স্বাধীন গণমাধ্যম যেভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে

৫৮১ পঠিত ... ২০:৪২, মে ১৮, ২০২১

gonomaddhom-rashtro-nirapotta

বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও আলোচিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের একটি হিসেবে বিবেচিত হয় পেন্টাগন পেপার্স সংক্রান্ত নিউ ইয়র্ক টাইমসের সিরিজ প্রতিবেদন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ অব্যাহত রাখার স্বপক্ষে পূর্বতন মার্কিন প্রশাসন যে নিজ দেশের জনগণ ও কংগ্রেসের কাছে মিথ্যা ও বানোয়াট যুক্তি দিয়েছে, তার প্রমাণ হিসেবে হাজার হাজার পৃষ্ঠার গোপন সরকারি নথি এক সোর্সের কাছ থেকে (সোর্সের দেওয়া শর্ত ভঙ্গ করে) চুরি করে ফটোকপি করে এনেছিলেন পত্রিকাটির কিংবদন্তি সাংবাদিক নিল শিহান। শিহানের সোর্স ছিলেন র‍্যান্ড কর্পোরেশনের গবেষক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ড্যানিয়েল এলসবার্গ। তিনি নিজে (এক সহকর্মীসহ) আবার সরকারি কার্যালয় থেকে বেআইনিভাবে ওই নথিপত্র চুরি করে ফটোকপি করেছিলেন।

সাংবাদিকতার ইতিহাসে এমন অসংখ্য চাঞ্চল্যকর ঘটনা সাংবাদিকরা ফাঁস করতে পেরেছেন এমন সব উপায় অবলম্বন করে, যা হয়তো আইনগতভাবে পুরোপুরি সিদ্ধ ছিল না। কিন্তু সাংবাদিকরা এ ধরণের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম্যতা ভোগ করে থাকেন, কারণ তাদের তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো ‘জনস্বার্থে’; ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক বা অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়। ঠিক এই কারণে অনেক নথি সাধারণ কারও হাতে থাকলে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও, সাংবাদিকদের কাছে থাকাকে স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য ধরে নেওয়া হয়। কারণ, তাদের কাজই হচ্ছে গোপন নথিপত্র নিয়ে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম যদি ওই ধরণের কোনো পন্থা অবলম্বন করেও থাকেন, তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। তাঁর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট নামে ঔপনিবেশিক একটি আইনে মামলা হয়েছে। অথচ, এই আইন করাই হয়েছে সরকারি কুকীর্তিকে রক্ষা করতে।

যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন নিক্সন প্রশাসন প্রথমে পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ এতে পূর্ববর্তী ডেমোক্রেট প্রশাসনই হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছিল। কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জারের কূটনামিতে নিক্সন প্রশাসন বুঝতে পারে যে, গোপন নথিপত্র ফাঁসের ঘটনা নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তারাও পরবর্তীতে বিপাকে পড়তে পারে।

১৯৭১ সালের দিকে ওয়াশিংটন পোস্ট যখন পুরো নথিপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল পত্রিকাটিকে ওই নথি না ছাপাতে বলেন। দ্য পোস্ট ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলে, আদালতে মামলা করে নিক্সন প্রশাসন। কিন্তু সেই মামলা টিকেনি মার্কিন আদালতে। তবে নিক্সনদের আশঙ্কা কিন্তু অমূলক ছিল না। পরবর্তীতে সেই ওয়াশিংটন পোস্টই প্রকাশ করে কুখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি, যার কারণে অভিশংসনের মুখে বিদায় নিতে হয় নিক্সনকে।

Pentagon-Papers-feature

ওয়াশিংটন পোস্ট যদি পেন্টাগন পেপার্স পুনঃপ্রকাশে আদালতের কাছ থেকে বাঁধা পেতো, তাহলে হয়তো তারা পরবর্তীতে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি প্রকাশে সেলফ-সেন্সরশিপ করতো। নিক্সন প্রশাসন যদি তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের পূর্বসুরি প্রশাসনের অপকর্ম ফাঁস ঠেকাতে পারতো, তাহলে নিজেরাও হয়তো পরবর্তীতে বেঁচে যেতো।

এ কারণে রোজিনা ইসলামের মামলাতেও আদালতকে দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে হবে; সাংবাদিকদের ‘জনস্বার্থ’ বিষয়ক ব্যতিক্রম্যতাকে আমলে নিতে হবে। কোনোভাবেই এই ঘটনাকে বাজে নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যম এক ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছে। এরই মাঝে রাষ্ট্রের অলিখিত চতুর্থ স্তম্ভের প্রতি নির্বাহী বিভাগের এই ‘একসেস’ আচরণ থেকে প্রতিকার দিতে হবে বিচার বিভাগকে। বিপরীত কোনো বিচারিক সিদ্ধান্ত সংবাদ মাধ্যমের বিরাজমান স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপের মাত্রা ও ক্ষেত্র নিদারুণভাবে বৃদ্ধি করায় ভূমিকা রাখবে।

এ প্রসঙ্গে পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচারক মুরে গারফেইনের একটি উক্তি থেকে আমাদের বিচারকরা অনুপ্রেরণা নিতে পারেন:

'জাতির নিরাপত্তা শুধু দুর্গ বা ঘাঁটির মাধ্যমেই নিশ্চিত হয় না। নিরাপত্তা আমাদের মুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যবোধের মধ্যেও নিহিত থাকে। বাকস্বাধীনতার বৃহত্তর মূল্যবোধ ও জনগণের জানার অধিকারকে সমুন্নত রাখতে হলে, যারা ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের স্থানে বসে আছেন, তাদেরকে আক্রমণাত্মক সংবাদ মাধ্যম, একগুঁয়ে সংবাদ মাধ্যম ও সর্বত্র নাক গলানো সংবাদ মাধ্যমের যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।'

লেখা: নাজমুল আহসান 

৫৮১ পঠিত ... ২০:৪২, মে ১৮, ২০২১

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top