হওয়াই স্বাভাবিক এবং উচিতও। শক্তি বা উৎপলের মতো কবিতা না লিখলে কবি নয়, এসব ছেলেমানুষীতে আমি বিশ্বাস করি না। শক্তির কিছু-কিছু কবিতা যেমন আমাকে উন্মত্ত  বিহ্বল করে, অলোকরঞ্জনের কোনো কোনো কবিতায় আমি তেমনই প্রস্ফূট হয়ে যাই । সেই মুহূর্তে অলোকরঞ্জনকে আমার সমস্ত স্বত্তার মালিক মনে হয় । কী করে তাকে অস্বীকার করি? তেমনই হয়তো এমনও কেউ আছেন যাঁর তারাপদর পদ্যে আরোগ্য হয়। এসব শ্রেষ্ঠত্ব স্থির করার আমরা কে? যারা কবিতা পড়েন তাদের ওপরই, সময়ের ওপর, এসব ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের ঢাক ঢোল নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কি যে সুখ আমি বুঝি না। এসব চালিয়ে গেলে শক্তি অনেক বড়ো ভুল করবে। যতো বড়ো হতে পারে ও তাকে নিজ হাতে খর্ব করবে। হয়তো অ্যালেনের বিশ্বজোড়া নাম দেখে ও কিছুটা উত্তেজিত হয়েছে। একথা শক্তি কয়েকবার বলেওছে আমাকে।

জুনে পনেরো তারিখে এখান থেকে রওনা হয়ে সতেরো তারিখে চাইবাসা পৌঁছোব। তুই আয় না তখন। শক্তিকেও আসতে বলব। একসঙ্গে তিনজন থাকলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে যাবে আপনা থেকেই। চারিদিকে বেড়িয়ে বেড়ানো যাবে। বেলাও বেশ সুস্হ হয়ে উঠেছে।

চিঠি দিস । হাংরি জেনারেশনের বিরুদ্ধেই না হয় কয়েকটা প্রচণ্ড গদ্য ও পদ্য লেখ। হাংরি জেনারেশনের একটা বিশেষ পুস্তিকায় বের করব আমি; মলয়ও রাজি হবে । আসলে এই সব আন্দোলনের চেয়ে হৃদয়ের আন্দোলনটাই আগে দরকার।

সারা জীবন একাকীত্বের দুর্ভোগ হয়তো এভাবেই আত্মসাৎ করে যেতে হবে আমাকে। তবু এবং হয়তো এই জন্যেই শিল্পের চেয়ে আমি মানুষকে পৃথক করতে পারি না, বড়ো মনে করার বা ছোট মনে করার কারণ খুঁজে পাই না।

সমীর রায়চৌধুরী

৩০১ পঠিত ... ১৬:৩৬, জানুয়ারি ১৬, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top