প্রায় প্রত্যেক মোগল সম্রাটই তাঁর অদ্ভুত শখের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কারও ছিল স্থাপত্যের শখ। তো কারও ছিল বই পড়ার শখ। কারও ছিল আরবী ঘোড়ার শখ। কারও ছিল পৃথিবীর সেরা জাতের সুরা পানের সখ। কারও ছিল মণিমানিক্যখচিত তরবারি জমানোর শখ। তবে ঔরঙ্গজেব ছাড়া, একটি বিষয়ে সব সম্রাটের মধ্যে মিল দেখতে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ মোগল সম্রাটই খেতে ভালোবাসতেন। পারস্যের রকমারি খানা তাঁরা খেতে পছন্দ করলেও, বিভিন্ন দেশের খাবার ও ফল তাঁদের পছন্দের তালিকায় ছিল।
তবে রসনা তৃপ্তির ব্যাপারে সম্রাটদের মধ্যে সেরা ও শৌখিন মানুষটি ছিলেন সম্রাট আকবর। তিনি মোগলাই খানাকে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। ট্র্যাডিশনাল মোগলাই খানার ওপর ভিন্ন ভিন্ন এবং বিষ্ময়কর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলেন সম্রাট আকবর। পাঠক, চলুন ঘুরে আসি সম্রাট আকবরের মোগলাই খানাপিনার জগত থেকে।
আকবরের হেঁসেল
সালমা হুসেন একজন সেলিব্রিটি ঐতিহাসিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খাবারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে আসছেন বহুদিন ধরে। তাঁর কথায় জানা যায়, আকবরের সুবিশাল ও রাজকীয় রন্ধনশালায় থাকতেন একজন কোষাধ্যক্ষ, একজন গুদামরক্ষক, কয়েকজন কেরানি, একজন প্রধান পাচক এবং প্রায় ৪০০ জন রাঁধুনি। এই ৪০০ জন রাঁধুনিদের উত্তর ভারত ও পারস্য থেকে রীতিমতো পরীক্ষা করে বেছে নেওয়া হত ।
সমস্ত রাজা মহারাজাদের মত মোগল সম্রাটরাও ভাবতেন, তাঁদের খাদ্যে বিষ দেওয়া হতে পারে। Babur: The First Mogul in India নামের বইটি থেকে জানা যায়, সম্রাট বাবরকে একটি ভোজসভায় বিষ দেওয়া হয়েছিলো। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ও বমি করার পর অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও মাত্র ৪৭ বছর বয়েসে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয় বাবরকে। পরবর্তী মুঘল সম্রাটরা এই ঘটনাটি ভোলেননি।
মেনু ঠিক করতেন হাকিম সাহেব
সম্রাট আকবর রোজ কী খাবেন, সেই মেনু ঠিক করতেন আকবরের নিজস্ব হাকিম (রাজবৈদ্য)। হাকিম সাহেব মরশুম বুঝে ও আকবরের শরীর বুঝে খাদ্যতালিকা তৈরি করতেন। অত্যন্ত গোপনে রাখা হত সেই তালিকা। হাকিম ছাড়া আর কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতেন না পরের দিনে সম্রাট কী খেতে চলেছেন।
খুব ভোরে উঠে হাকিম সাহেব আকবরের রন্ধনশালায় গিয়ে নির্দেশ দিতেন। সেই মতো তৈরি হত সম্রাটের খানা। তাই সব ধরণের উপকরণ প্রস্তুত থাকত গুদামঘরে। যতক্ষণ রান্না হত রাজবৈদ্য প্রাসাদের রন্ধনশালায় উপস্থিত থাকতেন। আকবরের খাদ্যে ঔষধি গুণ যুক্ত উপাদান যাচ্ছে কিনা তার খেয়াল রাখতেন।
যেমন, আকবরি বিরিয়ানির চালের প্রতিটা দানার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হত ‘সিলভার অয়েল’। যেটি গুরুপাক বিরিয়ানি হজমে সাহায্য করত এবং সম্রাটের যৌনশক্তি বৃদ্ধিতেও সক্রিয় ভূমিকা নিত। কলিন টেলর সেন তাঁর A History of Food In India বইতে আকবরের রসনা প্রীতির একটি চমকপ্রদ উদাহরণ দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, আকবরের টেবিলে খাদ্য হিসাবে যাওয়ার আগে আফগানি মুরগীদের কয়েক মাস ধরে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হত। প্রাসাদের মধ্যেই গড়ে তোলা খামারে, প্রতিটি মুরগীকে হাতে করে দানা খাওয়ানো হত। দানাগুলিতে জাফরান ও গোলাপজল মেশানো থাকত।
মুরগীগুলিকে সাধারণ জল দেওয়া হত না। গোলাপজল পান করানো হত। এটাই শেষ নয়, এর পর মুরগীগুলিকে রোজ কস্তুরিমৃগের নাভির তেল ও চন্দনগাছের তেল মালিশ করা হত। ফলে মাংসে আঁশটে গন্ধ থাকত না। মাংস নরম, সুস্বাদু ও সুগন্ধী হত।
সপ্তাহে চারদিন আমিষ খেতেন আকবর
সম্রাটের জন্য হারিসা বানানো হত মুলতানী ভেড়ার মাংস, ভাঙা গম, প্রচুর ঘি আর এলাচ দিয়ে। একই রকম ভাবে ভেড়ার মাংসে সঙ্গে ডাল আর সবজি মিশিয়ে তৈরি হত হালিম। এক ধরনের মাংসের স্টু ভীষণ পছন্দ করতেন আকবর নাম ছিল ইয়াখনি। এছাড়া পারস্যের রেসিপিতে তৈরি করা গোটা ভেড়ার রোস্ট আকবরের টেবিলে থাকত।
আজকের বাঙালি বিয়েবাড়িতে মাংসের একটি পদকে প্রায়সই দেখা যায়। নাম তার মাটন রোগান-যোশ। এটি আদতে পারস্যের একটি খাবার। আকবরের হাত ধরেই নাকি রোগান-যোশ ভারতে প্রবেশ করে। ফার্সি ভাষায় রোগানের অর্থ ‘মাখন’ এবং জোশের অর্থ ‘তপ্ত’। পারস্যে নাকি এই খাদ্যটির রং ছিল সাদাটে।
আকবরের নির্দেশে তাঁর কাশ্মীরি পাচক রেসিপিতে পেঁয়াজ রসুন যোগ করেন, আর দেন স্থানীয় মোরগচূড়া গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল। এর ফলে রোগান-যোশের রং হয় টকটকে লাল। স্বাদে ও গন্ধে অতূলনীয় হয়ে ওঠে। যদিও কাশ্মিরী ব্রাহ্মণরা বলেন এই পদটি তাঁদের আবিষ্কার কারণ স্থানীয় ভাষায় ‘রোগান’ শব্দের অর্থ লাল।
এছাড়াও কাবুলি নামের একধরণের বিরিয়ানি পছন্দ করতেন আকবর। ইরানি ভেড়ার মাংসের সঙ্গে, বাংলার কালো ছোলা, শুখনো অ্যাপ্রিকট, আমন্ড আর বেসিল পাতা দিয়ে বানানো হত বাদশা-পসন্দ কাবুলি ।
সম্রাট আকবরের সুরা, সরবৎ ও ডেজার্টকে হিমশীতল করতে সুদূর হিমালয় থেকে রোজ আসত বরফ। হিমালয়ের বিশেষ একটি জায়গা থেকে গোপনে ও সযত্নে নিয়ে আসা হত এই বরফ।
সপ্তাহে তিনদিন সুরা ছুঁতেন না আকবর, পান করতেন গঙ্গার পানি
ঐতিহাসিক সালমা হুসেন জানিয়েছেন, সম্রাট আকবর সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ খেতেন। এই তিন দিন সুরা ছুঁতেন না। কেবল মাত্র গঙ্গা পানি পান করতেন। গঙ্গার উৎসস্থল থেকে আকবরের জন্য অত্যন্ত গোপনে নিয়ে আসা হত, খনিজ পদার্থে ভরপুর মিনারেল ওয়াটার।
আকবরের জন্য প্রাসাদের ভেতরেই সবজি চাষ করা হত। সেই জমিতে সাধারণ পানি দেয়া হত না। মাটির জালা থেকে গোলাপ জল দেওয়া হত। রান্নার সময় সবজি থেকে গোলাপের সুগন্ধ বের হতো।
নিরামিষ খাওয়ার এই তিন দিন আকবরের শাক চাইই চাই। তাঁর জন্য পালং শাক মিহি করে কেটে, কড়ায় প্রচুর পরিমানে ঘি দিয়ে রান্না করা হত। তাতে মেশানো হত আদা, লবঙ্গ, দারুচিনি, মেথি ও এলাচ। নিরামিষের দিনগুলিতে সম্রাট পছন্দ করতেন সবুজ আর গোলাপি রঙের সুগন্ধী মিষ্টি ভাত আর রকমারি ফিরনি।
আকবরের আরেকটা প্রিয় নিরামিষ খাবার ছিল জর্দা বিরিঞ্জ। আইন-ই-আকবরি সূত্রে পাওয়া রেসিপিতে জানা যায়, ১০ সের সুগন্ধী চালের সঙ্গে ৫ সের মিছরি, ৪ সের ঘি এবং আধ সের করে কিশমিশ, কাজু ও পেস্তা মিশিয়ে তৈরি করা হত আকবরের মনপসন্দ জর্দা বিরিঞ্জ।
খাবার পরিবেশনের জন্য ছিল নির্দিষ্ট একটি পদ্ধতি
খাবারগুলিকে রন্ধনশালা থেকে প্রাসাদের ভোজনকক্ষে নিয়ে যাওয়ার আগে আরেক প্রস্থ পরীক্ষা করা হতো। প্রথমে প্রধান পাচক আর বাকাওয়ালেরা স্বাদ নিতেন। তারপর স্বাদ নিতেন মির-বাকাওয়াল (Kitchen Overseer)। এর পর মির-বাকাওয়ালের কড়া নজরদারিতে খাদ্যের পাত্রগুলিকে মসলিনের ব্যাগে ঢুকিয়ে সিল করা হত। তারপর একটি সুরক্ষা দলের পাহারায় সেগুলি পাঠানো হতো প্রাসাদের ভোজনকক্ষে।
ফলে পাত্র পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকতো না। খাদ্য সম্রাটের টেবিলে আসার পর খোলা হতো সিল। আকবরের প্রাত্যহিক খাবার পরিবেশন করতো খোজারা। প্রত্যেকটি খাবারকে সময় নিয়ে পাত্রে সুন্দরভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করা হত। খাবার পরিবেশন করা হতো সোনা, রূপা এবং পাথরের সুদৃশ্য পাত্রে। পাত্রের নীচে লাগানো থাকত মসলিন।
আকবর খাবার টেবলে আসার পর, মির-বাকাওয়াল আবার সেই সব খাবার কয়েক চামচ দইয়ে মিশিয়ে জিভে ফেলতেন। তারপর সম্রাট আকবর তাঁর ভোজন শুরু করতেন। শতাধিক পদের সামান্য অংশই চেখে দেখতেন সম্রাট আকবর। বাকি বিশাল অংশ বিলিয়ে দেওয়া হত ভিক্ষুকদের মধ্যে।
পাঠক, অনেক তো ঘুরলেন সম্রাট আকবরের খানাপিনার জগতে। তো চলুন, নিজের জগতে ফিরি। দু'টো ডাল আর আলুভর্তা চটকে ঢেঁকুর তুলে ভাত খেয়ে আরামে নিদ্রা যাই। সম্রাট খাবার যতোই মজা হোক, নিজের ঘরের দু'টো ভাত আর বিছানার চেয়ে আরামের আর কী-ই বা থাকতে পারে?
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন