সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সেরা ১০টি চরিত্র

১৬১৫ পঠিত ... ২০:০১, নভেম্বর ১৫, ২০২০

৮৬ তে এসে জীবনের গতি থামালেন এশিয়ার অন্যতম সেরা অভিনেতা সৌমিত্র চট্টো পাধ্যায়।  কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে টানা ৪১ দিন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ শেষে আজ বোরবার হার মানেন তিনি। তবে মৃত্যুর আগে এমন সব কালজয়ী চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যেগুলো আরও বহুকাল দর্শকের হৃদয়ে উদ্দীপনার সঞ্চার করবে। সৌমিত্রের জীবনের এমন সেরা ১০টি চরিত্র সম্পর্কে চলুন একটি নস্টালজিক হওয়া যাক!

 

১# অপু

সৌমিত্রের নাম আসলে বোধহয় সবার আগেই অপু চরিত্রটি ভেসে আসে। ১৯৫৯ সালের ১ মে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবির মাধ্যমে সৌমিত্রের ছিমছাম সাদামাটা চেহারা আর অসাধারণ অভিনয়ের সঙ্গে দর্শকের পরিচয়। এই সিনেমায় কালজয়ী সব সংলাপ এবং দৃশ্য আছে। সিগারেটের প্যাকেটে লেখা ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’র মতো দৃশ্য আর সৌমিত্র-শর্মিলা জুটির সেই তুখোড় রসায়ন দর্শকের মনে এখনও অমলিন। অপর্নার মৃত্যুর খবরে অপু যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, সেটিওবা দর্শক ভুলবেন কী করে! অপুর সংসারে চরিত্রের বোহিমিয়ান মানসিকতা ফোটাতেও তাঁর দক্ষতা ধরা দিয়েছিল।

 

২# ফেলুদা

কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অপুর পর সত্যজিতের সৃষ্ট আরেক চরিত্র ফেলুদাকে সিনেমার পর্দায় অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন সৌমিত্র। একদিন হঠাৎই সৌমিত্রকে ডেকে সত্যজিৎ বলেছিলেন, 'সোনার কেল্লা' বানাব। তুমিই হবে ফেলুদা। এরপরের ঘটনা একটা ইতিহাস। সত্যজিৎ-সৌমিত্র জুটি স্বভাবোচিত ভঙ্গিতেই সোনার ইতিহাস রচনা করেছিলেন। এই ছবির প্রতিটি দৃশ্যের মধ্যে যে ম্যাজিক রয়েছে, দর্শক তা কী করে ভুলবেন!

 

৩# সুশোভন

একটা সম্পর্ক উপর থেকে যেভাবে দেখা যায়, বাস্তবে সেটা নাও হতে পারে, অতনু ঘোষের ছবি 'ময়ূরাক্ষী'তে সেটি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বাবা সুশোভন (সৌমিত্র) ও ছেলে আর্যনীল (প্রসেনজিৎ)। আর্যনীল থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাবার সঙ্গে দেখা করতে সে কিছুদিনের জন্য এসেছে এদেশে। আর্যনীল আর সুশোভনের এই কয়েকটি দিনই যেন উত্তর খুঁজে দিয়েছে তাঁদের দুজনের মনে জমা হওয়া নানা প্রশ্নের। বাবা-ছেলের সম্পর্কের জটিল ও ’অশোভন’ দিক যেভাবে ঝরঝরে অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সুশোভন, তা হয়তো সৌমিত্রের মতো অভিনেতা বলেই সম্ভব হয়েছে। 

 

৪# বিশ্বনাথ মজুমদার

বেলা শেষে মুভিটা যারা দেখেছেন, তাদের অনেকেই হয়তো সৌমিত্রের করা বিশ্বনাথ মজুমদার চরিত্রটির সঙ্গে নিজের পরিবারের কারও মিল খুঁজে পেয়েছেন। এই চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই সংসারের বাবা/ স্বামীদের অব্যাক্ত কথাটা মনে হয় মুখ ফুটে বলেছেন সৌমিত্র। প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সাহিত্যপ্রেমী বিশ্বনাথ মজুমদার (সৌমিত্র) দুর্গা উৎসব উপলক্ষে ছেলে, ছেলের বউ, তিন মেয়ে এবং তিন জামাইকে এক জায়গায় জড়ো করেন। বাবার সমন দেখে সবাই ভেবেছিলেন তিনি বোধহয় তার সম্পত্তির উইল পড়ে শোনাবেন৷। কিন্তু বিশ্বনাথ সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানান, ৪৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টানতে চান তিনি! এ সিনেমায় সৌমিত্রের অনবদ্য অভিনয় দেখে অমিতাভ বচ্চন লিখেছেন ‘“বেলা শেষে” যেন আমার জীবনের শরৎকাল। ছবিটি দেখলে নিজের উপস্থিতিকে নতুনভাবে অনুভব করা যায়। মনে হয় যেন নিজেকে ধুয়েমুছে সাফ করে পরিচ্ছন্ন এক ভাবমূর্তির জন্ম হলো নতুনভাবে।’ 

 

৫# হুইলচেয়ার সিনেমার সেই ডাক্তার

৯০ এর দশকে মুক্তি পায় পরিচালক তপন সিনহার সিনেমা ‘হুইলচেয়ার’। এই ছবিতে সৌমিত্রের যে ডাক্তারের চরিত্র, সেটাও বেশ জটিল। ওই চরিত্রে সৌমিত্র বাইরে থেকে কঠিন, কিন্তু ভেতর থেকে একেবারে অন্য মানুষ। এই যে ভিতর ও বাইরের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার মধ্যেও কিন্তু নিজের লক্ষ্যে একেবারে স্থির এই চরিত্রটি। নিজস্ব জীবন দর্শন নিয়ে প্রত্যেকটি চরিত্রকে আলাদা মাত্রা দিতেন বলে কখনওই কিন্তু তাঁর চরিত্রগুলি বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে পড়ত না।  

 

৬# দীনেন লাহিড়ী

২০১৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘পোস্ত’ সিনেমাটি। অভাবনীয় কাহিনী আর সৌমিত্রের অসাধারণ অভিনয়ের কারণে মুক্তির পরপরই আলোড়ন তোলে সিনেমাটি। দীনেন লাহিড়ী (সৌমিত্র) হচ্ছেন অর্ণব লাহিড়ীর (যীশু সেনগুপ্ত) বাবা। কিন্তু অর্ণব ও তাঁর স্ত্রীর চাকরির ব্যস্ততার কারণে তাদের ছোট্ট শিশু পোস্তকে দাদা-দাদির কাছে রেখে যায়। দাদা-দাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে পোস্তর সঙ্গে বাবা-মায়ের তুলনায় দাদা-দাদির সম্পর্ক বেশি গাঢ় হয়ে যায়। অর্ণব যখন এক পর্যায়ে পোস্তকে তাদের কাছে ফিরিয়ে নিতে চায়, তখনই শুরু হয় বাবা-ছেলের দ্বন্দ্ব। দীনেন লাহিড়ী কিছুতেই নাতিকে তার বাবার কাছে ফেরত দেবেন না। ঘটনা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে এরকম ঘটনা একেবারে অচিন্তনীয়। কিন্তু তারপরও প্রধান চরিত্রে সৌমিত্রের অনবদ্য অভিনয় দর্শকের চোখে প্রশান্তি দেয়। ‘বেলা শেষে’ থেকে ‘পোস্ত’, অভিনয় জীবনের শেষদিকে এসেও যেন নিজেকে প্রতিনিয়ত ভাঙতে চেয়েছেন, চেনা বৃত্তের বাইরে অভিনয় করে গেছে সাবলীলায়। এটাইতো সৌমিত্রের মতো শিল্পীদের বড় বৈশিষ্ট। 

 

৭# চারুলতার অমল

উচ্চবিত্ত এক বাঙালি পরিবারের কাহিনী নিয়ে ‘চারুলতা’ সিনেমা। কাজের চাপে পরিবারের কর্তা ভূপতি তার সদ্য যৌবনে পা দেওয়া স্ত্রী চারুলতাকে (চারু) অতটা সময় দিতে পারেন না। স্ত্রীর যে এতে মন খারাপ হয়, সেটিও তার চোখ এড়ায় না। ভূপতি তার পিসতুতো ভাই অমলকে (সৌমিত্র) চারুর ভেতরের সাহিত্যপ্রতিভা বের করে আনার দায়িত্ব দেয়। প্রথম দিকে তাদের সম্পর্কে বৌঠান-ঠাকুরপোর স্বাভাবিকতা ছাড়া অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। অবশ্য সাহিত্য চর্চা ছাড়া অন্য কিছুতে অমলের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। তবে পরবর্তীতে তাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট হয়। চারুর ভাবীর সঙ্গে অমলের কথা বলাকে তাই হিংসার চোখে দেখতো চারু। ইতিমধ্যে অমলের বিয়ের প্রস্তাব আসে বর্ধমান থেকে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজি না হয়ে এক মাস সময় চেয়ে নেয় অমল। সাথে সাথে রাজি না হওয়ায় চারু সাময়িকভাবে স্বস্তি বোধ করে কিন্তু তার আচরণ দেখে অমল অচিরেই বুঝতে পারে দাদার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে তাকে সরে পড়তে হবে। এটিও সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় নির্মিত সিনেমা।

 

৮# দেবদাস

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস থেকে একই নামে একাধিক চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে। তবে সৌমিত্রের অভিনয় করা চলচ্চিত্রটি সহজেই সবার মনে থাকবে। আশির দশকের শুরুতে এই সিনেমায় অভিনয় করে সবার কাছে দেবদাস বনে গিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। 

 

৯# উদয়ন পণ্ডিত

‘হীরক রাজার দেশে ‘ সিনেমায় ‘উদয়ন পণ্ডিত’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এটি গুপী গাইন বাঘা বাইন সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের সকল সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে। তবে কেবল একটি চরিত্র ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি। তিনি হলেন শিক্ষক। এ দ্বারা বোঝানো হয়েছে একমাত্র শিক্ষক মুক্ত চিন্তার অধিকারী, বাদবাকি সবার চিন্তাই নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ।  হীরকরাজ্যের উদয়ন পণ্ডিত এমন এক শিক্ষক যাঁর শিক্ষা পাঠশালা পেরিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের রসদ যোগায়।

 

১০# ময়ূরবাহান

তপন সিংহের এই ছবিতে সৌমিত্র খলনায়ক ‘ময়ূরবাহান’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়কের চরিত্রে ছিলেন উত্তমকুমার। দুই মহান অভিনেতার অভিনয় দক্ষতার এক অনবদ্য নিবেদন ছিল এই সিনেমাটি। সেখানেও সৌমিত্র খলনায়কের চরিত্র বিন্যাসের ক্ষেত্রে একটিবারের জন্যও অভিনয়ে এতটুকু অতিনাটকীয়তা দেখাননি। সাধারণভাবে বাংলা চলচ্চিত্রে খল চরিত্র অভিনয়ের ক্ষেত্রে অতিনাটকীয়তা দেখানো একটি অতিপ্রবণতা। কিন্তু সৌমিত্রতো এখানেই সবার চেয়ে আলাদা। অভিনয় তাঁর কাছে ছিল বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকুই।

১৬১৫ পঠিত ... ২০:০১, নভেম্বর ১৫, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top