সিডনি মর্গেনবেসার: ২০ শতকের সবচাইতে রসিক দার্শনিক

৬৮১ পঠিত ... ০৩:১০, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০

দার্শনিক শব্দটা শুনলে কেমন ইমেজ সাধারণত আমাদের মনে আসে? 

ভাবুক ধরণের খেয়ালি লোক, যিনি 'জ্ঞান কী? সত্যের সত্যতা যাচাইয়ের উপায় কী? হোয়াই দেয়ার ইজ এনিথিং র‍্যাদার দ্যান নাথিং?' -ইত্যাদি প্রশ্ন করে আর কঠিন কঠিন উত্তর হাজির করেন- তাই না? 

সৌভাগ্যবশত, দর্শনের ইতিহাসে বেশ কিছু দার্শনিক পাওয়া গেছে যারা এই টিপিক্যাল ভাবুক ইমেজের বাইরে জীবনযাপন করে গেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ তো কমেডিয়ানদের মতো এন্টারটেইনিং ছিলেন। আম্রিকান দার্শনিক সিডনি মর্গেনবেসার তেমনই বিরল এক দার্শনিক ছিলেন। 

সিডনি মর্গেনবেসার সম্ভবত ছিলেন আধুনিক কালের সবচেয়ে উইটি দার্শনিক। প্রাচীনকাল অন্তর্ভুক্ত করলে হয়তো ডায়োজেনিস দ্য সিনিক-এর নাম প্রথমে রাখবো, তবে ২য় অবস্থানে মর্গেনবেসারকে রাখতেই হবে। 

২০ শতকের শেষার্ধে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে, দর্শন বিভাগে 'জন ডিউই প্রফেসর' হিসেবে তিনি পড়াইতেন এপিস্টেমোলজি ও ফিলসফি অফ সায়েন্স৷ তার লেকচারের সময় ক্লাসরুম স্টুডেন্টদের ভিড়ে উপচে পড়তো। 

সিডনি জীবনে লিখছেন খুব কম। অথচ তারে নিয়া কিংবদন্তী আছে  অজস্র। তার খ্যাতি অনেকটা বাংলাদেশের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো। মানে টেক্সট আকারে তার কাজ বেশি নাই কিন্তু খ্যাতি ও খ্যাতিমান শিষ্য রেখে গেছেন।  এই দিক দিয়া সক্রেটিসের সাথে মর্গেনবেসারের মিল আছে।  নিউ ইয়র্ক টাইমস তারে এই কারণেই হয়তো উপাধি দিছে, সাইডওয়াক সক্রেটিস। তার যুগের সবচাইতে উইটি লোকদের একজন হিসাবে তার খ্যাতি ছিলো। তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর অসামান্য ধারালো বাকভঙ্গি অননুকরণীয় ধরণের রসবোধ তৈরি করতো।   

তার ফ্রিস্টাইল বুদ্ধিবৃত্তিক রসিকতারে বলা যায় সক্রেটিক ডায়লগের লাইট ভার্শন। 

অনেক বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকরে প্রভাবিত করে গেছেন মর্গেনবেসার। রবার্ট নজিক তাদের একজন। নজিক নিজের পরিচয় দিতেন এইভাব:  'আমি সিডনি মর্গেনবেসারে মেজর। করা লোক।' বার্ট্রান্ড রাসেল একবার বলেছেন, সিডনি যুক্তরাষ্ট্রের 'ক্লেভারেস্ট' (ব্রিটিশ 'স্মার্টেস্ট' আর কি) ব্যক্তি।

হ্যারি ফ্রাঙ্কফুর্ট, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর এমেরিটাস মর্গেনবেসারের সরাসরি ছাত্র। (ফ্রাঙ্কফূর্ট 'অন বুলশিট' নামের বেস্টসেলিং বইয়ের লেখক)। গুরু মর্গেনবেসারের কথা বলতে গিয়া হ্যারি মেটাফোরে চলে গেছেন: মানুষ জিজ্ঞেস করে না বাতাস কী কাজ করে। এইটা জাস্ট শক্তি, নিজে টিকে থাকা এনার্জি।'  নোম চমস্কি তারে বলছেন, 'সবচেয়ে জ্ঞানী ও গভীর চিন্তক বলে- একজন দার্শনিক পুরানো, সক্রেটিসীয় অর্থে- যতটা না কাগজে ছাপা অক্ষর দিয়া তার চাইতে অনেক বেশি  জমজমাট তর্ক ও আলোচনায়।'

নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিন তারে উপাধি দিছিলো, 'ইদ্দিশ একসেন্টওয়ালা সক্রেটিস'। আরেকজন বলছেন, গ্রুশো মার্ক্স উইথ এ পিএইচডি। এই লেখায় মর্গেনবেসারের চমকপ্রদ রসিকতার কিছু নমুনা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতেছি।

১.
১৯৭০ সালের মাওবাদী এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলো, চেয়ারম্যান মাওয়ের বানী যে, একটা বিবৃতি একই সাথে সত্যি ও মিথ্যা হতে পারে, এটা তিনিও মনে করেন কিনা।
ড. মর্গেনবেসার জবাব দিলেন, 'আমি মনে করি এবং করিও না।'  

২.
১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশি আক্রমণের প্রতিবাদে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে পুলিশের কাছে এলোপাথাড়ি মার খাইছিলেন মর্গেনবেসার। এবং পত্রিকায় ফলায় করে প্রকাশিত হইছিলো। তার উপর এই পুলিশি হামলা 'আনজাস্ট' বা 'আনফেয়ার' হইছে কিনা তার কাছে জানতে চান সাংবাদিকেরা। মর্গেনবেসারের জবাব, 'এইটা আনজাস্ট ছিলো কিন্তু আনফেয়ার না৷ আমাকে মাথায় বাড়ি মারা আনজাস্ট ছিলো কিন্তু আনফেয়ার না কারণ বাকি সবাইকেও মাথায় বাড়ি দেয়া হইছিলো।'  

৩.
একটা সিরিয়াস সেমিনারে আলোচকের ভূমিকায় ছিলেন মর্গেনবেসার। আলোচনার মাঝে এক লোক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো যে মর্গেনবেসার 'প্রশ্নকর্তার অস্তিত্ব' প্রমাণ করতে  পারে কিনা। মর্গেনবেসার বলেন- এই প্রশ্নটা করতেছে কে? 

৪.
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মর্গেনবেসার টেনিউর  বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন এক কলিগ। তার যুক্তি মর্গেনবেসার টেনিউরাদ পজিশন পাওয়ার মতো যথেষ্ট গবেষণা প্রকাশ করেন নাই। মর্গেনবেসার বলেন, 'মোজেজ একটা মাত্র বই লিখছেন। তারপর উনি কী করছিলেন?' 

৫.
মর্গেনবেসার নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে আসছিলেন। স্টেশন থেকের বের হতে হতে সিগারেট ধরাইতে নিছেন। দেখে একজন পুলিশ অফিসার বললো, সাবওয়েতে ধূমপান নিষিদ্ধ। মর্গেনবেসার তাকে বললেন, তিনি সাবওয়ে স্টেশনে ধূমপান করতেছেন না, সে স্টেশন থেকে বাইরে যাইতেছেন, ঢুকতেছেন না। বইলা তিনি সিগারেটটা ধরাইছেন।

পুলিশ আবার বললো, 'সাবওয়েতে ধূমপানের অনুমতি নাই। আমি আপনারে এইখানে ধূমপান করতে দিলে বাকি সবাইরেও দিতে হবে।' 

মর্গেনবেসার বলেন, 'নিজেরে কী মনে করেন আপনি, কান্ট?' 

মর্গেনবেসারের একসেন্টের কারণে পুলিশ মনে করছে, তারে cunt বলা হইছে! সঙ্গে সঙ্গে তারে পুলিশ স্টেশনে নিয়া যাওয়া হইলো। পরে মর্গেনবেসারের কলিগরা গিয়া বেরসিক পুলিশরে বুঝাইলো, মর্গেনবেসার আসলে বুঝাইছেন দার্শনিক কান্টের কথা, যিনি ক্যাটিগরিক্যাল ইম্পারেটিভের ধারণা দিছিলেন; তারপর ছাড়া পাইছেন। 

৬.
হাইডেগারের অন্টোলজিক্যাল প্রশ্ন: 'কিছু না থাকার বদলে কেন কিছু আছে?' (হোয়াই দেয়ার ইজ সামথিং র‍্যাদার দ্যান নাথিং)?
মর্গেনবেসারের উত্তর: কোনো কিছু যদি নাও থাকতো, তাও আপনি কমপ্লেইন করেই যাইতেন।'    

৭.
মর্গেনবেসারের কাজের একটা ক্ষেত্র ছিলো 'ইন্ডিপেন্ডেস অদ ইরেভেলেন্ট অল্টারনেটিভ' নিয়া। নামটা যত জটিল মনে হয় তত জটিল কিছু না। মর্গেনবেসারের রিয়েল লাইফ জোকিং আরও সহজে বুঝায়ে দেয়। একদিন রেস্টুরেন্টে গেছেন মর্গেনবেসার। ওয়েট্রেস এসে জানাইলো, যে এপল পাই আর ব্লুবেরি পাই -এই দুইটা অপশন থেকে সে যে কোনো একটা চুজ করতে পারেন। তিনি অর্ডার করলেন, এপল পাই। কিছুক্ষণ পরে ওয়েট্রেস ফিরে এসে বললো, চেরি পাই-ও এখন একটা এভেইলেবল। মর্গেনবেসার বললেন, সেক্ষেত্রে, আমি নিবো ব্লুবেরি পাই। 

৮.
প্র‍্যাগম্যাটিজম দর্শনের ব্যাপারে তার মত জানতে চাইলে, মর্গেনবেসার বলেন, থিয়োরি হিসাবে খুব ভালো, কিন্তু প্র‍্যাক্টিস হিসাবে কাজ করে না।'  

৯.
দুর্বোধ্য দার্শনিক হিলারি পাটনামের ব্যাপারে  মর্গেনবেসারের মন্তব্য: সে ( হিলারি পাটনাম) একজন কোয়ান্টাম দার্শনিক। আমি তারে আর তার অবস্থানরে একই সময়ে বুঝতে পারি না।   

১০.
আরেকদিনের ঘটনা। মর্গেনবেসার রেস্টুরেন্টে খাইতেছিলেন। পরিচিত এক লোক পাশ দিয়া হেটে যাইতেছিলো। মর্গেনবেসারকে দেখে  থেমে বললো সে খুব ব্যস্ত,  তাই দেখা করারও সময় পান না: 'এতো ব্যস্ত যে আমি জানি না আমার অস্তিত্ব আসলেই আছে কিনা।' মাঝেমধ্যে অল্পস্বল্প চিন্তাও কইরো, বলে সিডনি খাওয়া চালায়ে গেলেন। 

[দেকার্তের বিখ্যাত I think, therefore I exist কথাটারে ইউজ করছেন সিডনি] 

১১.
১৯৫০'র দশকে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত দার্শনিক, জে এল অস্টিন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন ভাষার কাঠামোগত বিশ্লেষণের উপরে এক আলোচনায়। অস্টিন দেখান, যে ইংরেজিতে, যদিও ডাবল নেগেটিভ ব্যবহার করে পজিটিভ অর্থ প্রকাশ করা যায়, ('তিনি এ ব্যাপারে অসচেতন নন), এমন কোনো ভাষা নাই যেইখানে দুইটা পজিটিভ দিয়া একটা নেগেটিভ অর্থ প্রকাশ করা যায়। অডিটরিয়ামে দর্শকসারিতে মর্গেনবেসারও ছিলেন। তাৎক্ষণিক বললেন, Yeah, yeah!'

৬৮১ পঠিত ... ০৩:১০, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top