হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা হামলা সম্পর্কে যে ৭টি অদ্ভুত তথ্য আপনি জানেন না

৪০২৪ পঠিত ... ২০:২৭, আগস্ট ০৬, ২০২০

জাপানের হিরোশিমায় আমেরিকার বোমা হামলার আজ ৭৫ বছর পূর্তি। মানবজাতির যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিউক্লিয়ার বোমা হামলা। এই ঘটনা অনেকগুলো কারণে ছিলো নজিরবিহীন। নিউক্লিয়ার যুগের সূচনা, কোল্ড ওয়ার বা শীতল যুদ্ধের আরম্ভ৷ মানবজাতি প্রথমবারের মতো ভাবতে শুরু করেছে যে মানুষ প্রকৃতির উপরে এমনই আধিপত্য অর্জন করেছে যে চোখের পলকে সমগ্র প্রাণীকে সে চাইলে ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম।  

এই দুঃস্বপ্নের মতো দিনটিকে স্মরণ করতে, এখানে দেয়া হলো অদ্ভুত কিছু ঘটনা যা আপনি নাও জানতে পারেন। 



১# নিউক্লিয়ার অ্যাটাকের কিছু পূর্বে আমেরিকা জাপানি নাগরিকদের সতর্ক করে 

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপের পূর্বে ইউএস এয়ারফোর্স লিফলেট ফেলেছিলো যে তাদের এক্ষুনি শহর ত্যাগ করা উচিত:

'এই শহরগুলিতে সামরিক, অস্ত্রাগার, কারখানা আছে মিলিটারি যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে। আমরা যাবতীয় মিলিটারি টুলস ধ্বংসের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যে টুলসগুলো এই অর্থহীন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে। কিন্তু দু:খজনক ব্যাপার হলো, বোমার চোখ নেই। তাই, আমেরিকার হিউম্যানিটারিয়ান পলিসি অনুযায়ী, আমেরিকান এয়ারফোর্স, যা নিরীহ লোকদের আক্রমণ কর‍তে চায় না, এই মুহূর্তে উল্লেখিত শহরগুলো থেকে চলে গিয়ে নিজেদের বাঁচাতে সতর্কবাণী দিচ্ছে। আমেরিকা জাপানের নাগরিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, যুদ্ধ করছে কায়েমি স্বার্থবাদী মিলিটারির সঙ্গে যা জাপানিদের দাস বানিয়ে রেখেছে।' 

বার্তাটি রেডিওতে প্রতি ১৫ মিনিট পর পর প্রচার করা হয়েছে। হিরোশিমায় বোমা নিক্ষেপের পরে আরও বেশি লিফলেট ফেলা হয়েছিলো যেখানে বার বার বলা হচ্ছিলো, একটা মাত্র বোমা এই ক্ষয়ক্ষতি করেছে, আর নাগাসাকি অধিবাসীদের এই সতর্কবাণী অবশ্যই মানা উচিত।

 এই সেই লিফলেট...

 

২# লিটল বয়- তখন পর্যন্ত উৎপাদিত সমস্ত ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছিলো 

হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমায় যুক্তরাষ্ট্র ১৪১ পাউন্ড ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে। ওটাই সেইসময় প্রসেসড হওয়া সম্পূর্ণ ইউরেনিয়াম। 

অদ্ভুত বিষয় হলো, এরিক স্লোশার রচিত 'কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল' বই অনুযায়ী, বোমাটি যখন বিস্ফোরিত হয়, বোমাটা 'সুপারক্রিটিক্যাল' দশায় পৌছানোর আগেই ফেটে বেশিরভাগ ইউরেনিয়াম বেরিয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত মহাবিস্ফোরণটা ঘটেছে মাত্র ০.৭ গ্রাম ইউরেনিয়ামের ফলে। অর্থাৎ মাত্র ০.৭ গ্রাম ইউরেনিয়াম হত্যা করেছে ৮০ হাজার লোককে। 



৩# এই বোমা হামলার কারণেই শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমেছে এই ধারণা সত্যি নয় 

প্রচলিত ধারণা হলো হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার সঙ্গে সঙ্গে জাপান আত্মসমর্পণ করে। অবশ্যই এই ধরণের অচিন্তনীয় মারণাস্ত্রের কারণে জাপানের আত্মসমর্পণ ত্বরান্বিত হয়েছে। 

কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এমন ইতিহাসবিদের সংখ্যা বাড়ছে যাদের দাবি, বোমা হামলার কারণেই জাপান সঙ্গে সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে এই মত সঠিক নয়। বরং জাপানের আত্মসমর্পণ এতো দ্রুত সময়ে হওয়ার বড় কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া।  

সোভিয়েতরা যারা কছুদিন আগেও জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধরত ছিল এবং অনেকদিনের জন্যে দখলকৃত ছিলো, তারা ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট অফিশিয়ালি জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে, যার তিন সপ্তাহের মাথায় জাপান আত্মসমর্পণ করে।

ইতিহাসবিদ ৎসুয়োশি হাসেগাওয়া, সোভিয়েত জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাপান যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা করে আসছিলো, আত্মসমর্পণের। কিন্তু সেই পরিকল্পিত আত্মসমর্পণ ছিলো আরও সম্মানজনক শর্তে। তাদের আশা ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সম্মানজনক আত্মসমর্পণ সম্ভব হবে। কিন্তু স্টালিন হামলা করলে জাপান অচিরেই বুঝে যায়, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প নেই।

 

৪# বোমা হামলার রঙিন ফুটেজ আসলেই আছে

হিরোশিমার বোমা হামলার কথা মনে হলেই সাদাকালো ছত্রাকের মতো বিস্ফোরণের কোন ছবিই আপনার মনে আসে না? 

সত্যি হলো, কিছু হাই কোয়ালটি রঙিন ফুটেজ আসলেই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি দীর্ঘদিন এটি লুকিয়ে রেখেছিলো। ২০১১ সালে এই ফুটেজ প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়।  



৫# বিস্ফোরণে বেঁচে যাওয়া তরুণের ম্যারাথন জয় 

হিরোশিমায় হামলার সময়ে শিগেকি তানাকার বয়স মাত্র তের বছর। হামলার সময়ে হিরোশিমা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বসে বোমা বিস্ফোরিত হতে দেখেছেন তানাকা। ছয় বছর পর বোস্টন ম্যারাথনে জয়ী হন তানাকা।

শিগেকি তানাকার বোস্টন ম্যারাথন জয়ের মুহূর্ত

মাত্র ২ ঘন্টা ২৭ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে পুরো কোর্স সম্পূর্ণ করে শিগেকি তানাকা। এই বিজয় তানাকার ব্যক্তিগত বিজয়ই ছিলো না শুধু, যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানিদের গর্ব ও সম্মান পুনরুদ্ধারেও প্রেরণা যুগিয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হলো বিশ্বযুদ্ধের পরে ওই বছরই জাপানি অ্যাথলেটদের প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিতায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। 

 

৬# নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের পরেও হিরোশিমার একটা ব্যাংকের ভল্ট অক্ষত ছিলো!

যদিও হিরোশিমার প্রায় সব স্থাপনা ধ্বংসস্তুপে রূপ নিয়েছিলো, হিরোশিমার তেইকোকু ব্যাংকের ভল্ট আশ্চর্যজনভাবে ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত! ব্যাংকের ম্যানেজার এতোই মুগ্ধ হয়েছিলো যে, পাচ বছর পরে তিনি ভল্টের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দ্য মস্লার সেইফ কোম্পানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলো।   

 ব্যাংকের সেই বিজ্ঞাপন!

আর নির্মাতা কোম্পানি এই ঘটনাকে তার বিজ্ঞাপনি মূল্য বাড়িয়ে নিতে কাজে লাগিয়েছিলো। তারা খবরটা গর্বের সাথে বলে বেড়িয়েছে যে, 'সেইফ কোম্পানির নির্মিত ভল্ট এতই  মজবুত, এমনকি নিউক্লিয়ার বোমাও কিছু করতে পারে না!'

 

৭# ৎসুতোমু ইয়ামাগুচি কি ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগা (অথবা সৌভাগ্যবান মানুষ)? 

ৎসুতোমু ইয়ামাগুচি নাগাসাকির মিৎসুবিশি ভারি শিল্পাঞ্চলে কাজ করতেন। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট তিনি ব্যবসায়িক কাজে হিরোশিমায় গেছেন, বিস্ফোরণ তার দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ঘটেছে অথচ তিনি বেঁচে ফিরেছেন। এবং ক্ষত সত্ত্বেও পরের দিন নাগাসাকিতে ফিরে যেতে সমর্থ হয়েছেন। ৯ আগস্ট আমেরিকানরা ফ্যাট ম্যান ফেলে নাগাদাকিতে।

ৎসুতোমু ইয়ামাগুচি, ইতিহাসের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা ব্যক্তি?

অদ্ভুত ব্যাপার হলো দু'দুটি নিউক্লয়ার বোমা হামলা থেকে তিনি বেচে গেছেন। ৎসতোমু মারা গেছেন ২০০১ সালে ৯৩ বছর বয়সে। জাপানিজ সরকার দ্বারা স্বীকৃত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দুটি বিস্ফোরনই চাক্ষুস করেছেন, কিন্তু বেঁচে ফিরেছেন।  

প্রশ্ন হলো, উনি কি ইতিহাসের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা ব্যক্তি? উত্তরটা দেয়া কঠিন।  

৪০২৪ পঠিত ... ২০:২৭, আগস্ট ০৬, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top