তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের কিছু অদ্ভুত ঘটনা

১৮৮৩ পঠিত ... ১০:৫৬, জুলাই ২৪, ২০২০

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কথা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৯৮ খৃস্টাব্দের ২৩ জুলাই পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক ক্ষয়ীষ্ণু জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীল জীবনের সমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কোলকাতা শহরে।

তারাশঙ্কর তাঁর বিশাল সাহিত্য ভান্ডারের মধ্য থেকে অন্তত: ১০টি উপন্যাস এবং বেশ কিছু অনন্য সাধারণ ছোট গল্পের জন্য স্বকালের সীমা ছাড়িয়ে উত্তরকালের অগণিত পাঠককে স্পন্দিত করতে সমর্থ হয়েছেন। এ অর্থেই তিনি বাংলার চিরায়ত কথা সাহিত্যের কালজয়ী শিল্প প্রতিভা। বরেন্য এই শিল্পীর জীবনের কিছু অদ্ভুত কাহিনী জানবো আজ। 

 

শুরুর দিকের সংগ্রামী ও অভাবের লেখকজীবন 

তারাশঙ্কর জীবনের শেষ দিকে যথেষ্ঠ খ্যাতি ও অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। কিন্তু লেখক জীবনের দীর্ঘ একটা সময় তাকে অপমান আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছ। 

একবার বার ছয় বছরের মেয়ে বুলু মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হাতে একটা পয়সা নেই। সেই অবস্থায় আত্মীয়ের কাছে পাঁচটা টাকা ধার চাইতে গেলেন। মুখের ওপর ‘না’ করে দিলেন সেই স্বজন। চোখের জল চেপে মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলেন তারাশঙ্কর।

জেলে থাকার সময়েই উপন্যাসের প্লট ভেবে রেখেছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পর লিখে ফেললেন, ‘চৈতালি ঘূর্ণি’।

কিন্তু ছাপবে কে?

লিখে আয় যৎসামান্য। তাতে একবেলা চলে তো আরেকবেলা চলে না। তার মধ্যেই নিজের খরচে বই প্রকাশ করলেন। 

সে-বই বিক্রি হল না। একদিন নিজেই পাঠক সেজে বইয়ের দোকানে নিজের বই কিনতে গেলেন। কথায় কথায় দোকানি যখন জানতে পারলেন বইটির লেখক তিনিই, সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'মশাই আপনার বইয়ের এক কপিও বিক্রি নেই। এখুনি ঝাঁকা মুটে ডেকে দিচ্ছি, সব বই ফেরৎ নিয়ে যান।' সঙ্গে আরও গোটা কয় কটুবাক্য।

অপমানে লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গিয়েছিলেন 'গণদেবতা'র স্রষ্টা।

আরেকদিন সেই ‘চৈতালি ঘূর্ণি’রই এক দপ্তরি এসে হাজির। এসেই তারাশঙ্করকে সকলের সামনে সরাসরি আক্রমণ, ‘ও মশাই আপনার বই বাঁধার টাকা পাই, এখুনি শোধ করুন, নয় তো গোডাউনে যত বই পড়ে রয়েছে সব ফুটপাতে হকারদের কিলো দরে বেচে দেব।’ 

লজ্জায় পা কাঁপতে লাগল তারাশঙ্করের। কিন্তু এ বারের ঘটনার শেষটি অনেকটাই অন্য রকম।

কোথা থেকে তখনই সামনে এসে উদয় হলেন এক ব্যক্তি। সেই সময়ের সাহিত্য জগৎ যাঁর সমালোচনার ভয়ে কাঁপে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও যিনি ছেড়ে কথা বলেন না। দোকানিকে গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, ‘এখুনি সব বই আমার দপ্তরে পাঠিয়ে দিন। আর বিল করে দিন। এখুনি সব মিটিয়ে দিচ্ছি।’

তারাশঙ্কর হতবাক।

দ্বিতীয় বার কথা বললেন সেই ভদ্রলোক। এবার তারাশঙ্করের দিকে চেয়ে, ‘আপনার বই আমি ছাপব।’

ভদ্রলোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। এর পর এই দু’জনের আজীবনের বন্ধুত্ব তো আজ এক ইতিহাস।



রাজনীতিতে তারাশঙ্কর 

তারাশঙ্করের একবার মনে হলো। তিনি রাজনীতিতে নেমে দেশসেবা করবেন। শুরুতেই একজন নেতাকে অনেকগুলো টাকা দান করেছিলেন। মানুষ তখন বলাবলি শুরু করলো যে তারাশঙ্কর নাম কামানোর জন্যেই রাজনীতিতে এসেছেন। তার রাজনৈতিক জীবনে তাকে অজস্রবার এই কথা শুনতে হয়েছে যে 'জমিদার পুত্র', দেশসেবার নামে খ্যাতির জন্যে রাজনীতিতে এসেছেন। 

একবার তারাশঙ্করের এক খুব কাছের বন্ধু এবং সেই বন্ধুর এক আত্মীয় নির্বাচনে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। ফখন

তারাশঙ্কর তাঁর বন্ধুর পাশে দাঁড়ালেন। তাঁর হয়ে প্রচার চালাতে লাগলেন। লড়াই তুঙ্গে উঠল।

হঠাৎই দুই আত্মীয়ের মিটমাট হয়ে গেল। মর্নিং কোর্টে সেই আত্মীয় মনোনয়ন তুলে নিলেন। বেলা হয়ে গেছে। বন্ধু এক প্রকার জোর করেই দুপুরবেলা খাওয়ার জন্য নিয়ে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বী সেই আত্মীয়েরই বাড়িতে।

খেতে বসেছেন। সবে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে যাবেন, ঠিক তখনই সেই আত্মীয়র বড় ছেলে বলে উঠলেন, ‘তারাবাবু, আপনি আমাদেরই বিরোধিতা করে এখন আমাদের বাড়িতেই পাত পেড়ে খাচ্ছেন! লজ্জা করে না আপনার?’

হাতের গ্রাস নামিয়ে রাখলেন তারাশঙ্কর। বললেন, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। লজ্জাহীনতার যে কাজ আমি করতে যাচ্ছিলাম সঠিক সময়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। এখনও মুখে তুলিনি, এই নামিয়ে রাখলাম,’ বলেই উঠে দাঁড়ালেন। অভুক্ত বেরিয়ে এলেন সেই বাড়ি ছেড়ে। কেউ বাধাও দিল না।



বিভুতিভূষণের সঙ্গে বন্ধুত্ব 

শত্রুতা যেমন পেয়েছেন, ভালবাসার বন্ধুও পেয়েছেন তিনি। তেমনই এক বন্ধু ছিলেন আরেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণ।

সে বন্ধুত্ব খুবই হৃদ্যতায় ভরা।

একবারের ঘটনা। রাতের ট্রেনে দুই বন্ধু তারাশঙ্কর আর বিভূতিভূষণ যাচ্ছেন দূরের এক সাহিত্যসভায়। রাতের খাবার এত বেশি খেয়ে ফেললেন বিভূতি যে, হাতমুখ না ধুয়েই সটান বার্থে শুয়ে পড়লেন। নড়াচড়ার ক্ষমতাও নেই।

তারাশঙ্কর দুজনের এঁটো গুছিয়ে হাতমুখ ধুচ্ছেন, বিভূতিভূষণের কাতর আবদার, ‘ভাই আমার মুখ হাতটা একটু ধুয়ে দিবি? এত খেয়ে ফেলেছি যে আর নড়তে পারছি না।’

তারাশঙ্কর মুচকি হেসে খুব যত্ন নিয়ে বন্ধুর এঁটো হাতমুখ ধুইয়ে, ধুতির খোট দিয়ে মুছিয়ে দিলেন। নির্বিকার বিভূতি ঘুমিয়ে পরলেন পাশ ফিরে।

অন্যবারের কথা। তারাশঙ্কর মোটরগাড়ি কিনেছেন। তখন তিনি সাহিত্যিক হিসেবে তো বটেই আর্থিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত।

আর বিভূতিভূষণ রাস্তাঘাটে যাকে পান, তাকেই তুমুল আহ্লাদ করে বলতে থাকেন, ‘‘আরে শুনেছ তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে।'

শুধু দেখা হলে নয়, পয়সা খরচ করে লোকের বাড়ি-বাড়ি গিয়েও সে-খবর দিতে থাকলেন অন্যদের। তাতে এক বন্ধু একবার একটু বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন, ‘তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে তো আপনার কী?’’

এ কথায় বিভূতিভূষণের উত্তরটা একবার শুনুন। বলেছিলেন, ‘আরে একটা মানুষ শুধু লিখে একটা আস্ত মটরগাড়ি কিনে ফেলেছে, এতে আনন্দ পাব না!’

 

ধূমপান ছাড়ার তারাশঙ্করীয় পদ্ধতি

যেকোনো বিষয়েই দৃঢ় মনোবলের ব্যক্তি ছিলেন তারাশঙ্কর। 

জেদের প্রমাণ একবার পেয়েছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেবার বড় মাপের একটি পুরস্কার পেয়েছেন তারাশঙ্কর, তরুণ সুনীল গিয়েছেন সাক্ষাৎকার নিতে।

কথায় কথায় তারাশঙ্কর বলে উঠলেন, ‘আমার জেদ চিরকালই বড্ড বেশি। এই দেখো না জেদের বশে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ধরে সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস একদিনে ছেড়ে দিলুম।’

এ কথা শুনে  সুনীল অবাক। সিগারেটের নেশা ছাড়া যে কী কঠিন, চেইন-স্মোকার মাত্রই জানেন। কৌতূহলী সুনীল জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘এত কঠিন কাজ একদিনে করলেন কী করে?’’

কোনও কথা না বলে বাঁ-হাতখানা উঁচু করে দেখালেন। সুনীল শিউরে উঠে লক্ষ করলেন বাঁ হাতের কবজি থেকে শুরু করে তালু পর্যন্ত অনেকগুলো গোল গোল পোড়া-ছ্যাঁকা দাগ।

জিজ্ঞাসা করলেন ‘ও কী? এটা কী?’

‘কিছু না। সিগারেট ছাড়ার পর ও জিনিস আবার খেতে লোভ হলেই সিগারেট ধরিয়ে নিজের হাতে ছ্যাঁকা দিয়েছি। তাই এখন আর লোভ হয় না।’

 

লেখার প্রতি তারাশঙ্করের ধৈর্য আর নিষ্ঠা

বন্ধু লেখক বিভুতিভূষণ একবার বলেছিলেন,' তারাশঙ্কর লিখতে শুরু করলে জগতের বাইরে চলে। ওর মতো নিষ্ঠা আর ধ্যান করার মতো লিখতে পারলে হতো!' 

ভারতবর্ষ পত্রিকায় তখন 'গণদেবতা' ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হওয়ার পর বই হওয়ার কাজ চলছে।

প্রায় হাজার পৃষ্ঠার লেখা। তখন মাত্র আশি পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে। প্রকাশককে একদিন ডেকে বললেন, ‘ছাপানো থামাও।' 

প্রকাশক অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলেন। 

তারাশঙ্কর বললেন, 'লেখাতে ত্রুটি আছে। আবার নতুন করে লিখতে হবে।'

উপন্যাসের বাকি প্রায় নয়শো পৃষ্ঠা আবার নতুন করে লিখলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়! 

১৮৮৩ পঠিত ... ১০:৫৬, জুলাই ২৪, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top