বাঁশের দর্শন বা ফিলসফি অফ বাম্বু

১৯৭১ পঠিত ... ১৩:৩৮, জুলাই ০২, ২০২০

 

আপনি বাঙালি হইলে বাঁশের সাথে নিশ্চয়ই পরিচিত। এমনকি শহরে জন্মানো 'ধানরে গাছ মনে করা' গোছের লোক হইলেও বাশের সাথে পরিচয় থাকা স্বাভাবিক- মেটাফরিকাল বাঁশ হইলেও। আর আপনার বাঁশ বিষয়ক অভিজ্ঞতাও ভালো কিছু হওয়ার কথা না।    

কিন্তু আমি যদি বলি, আপনার জীবন হওয়া উচিত বাঁশময়, আমারে কি আপনি দৌড়ানি দিবেন? 

বৌদ্ধ ধর্মের বন্ধুরা কিছু না মনে করলে, অর্থাৎ আমার রসিকতায় আহত না হইলে, জাস্ট রসিকতা হিসাবে নিলে, গৌতম বুদ্ধের কাছে মাফ চায়া আমি বাঁশ বিষয়ক নতুন ধরণের চার আর্যসত্য প্রস্তাব করতে চাই। প্রস্তাব কর‍তে কিছুটা সাহস পাইতেছি একটা কারণে। আমার ছোট্ট জীবনে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি ও জীবনে বাংলাদেশি যত বুদ্ধিস্ট দেখছি তারা অসম্ভব রকমের অহিংস এবং উদারমনা। বাংলাদেশ এটা মোটামুটি বিরলই বলা যায়। অন্তত এই চার আর্যসত্য বাংলাদেশের জন্যে প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। আমার মতে চার আর্যসত্য হইলো: 

জগতে বাঁশ আছে
সেই বাঁশের পেছনে কারণ আছে
বাঁশ হইতে মুক্তি আছে (বলে মনে হয়)
আসলে মুক্তির নামেও নতুন নতুন বাঁশ আছে। 

গভীর এই চার আর্যসত্য লাভ করার আগে অর্থাৎ বোধিপ্রাপ্ত হওয়ার আগে আমি অবশ্যই কিছু উন্নত জাতের বাঁশ খাইছি। তা তো সবাই খায়, আপনিও নিশ্চয়ই খাইছেন, প্রিয় পাঠক। 

পাশাপাশি বাঁশ বিষয়ক কিছু পড়াশোনাও আমি করছিলাম। আপনাদের উদ্দেশে সেই পড়াশোনার কিছু টোটকা পেশ করতে চাই। 

বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখছেন, পান্ডাদেরও (রাজনৈতিক গুন্ডা অর্থে নয়, কিউটের ডিব্বা এক প্রজাতির প্রাণী অর্থে) ডিপ্রেশন হয়। ডিপ্রেশনে পড়লে তারা অনবরত বাঁশ চিবাইতে থাকে। এটা কিন্তু আমার বানানো ফ্যাক্ট না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে এই তথ্য পাইছি। পান্ডা খুবই সংবেদনশীল প্রাণী। ডিপ্রেশনে পড়লে পান্ডাদের অস্বাভাবিক হারে বাঁশ চিবাইতে দেখা যায়। মনে করেন, বাঁশ খেয়েই আপনি ডিপ্রেশনে পড়লে কচি দেখে বাঁশ চিবায়ে দেখতে পারেন। কবির ভাষায় যারে বলা যায়, ‘বাঁশে বাঁশ'ক্ষয়’।

বাঁশ খেয়ে ডিপ্রেশনে বাঁশ খাচ্ছে পান্ডাগুলো, বাঁশে বাঁশক্ষয়?

পূর্ব এশিয়ারে বাঁশের সভ্যতাও বলা হইতো। তাদের দৈনন্দিন জীবনে বাশের বহুবিধ ব্যবহার আছে- খালি এই কারণে না। বাঁশের আক্ষরিক ও প্রতীকি গুণাগুণ শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলের ধর্ম ও দর্শনে বলা হইছে। এই অঞ্চলে ধর্ম হিসেবে তাওবাদ বেশি প্রচলিত। তাওবাদী ধর্ম ও দর্শনে বাঁশের অনেক গুরুত্ব বর্ণনা করা হইছে, উদযাপিত হইছে।  

শিখতে গেলে আমাদেরকে যাবতীয় সংস্কার থেকে প্রথমে মুক্ত করতে হবে। ভরা কাপকে আপনি কিভাবে পূর্ণ করবেন। বাঁশের ফাপা অংশটা আমাদেরকে মনে করায়ে দেয় বেশিরভাগ সময় আমরা নিজেরে নিয়াই,  নিজেদের ধ্যান-ধারণা নিয়াই আচ্ছন্ন থাকি। নতুন কিছুর জন্যে জায়গা নাই। মানুষ ও প্রকৃতির কাছ থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করতে  চাইলে নতুন ও ভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে ওপেন থাকতে হবে। যাবতীয় ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার, সত্যি বিষয়ক অনুমান, অহংকার ও ভীতি থেকে মুক্ত হইলেই আপনি নানারকম সম্ভাবনায় নিজেরে উন্মুক্ত হইলেন৷ গাছের কান্ড যেইখানে ভেতরে সলিড, সেইখানে বাশের ভেতরটা শূণ্য। তাওবাদী দর্শন অনুযায়ী, ভেতরের এই শূন্যতাই বাঁশের দৃঢ়তার উৎস। 

নিজের চোখে বাঁশবাগান দেখে থাকলে- মেটাফরিকাল অর্থে না, আক্ষরিক- আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না যে হালকা বাতাসেও বাঁশগুলা কেমন নুইয়া যায়, কখনও বা একদম মাটিতেও শুইয়া পড়ে, তারপর আবার প্রতিস্পর্ধী মাথা তুলে দাড়ায়। এই নমনীয়তা তাওবাদী দর্শনে অহংকারহীনতার প্রতীক। বেঁকে যাবেন কিন্তু ভাঙবেন না। নমনীয় হবেন কিন্তু শেকড় থাকবে গভীরে প্রোথিত।

অবাক করা ব্যাপার হইতেছে বাঁশরে শ্রেণিবিন্যস্ত করা হইছে, ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের সাথে। অথচ বাঁশ কিন্তু বড়সর গাছের মতো লম্বা আর শক্ত। তাওবাদী দর্শন ও ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, বিখ্যাত টেক্সট 'তাও তে চিং' এর রচয়িতা দার্শনিক লাও ঝু বলেন, 'আমাদের উচিৎ বাঁশের মতো হওয়া।'

তাওবাদী কবি, চিত্রশিল্পী ও দার্শনিক ঝেং শিয়ে বাঁশের, বাঁঁশবাগানের ছবি আঁকছেন ৮০০'রও বেশি। এই বাঁশ আর বাঁশবাগানরে ঝেং শিয়ে দেখছেন জ্ঞানী ব্যক্তির পারফেক্ট মডেল হিসাবে। পেন আর ইংকে অজস্র বাঁশ আঁকার ফাকে ফাকে তিনি লিখছেন:

পাহাড়ের দিকে মুখ কইরা থাকো, 
ভঙ্গুর মাটিতেই শিকড় গজাও
ঝড়-ঝাপটার পরে হয়া ওঠো আরও শক্তিশালী 
আর সব দিক থেকে আগত বাতাস থেকে নিজেরে সামলাও। 

এই কথাগুলা ঝিং শিয়ে বলছেন বাঁশেরে লক্ষ্য করে, তবে উপদেশটা দিছেন মানুষরেই।  

ঝেং শিয়ে'র আঁকা সবচেয়ে বিখ্যাত 'বাঁশচিত্র'

যেহেতু সোনার বাংলায় জন্মাইছেন, জীবনে অনেক রকম বাঁশ- মোটা ও চিকন বাঁশ- আপনারে খাইতে হবে। এই ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশমাত্র নাই। বাঁশ খাওয়া অত্র অঞ্চলে এক অনিবার্য বাস্তবতা। এই কারণেই আমার বাঁশের চার আর্য সত্য প্রস্তাব করা।

লেখার শেষে একটা কথাই বলবো: অন্যেরে বাঁশ দেয়া থেকে বিরত থাকেন, কিন্তু নিজে হয়ে ওঠেন বাঁশের মতো।

১৯৭১ পঠিত ... ১৩:৩৮, জুলাই ০২, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top