তাঁর নাম দোপেয়াজা। ছদ্মনাম অবশ্যই। উপায় আর কী? বৃটিশ আমলে আর পাক আমলে যেভাবে নানা রকম বিদ্রুপাত্মক কার্টুন এঁকে গেছেন, ছদ্মনাম তাঁর না হলে আর কার থাকবে?
ভদ্রলোকের আসল নাম কাজী আবুল কাশেম। উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট। ১৯১৩ সালে ঝিনাইদহে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর বাবা কাজী মকবুল আলী শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম আধুনিক মুসলিম গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেনের বন্ধু ছিলেন কাজী আবুল কাশেমের বাবা।
বিধি বাম, চার বছর বয়সে বাবা, আর পাঁচ বছর বয়সে মা-কে হারান কাজী আবুল কাশেম। এরপর যেন এক শিশুর স্ব-শিক্ষিত হয়ে বেড়ে ওঠার গল্প। ১৯২৬ সালে তার চিত্রকর্মে মুগ্ধ হয়ে ফরিদপুর শহরের এক পাদ্রি তাকে নিয়ে কলকাতা যান গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি করানোর উদ্দেশ্যে। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বয়স কম হওয়ার কারণে দেশে ফিরে আসেন। ১৯২৮ সালে আসাম হয়ে পুনরায় কলকাতা যান।
১৯৩০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন সম্পাদিত, বিখ্যাত মাসিক সওগাতে (বাংলা ১৩৩৭ সালের পৌষ সংখ্যা) প্রকাশ হয় তার প্রথম কার্টুনচিত্র। এর মাধ্যমে কাজী আবুল কাসেম পরিচিত হন প্রথম বাঙালি মুসলিম কার্টুনিস্ট ও চিত্রশিল্পী হিসেবে। এরপর বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় তার আঁকা একরঙা ও বহুরঙা চিত্র ও কার্টুন প্রকাশ হতে থাকে। অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ হয় তার নিপুণ হাতে পরম আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততায়। কলকাতার কমার্শিয়াল আর্ট স্টুডিওতে তিনি সামান্য বেতনে চাকরিতে প্রবেশ করে অল্প সময়েই প্রতিষ্ঠানের প্রধান চিত্রকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মহান সৈনিক কাজী আবুল কাসেম তার আঁকা ‘হরফ খেদাও’ কার্টুন চিত্রটির কারণে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। ১৯৬০ সালে এক বছর অস্থায়ীভাবে টেকস্ট বুক বোর্ডের আর্ট রিভ্যুয়ার এবং ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগ্রামসের প্রধান শিল্প নির্দেশক ও শিশুসাহিত্যের বইয়ের রিভ্যুয়ার হিসেবে চাকরি করেছিলেন। এরপর তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবিভক্ত বাংলার একজন পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট ছাড়াও তিনি শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার, শৌখিন কণ্ঠশিল্পী, আধুনিক এক বিজ্ঞানমনা ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমি পদক, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র স্বর্ণপদক, এস এম সুলতান স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার, নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
শিল্পী কাজী আবুল কাসেম তাঁর আত্মকথায় লিখছেন: ‘আমি লেখক নই। সামান্য চিত্রকর; তাও আবার কমার্শিয়াল ছবি, ভুখা-নাঙ্গা ঘুচানোর তাগিদে।...কলকাতায় ছিলাম, অনেক বড় বড় লেখকের লেখা পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি, হেসেছি, কেঁদেছি।...এখানে শরৎচন্দ্র নেই, তারাশঙ্কর নেই,...কিন্তু বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বার্ধক্যের দোরগোড়ায় আসতেই একে একে বেরিয়ে এলেন শওকত ওসমান, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ সোনার চাঁদ লেখকেরা। এঁদের লেখা পড়ে আনন্দ আর শান্তি দুটোই ফিরে পেলাম আবার।’
যতই তিনি বলনু ‘আমি লেখক নই’, তিনি অবশ্যই লেখক। শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৮ সালে। এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়, তাঁর স্মৃতিকথা ‘পূবের জানালা’ যারা পড়বেন, বিস্মিত হবেন।
২০০৪ সালের ১৯ জুলাই এই মহান শিল্পী পরলোকগমন করেন। তাঁরই কিছু কালজয়ী কার্টুন, ইলাস্ট্রেশন আর তেলচিত্রের মাধ্যমে ঘুরে আসা যাক ‘দোপেয়াজা কর্মে'।
১#
২#
৩#
৪#
৫#
৬#
৭#
৮#
৯#
১০#
১১#
১২#
তথ্যসূত্র ও ছবি কৃতজ্ঞতা: কাজী আবুল কাশেমের ওপর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর এবং 'কাজী আবুল কাশেম' ফেসবুক পেজ।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন