১৯৮৮ সালে মেরিনা যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে ক্লাস শুরু করেন, তখন থেকেই তিনি আলোচিত একজন। ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় তিন হাজার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে প্রথম হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। সবাই পারে না, কেউ একজন পারে। পেরেছিলেন মেরিনা তাবাসসুম। সেখান থেকেই স্থাপত্যে তাঁর সূচনা।
১৯৯৫ সালে বুয়েটের পাঠ যখন তিনি চুকালেন, হিসাবের খাতায় তখন সঞ্চিত হয়ে গেছে ডিজাইন ক্লাসে সবচেয়ে বেশী নম্বর পাওয়ার জন্য হাবিবুর রহমান স্বর্ণপদক। স্থাপত্য কলায় এভাবেই এরপর ছড়িয়ে গেছেন তাঁর বিজয়গাঁথা। আগা খান, কমনওয়েলথ, ব্রিটেনের স্মিথ এওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পুরষ্কার পেয়েছেন। অতি সম্প্রতি বিশ্বের সেরা ৫০ চিন্তাবিদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশি স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম। এই তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘প্রসপেক্ট।
ম্যাগাজিনটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেরিনা তাবাসসুম প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে ভবন নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নকশা তৈরি করার অভিজ্ঞ অবদান রেখেছেন। তার এই বিচক্ষণতার জন্য এ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
প্রসপেক্ট ম্যাগাজিনে আরও বলা হয়েছে, স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের নকশা করা স্থানীয় উপকরণের হালকা ওজনের বাড়িগুলো স্টিলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম। এছাড়াও পানির মাত্রা বেড়ে গেলে সেগুলো সরানো যায়। বিষয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এই কীর্তিমান স্থপতির কিছু কাজ তুলে ধরা হলো eআরকির পাঠকদের জন্য-
স্বাধীনতা জাদুঘর
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে থাকা স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং স্বাধীনতা জাদুঘর বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পের একটি অন্যতম নিদর্শন। সম্পূর্ণ মাটির নিচে থাকা এই জাদুঘরটি দেশের আর দশটি স্থাপনা থেকে ব্যতিক্রম। হবেই বা না কেন, এর ডিজাইনের সাথেও যে ছিলেন মেরিনা তাবাসসুম , যার পুরো গল্পটাই অন্যরকম! আমাদের দেশের স্থাপত্যশিল্পের শীর্ষপর্যায়ের প্রায় সবাই পুরুষ। কিন্তু এর মাঝেও এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম তিনি। ১৯৯৭ সালে একটি জাতীয় পর্যায়ের ডিজাইন প্রতিযোগিতা জিতে তিনি এবং স্থাপত্যবিদ কাশেফ মাহবুব চৌধুরী এই বৃহৎ প্রকল্পের দায়িত্ব পান। আর তাঁরা এই স্বাধীনতা জাদুঘরটির ডিজাইন করেন একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিষয়ের সাথে সাথে পুরো নকশাটির প্রধান আকর্ষণ হল একটি সুউচ্চ আলোক স্তম্ভ, যা স্বাধীনতা স্তম্ভ নামে অধিক পরিচিত। সম্পূর্ণ স্তম্ভটিই কাচের প্যানেল নির্মিত। আর আমাদের স্বাধীনতা জাদুঘরটি ঠিক এই স্তম্ভের নিচেই। পুরো জাদুঘরটি মাটির নিচে হওয়ায় এতে যোগ হয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। এটিই বাংলাদেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। নিঃসন্দেহে এটি মেরিনা তাবাসসুমের একটি অনবদ্য সৃষ্টি।
বাইতুর রউফ জামে মসজিদ
ঢাকা মসজিদের শহর নামে পরিচিত। শুধু ঢাকাই নয় বরং সমগ্র দেশজুড়েই আছে অসংখ্য মসজিদ। কিন্তু উত্তরা আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে গিয়ে রেললাইন পেরিয়ে রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়েদাবাদে গিয়ে আপনি যে মসজিদটির দেখা পাবেন তা কোনভাবেই আর দশটা মসজিদের মতন নয়। আর এটি মেরিনা তাবাসসুমের আরেকটি অনন্য সৃষ্টি, বায়তুর রউফ মসজিদ।
মসজিদ বললেই আমাদের মাথায় আসে ডোম, মিনার বা গম্বুজের কথা। কিন্তু এই মসজিদে নেই তাঁর কিছুই। চারদিকে আটটি পিলারের ওপর তৈরি হয়েছে এটি। এর বিশেষত্ব হলো, কিবলার দিকে ১৩ ডিগ্রি কোনাকুনি করা একটি থাম। আর বায়ু চলাচলব্যবস্থা ও আলোর চমৎকার বিচ্ছুরণ মসজিদের পরিবেশকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। ৭৫৪ বর্গমিটারের এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে সুলতানি আমলের মসজিদের অনুপ্রেরণায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয়গুলো এত চমৎকারভাবে কাজে লাগানো হয়েছে স্থাপত্যশিল্পে যে শীত বা গরমে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের কিছুই বোঝা যায় না মসজিদের ভেতর থেকে।
এবং দি আগা খান অ্যাওয়ার্ড
আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার। স্থাপত্যের দুনিয়ায় এ পুরস্কারের স্থান অনেক উপরে। এ পুরষ্কার পেতে হলে তুমুল প্রতিযোগিতা তো আছেই, সাথে সাথে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে তিন বছর। স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন) এই পুরষ্কার দেয় তিন বছরে একবার। এই পুরস্কারের জন্য স্থাপত্য ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব, পরিকল্পনা, ঐতিহাসিক সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের তিনটি স্থাপনা, যথাক্রমে জাতীয় সংসদ ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রকল্প ও রুদ্রপুর স্কুল আগে এই সম্মানজনক পুরষ্কার পেলেও এগুলোর স্থপতিরা সবাই ছিলেন ভিনদেশী। বাংলাদেশে থেকে এ ধরনের পুরস্কারে মনোনয়ন পাওয়াও যেখানে গর্বের বিষয় সেখানে ২০১৬ সালে বাইতুর রউফ জামে মসজিদের জন্য মেরিনা তাবাসসুম আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হন!
স্থাপত্য নিয়ে মেরিনা তাবাসসুমের চিন্তাটা কেমন? সেটা বোঝার জন্য শেষ করা যাক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মেরিনা তাবাসসুমের সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ দিয়েই-
'আমি প্রকৃতি দেখি অন্যভাবে। ভবনের গায়ে গাছ দেবো- এভাবে প্রকৃতি দেখি না। প্রকৃতি যদি দিতে হয়, তাহলে ভবনটাই প্রাকৃতিক হতে হবে। এয়ারকন্ডিশন ও বৈদ্যুতিক বাতি লাগিয়ে একটা ভবন হাইফাই করলাম, তারপর সেখানে গাছপালা লাগালাম এটাতে বিশ্বাস করি না। প্রাকৃতিক মানে শুধুই প্রাকৃতিক হবে। প্রত্যেকটি মানুষের যেমন নিজস্বতা থাকে, ঠিক তেমনই ভবনেরও আলাদা নিজস্বতা থাকবে। নিজস্বতা আর্কিটেক্টদের তৈরি করতে হয়। ভবনের যখন ওই নিজস্বতা দেখা যায়, বোঝা যায় তখন সেটার অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা। হাসপাতালে মানুষ সুস্থ হতে যায়। শুধু শারীরিক না মানসিকভাবেও তারা সুস্থ হতে যায়। তাই তার পরিবেশটাও তেমনই হওয়া দরকার। আমি যখন যে প্রকল্পগুলোই করি, আমার প্রধান লক্ষ্য থাকে একটা ক্যারেক্টার দেয়া। এগুলো যেন মানুষকে ছুঁয়ে যেতে পারে এবং সংযোগ ঘটাতে পারে।'
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন