রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও চুল-দাড়ির এস্থেটিকস

৩০৩ পঠিত ... ১৩:১৪, অক্টোবর ০২, ২০২১

Rabindra-university-and-chul-dari-thumb

আপনি আর আপনার বন্ধু একদিন রাস্তায় হাটতে বের হইলেন। আলাদা আলাদাভাবে। মনে করেন,, প্রচন্ড গরম। কারণ হিসেবে মহাত্মা লোডশেডিং আপনার এলাকায় বিরাজমান-এমনটাও ধরে নিতে পারেন।
আপনার বন্ধু, খুব ফিটফাট। সুটেড-বুটেড। ক্লিন শেইভড। এক কথায়, ওয়েলগ্রুমড এবং অবশ্যই ফর্সা অর্থাৎ ধলা।
আর আপনি আপনার বন্ধুর ঠিক পোলার অপজিট। আউলাঝাউলা চুল, ভাজপড়া এলোমেলে পোশাক। ময়লা হলে তো আরো ভালো। তোফা। আর অবশ্যই আপনার গায়ের রঙ কালো।
তো, গল্পে যেমন হয়, হঠাৎ পুলিশ চলে আসলো সামনে। কী মনে হয়, দুই বন্ধুর মধ্যে কাকে ‘হিরোইঞ্চি’ বলে সন্দেহ করার চান্স বেশি পুলিশের?
অবশ্যই আপনাকে।
পুলিশের এইরকম সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু ব্যাখ্যা হাজির করা যাইতে পারে।
কোনো কিছু সম্পর্কে জাজমেন্টে/ সিদ্ধান্তে যাওয়ার জন্যে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকলে হিউম্যান মাইন্ড কিছু শর্টকাটের সাহায্য নেয়। এই মেন্টাল শর্টকাটগুলিকে সাইকোলজিস্টরা বলেন হিউরিস্টিকস। এমন না যে এই শর্টকাটগুলি সবসময় পারফেক্ট রেজাল্ট দেয়, লিমিটেশন আছে এদের যথেষ্ট।
তো, স্ট্রেঞ্জার আপনাকে রাস্তায় একজন ব্যক্তি (বা পুলিশ) দেখে কিছু ইন্সটান্ট জাজমেন্টে চলে যায়। যেকোন মানুষই তাৎক্ষণিক এইরকম কাজ করে অহরহ। পুলিশের হিউরিস্টিক তাকে বলতেছে আপনার ‘হিরোইঞ্চি’ হবার চান্স বেশি।
মানুষের এপিয়ারেন্স সবসময়ই রিয়ালিটির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
এইসব জিনিস মনে আসলো সাম্প্রতিক সময়ে আমার মাথার চুল নিয়ে কিছু মানুষের রিয়্যাকশন দেখে।
আগে মাথার চুল ছাটানোর ক্ষেত্রে আমার অলিখিত নিয়ম ছিলো, কানের কাছের চুল বড় হয়ে কানের মধ্যে ঢুকে সুরসুরি দিয়ে ঘুম ভাঙায়ে দিলে সিদ্ধান্ত নিতাম, চুল ছাটার সময় হইছে।
এইবার সেই নিয়ম অগ্রাহ্য চুল যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইছি।
মুরুব্বীগোছের কেউ কেউ মুখ ফুটে বলছে (ভালোর জন্যেই হয়তো বলছেন তারা), কী ব্যাপার গুন্ডাদের মতো চুল বড় রাখছো ক্যান?
আবার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ বলছে, প্রবলেম কী? এতো বড় চুল! লাগে তো একদম গুন্ডাদের মতো!
(বন্ধুস্থানীয়ই মূলত) কেউ বলছে, কিঈঈঈ! কবি কবি লুক যে! ব্যাপার কী দাদা/দোস্ত? হে হে।
আমিও তাদেরকে ফট করে বলি, দাদা/দোস্ত, সারাদিন ড্রাগ-এর উপ্রে থাকি ইদানিং। তাই ম্যাচ করে এই চুলের স্টাইল।
তারা হাসে। কথা যে বিশ্বাস করে তাও না। কিন্তু তাদের রিয়্যাকশন অত্যন্ত সুক্ষ্ণভাবে খেয়াল করে দেখছি, তাদের চোখ-মুখের ভাষা বলে, হইতেও তো পারে! বলা যায় না কিছুই!
অথচ আমার চুল যখন ‘নরমাল’ তখন এই ‘হইতেও তো পারে’ তাদের মনে উঁকিও দিতো না কখনো আমার ক্ষেত্রে। এপিয়ারেন্স ম্যাটার্স।
এই ‘গুন্ডার মতো’ বা ‘কবি কবি’ লাগা হইতেছে যথাক্রমে ‘গুন্ডা’ ও ‘কবি’র স্টেরিওটাইপ। ক্যারিকেচার। বলা যাক, কোনো কিছু সম্পর্কে কার্টুন-পারসেপশন।
কবির স্টেরিওটাইপ মোটামুটি নেকু নেকু, পাঞ্জাবি/ফতুয়া-পরা, উদাস, আলাভোলা ব্যক্তি। বোনাস হিসেবে কাধে একটা ঝোলা থাকতে পারে।
‘গুন্ডার’ স্টেরিওটাইপ আরও মজার। গুন্ডা মানে লম্বা চুল, হাতে-গলায় চেইন। চেহারা 'বদখত'। অস্ত্র-শস্ত্র বাদ দিলাম। আর অতি-অবশ্যই গায়ের রঙ ‘কালা’ (কালো নয় কিন্তু। কালা!) কুচকুচে কালা। এই ‘কালাত্ব’ যেকোন গুন্ডার নাম্বার ওয়ান ফিচার। কালো রঙ বিষয়ে আন্ডারলায়িং এ্যাজাম্পশনে লুকায়িত রেইসিজমের কথা বলবো না। যেহেতু ইতিবাচক হওয়ার চেষ্টা করতেছি। সো, নো নেতিবাচকতা।
আপনি সিনেমায় টিভিতে কোনো 'সুদর্শন' তো দূরের কথা এমনকি নিতান্ত কোনো ফর্সা চেহারার গুন্ডাও দেখবেন না। হলিউডে তো বহুবছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গরাই শুধু ভিলেনের রোল পাইতেন। যাহোক, সোনার বাংলায় ফিরে আসি।
তো, রিয়েল লাইফেও নাটক সিনেমার ভিলেনের রেপ্রিজেন্টেশনের প্রভাব আছে মনে হয়। ঐ ভিলেনদের মতো বা তাদের লুকের কাছাকাছি লুকের ব্যক্তিকে প্রায়শ ইভল বলে ধারণা করা হয়।
আর ফিটফাট, ছোট করে কাটা চুলের ব্যাপারে এইরকম পারসেপশনের অনেকগুলি কারণের একটা হিসেবে আমার স্পেকিউলেশন হইতেছে, কর্পোরেট গ্ল্যামার এবং প্রধানত আর্মি। আর্মি দেখে আৎকে উঠবেন না। আর্মিকাট/ছাট নামে সেলুনে এক ধরণের হেয়ারকাট অনেকদিন প্রচলিত আছে এমনিতেই।
সমাজের ডমিন্যান্ট ও ক্ষমতাধর প্রকৃত তারাই যাদের বিষয়ে তেমন আলাপ করতে দেখা যায় না। দেখবেন সমস্ত কিছু নিয়া ট্রল আছে, শামীম ওসমান থেকে শুরু করে চোরপরেশন নিয়া। আর্মি নিয়ে আপনি ট্রল খুজে পাবেন না এদেশে। এমনকি ব্লাসফেমির ঝুকি সত্ত্বেও রিলিজিয়ন নিয়েও ট্রল পাবেন কিন্তু আর্মি নিয়ে পাবেন না।
[পাবেন না তার কারণ আছে। ট্রল বা ফান করার জন্যে ‘বাট’ (বাট অফ দ্য জোক/যাকে নিয়ে ট্রল করা হয়)-কে কোনো না কোনো এ্যাসপেক্টে ইনফিরিঅর হিসেবে পারসিভ করা লাগে। নইলে সাধারণত তাকে নিয়ে জোক করা যায় না। হিউম্যান মাইন্ড পারে না। হিরো আলমরে নিয়ে ট্রল করা যত সহজ, পাওয়ার/ কালচারাল এলিটকে নিয়ে ট্রল করা অতো সহজ না। করতে গেলে সচেতনভাবে জোর করতে হয়।
শুধু ফান না, ফ্যান্টাসিরও সীমাবদ্ধতা আছে এইসব ক্ষেত্রে। মনে পড়ে, শাহাদুজ্জামানরে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘তুমি কিন্তু চাইলেই রানী এলিজাবেথকে কল্পনা করে মাস্টারবেট করতে পারবে না। কল্পনারও রেঞ্জ থাকে। দেখা যাবে অন্তিম মূহূর্তে সেখানে চলে আসবে অন্য কারও মুখ’।
আর্মি নিয়ে ট্রল করতে গেলে এইরকম মেন্টাল রিজিডিটি ভেঙে করা লাগবে। এইজন্যে তনু হত্যার মতো নারকীয় ঘটনা ঘটানোর পরেও সেনাবাহিনী নিয়ে কোনো ট্রল আপনি দেখবেন না। ধর্ষণ নিয়া ট্রলের কথা বলতেছি না। জাস্ট বলতেছি আর্মি নিয়া কোনো ট্রল না থাকাটা কি সিগনিফাই করে। অথচ অন্যান্য ইস্যুতে ক্ষুব্ধ নাগরিক কিন্তু ট্রলের বন্যা বসায়।]

অনেকদিন ধরে নির্দিষ্ট পাওয়ার-স্ট্রাকচার বলবৎ থাকলে, কালচারে, ট্র্যাডিশনে, পাবলিক-পারসেপশনে এমন কিছু প্রভাব রেখে যায়, যার বাইরে পাবলিকরে অন্য কিছু পারসিভ করানো বেশ কঠিন। (আমি একাডেমি অপছন্দ করি, নইলে হেগেমনি (হেজিমনি)-টনি, গ্রামসি, আলথুসার, পিইয়ের বুরদিও, সিম্বলিক পাওয়ার, এইসব নামটাম বলে এই বিষয়ে পাঠকের সমীহ আদায় করে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ধরা যাইতো।)
এখানকার ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ছোট করে ছাটা চুল, পলিশড হওয়াটা ভদ্রস্থ হওয়ার লক্ষণ। বিপরীত হইলে হিরুইঞ্চি, গুন্ডা, ভাদাইম্যা ইত্যাদি। পশ্চিমের সমাজে, (ধরা যাক মার্কিন, বিট জেনারেশনের মতো নানা সোশিও-পলিটিকাল মুভমেন্ট হওয়াতে), ধারণা করি, এইসব বিষয়ে সমাজে ফ্লেক্সিবিলিটি তুলনামূলক বেশি।
ছোট চুলরে ভদ্রস্থ ও ডিসিপ্লিনের সাথে মিলায়ে দেখার একটা প্রবণতা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এইটা শীঘ্রই বদলাইতেছে বলে মনে হয় না এখানে।
তো, আপনি যদি কোনো ক্রাইম ঘটাইতে যান, টিপ-টপ হয়ে বের হন। মাথার চুল অবশ্যই ছোট রাখবেন। ধরা পড়ার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কমে আসবে।
আর যদি আপনি ‘কালা’ হন, নির্দোষ হইলেও (অবশ্য সোনার বাংলায় নির্দোষ হওয়াটাও একটা ক্রাইম, আই গেস! ) কম্পারেটিভলি কিছুটা ঝুকিতে আছেন। ফিটফাট থাকতে চেষ্ট করতে পারেন। ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখায়ে ফেইসটারে লাভলি বানায়ে ফেলতে পারেন!

৩০৩ পঠিত ... ১৩:১৪, অক্টোবর ০২, ২০২১

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top