বাংলার বিত্তবানদের মধ্যে বাগান করার শখ নাই কেন?

৭৩৫ পঠিত ... ১৯:৫৯, জুলাই ০১, ২০২০

করোনার সময়ে মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত৷ আবার লকডাউনের কারণে বাসা থেকে বের হওয়াও বন্ধ। ফলে বাড়িতেই অবস্থান করছেন বেশিরভাগ মানুষ। সময়টা কাটাতে নানা রকমের শখের কাজকর্ম করছেন অনেকেই। এর মধ্যে শহরে হলে ঘরের ছাদে বারান্দায় আর গ্রামে হলে নিজের বাড়িতে অনেকেই ছোটখাটো কৃষি বা বাগান করছেন। করোনা সংকটে বিশ্বজুড়ে বিশেষত গৃহকৃষি বা বাগান করাটা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ তবে করোনা-পূর্ব কালেও অনেকেই কিন্তু শখ হিসেবে বাগান করতেন।

ইম্প্রেশনিস্ট ধারার সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ক্লদ মনে প্রায়ই বলতেন, আমার বাড়ির বাগানটাই আমার সুন্দরতম মাস্টারপিস। প্রাচীন রোমের বিখ্যাত স্টয়িক দার্শনিক ও বক্তা মার্কাস তুলিয়াস সিসেরো খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে তার বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছেন: 'গ্রন্থাগারের পাশাপাশি তোমার যদি একটা বাগান না থাকে তাহলে জীবন পূর্ণ হয় না।'  

প্রশ্ন করা যায়, মানুষ বাগান করে কেন? অথবা প্রাসঙ্গিক অন্য একটা প্রশ্নও করা যায় বাংলাদেশের মানুষের কাছে শখ হিসেবে বাগান তেমন জনপ্রিয় না কেন?  

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আপনি রেডিমেড উত্তর দিতে পারেন যে সে ইট-পাথরের জঞ্জালের মধ্যে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে প্রকৃতির সান্নিধ্য চায়। তার পূর্বপুরুষের একসময়ের আবাসস্থলের স্মৃতি তাকে ডাকে। তাকে নস্টালজিক করে তোলে। কারণ তার পূর্বপুরুষেরা একসময় ছিল অরণ্যচারী। 

আপনার উত্তরের সাথে একমত হবেন শখের বাগান করা বিষয়ক বেস্টসেলার বইয়ের লেখক মাইকেল পোলান। 

পোলান তার  বই 'সেকেন্ড নেচার: এ গার্ডেনার'স এডুকেশন'-এ লিখেছেন, বাগান আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয় যে হয়তো এমন আবাসও চাইলে পাওয়া যাবে যেখানে আমরা পুরোপুরি না হলেও প্রকৃতির কিছুটা কাছাকাছি যেতে পারি। 

কিন্তু সেটিই যদি হয়ে থাকতো তাহলে মানুষ গ্রিন সিটি করতে পারতো। তার বাড়িঘরকে এমনভাবে নির্মাণ করতে পারতো যে তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই গাছপালা বা সবুজের সমারোহ হয়। কিন্তু সে কী করে? বড়জোর বারান্দায় বনসাই করে। ছাদে ছোট ছোট গাছ লাগায় সৌন্দর্য  বর্ধন করে। সে কিন্তু তার জীবনযাপনের সঙ্গে বাগানকে, সবুজের সমারোহকে অবিচ্ছেদ্য করে তোলেনি৷ 

বাংলায় শখ হিসেবে বাগান করা বা গার্ডেনিং খুব একটা প্রচলিত না। একসময় দেশের জমিদারশ্রেণির লোকজন অবশ্য নিজেদের ব্যক্তিগত বাগান করতো। তাও যতটা না বাগান করার তার চাইতে বেশি বাগানবাড়ি বানানো আসলে। কিন্তু তা পশ্চিমের শহরগুলোতে যেমন পরিচিত তেমন না৷ 

যদিও পাঠ্যপুস্তকে হাউ টু মেইক এ গার্ডেন বা বাগান করার শখ হিসেবে স্কুলে প্যারাগ্রাফ বা প্রবন্ধ পড়ে এদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা। অথচ দেশে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা অনেক হলেও তাদের মধ্যে বাগান করার শখটা খুব একটা দেখা যায় না।

কেন বাংলার বিত্তবানদের মধ্যে বাগান করার শখ বা আগ্রহ নাই, সেই প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর দেয়া কঠিন। অগ্রহণযোগ্য উত্তরের কথা অবশ্য ভাবা যেতেই পারে। হাইপোথেটিক্যাল ভাবনা-চিন্তা করতে তো কোনো সমস্যা নেই। 

একটা কারণ এমন হতে পারে যে এখানে ইউরোপের মতো স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ ঘটে নাই। কলোনি চৈতন্যে পুষ্ট এখানকার ধনিক শ্রেণি মূলত ফিউডালিজমের ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট। ফিউডালিজম বা সামন্তবাদ থেকে একলাফে পচা বুর্জোয়াতে পরিণত হয়েছে। এদের বুর্জোয়ার মনোগঠন ইউরোপিয়ান বুর্জোয়ার মতোও নয়। ইউরোপের বুর্জোয়ারাই ফিউডালিজম থেকে গণতন্ত্র নিয়ে এসেছে, তাদের সামষ্টিক চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রতি আস্থা ও আকাঙ্ক্ষা। ফলে ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের মতো এখানে শিল্প-সাহিত্যসহ নানা ধরণের কাজে বা এদেশি বুর্জোয়াদের অংশগ্রহণ বা পৃষ্ঠপোষকতা দেখা যায় না। প্রচুর অর্থবিত্ত থাকার পরেও এদেশের বিত্তবানদের বাগান করাসহ বিচিত্র ধরণের শখের কোনোটিতেই দেখা যায় না। এই ব্যাখ্যায় কিছু সত্যি থাকতে পারে তবে সর্বজনগৃহীত কোনো ব্যাখ্যা আদৌ আছে কিনা সন্দেহ করা যায়৷ 

এমনকি মানুষ কেন শখ হিসেবে বাগান করে এই প্রশ্নই এমন যে নির্দিষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর আশা করাই বোকামি। হাজারও উত্তর মিলবে। একেকজন একেক  কারণে বাগান করতে পারে, তার নিজস্ব প্রয়োজন ও ভালোলাগা অনুযায়ী। প্রাচীনকাল থেকে দার্শনিকরাও অনেক কারণ ভেবেছেন কেন মানুষ শখ করে বাগান করে। প্লেটো মনে করতেন, বাগান ছাড়া উন্নত জ্ঞানচর্চা সম্ভব না। জ্ঞানচর্চার জন্যে গুরুর কাছে বাগানে যেতে হবে।, প্লেটোর একাডেমি ছিল একটা বাগানের মধ্যেই। এপিকিউরাস তার স্কুলটা করেছেন বাগান হিসেবে। এপিকিউরাসের শিষ্যরা শেখানে স্থায়ীভাবে থাকতো, জ্ঞানচর্চা করতো। আর বাগানের মধ্যে থাকা খাওয়া চলতো। প্রাচীন ভারতে অরন্যে জ্ঞানচর্চার ইতিহাস সুবিদিত। ভারতে একে বলা হতো তপোবন, তপস্যা বা সাধণার জন্যে যে বন। আসলে বাগান কেন করে এই প্রশ্নের উত্তর এতো বিচিত্র যে সেগুলোর আলোচনা করে শেষ করা যাবে না।

সবচেয়ে র‍্যাডিকেল একটা ব্যাখ্যা দিয়ে লেখা শেষ করা যাক। 

এই ব্যাখ্যার প্রবক্তা দর্শনের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারি দার্শনিকদের একজন নিটশে৷ আপনি নিটশেপন্থী হলে অবশ্য অন্যরকম এই ব্যাখ্যাটা হাজির করতে পারেন। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নীটশে মানুষের সমস্ত কাজের পেছনে মোটিভেশন হিসেবে দেখেছেন 'উইল টু পাওয়ার' বা 'ক্ষমতার বাসনা'কে। মানুষের সমস্ত কাজ, নীটশের মতে আসলে ক্ষমতার বাসনা থেকে উদ্ভুত। নীটশে চিন্তাপদ্ধতি বুঝতে তার 'উইল টু পাওয়ার' থেকেই উদ্ধৃতি দেখা যাক:

: ভালো কী?
: তা-ই, যা কিছু ক্ষমতা থাকার বোধকে বাড়ায়।
: মন্দ কী?
: তা-ই যা কিছু দূর্বলতা  থেকে আসে।
: সুখ কী?
: সুখ সেই বোধ যে ক্ষমতা বাড়তে থাকে, সেই জ্ঞান যে আরেকটা পথের বাধা দূর হলো।  

মানুষের ক্ষমতা ও ডমিন্যান্সের প্রকাশ হিসেবে বাগান বা বনসাই করাটাকে দেখা যায়। মানুষ  স্বভাবতই চায় সবকিছুর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে। মানুষ বনের জীবজন্তুর ভয়ে, জীবজন্তুদের সাথে লড়াই করে একসময় জীবন ধারণ করেছে। পরে সে পশুপাখিকে চিড়িয়াখানায় রেখেছে৷ প্রকৃতির অধীনে, প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে তার জীবন একসময় আবদ্ধ ছিলো।  পরে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করেছে, বশে এনেছে। সে প্রকৃতিকে নিজের শাসনের অধীন করে নিয়ে আসতে বাগান করে। বিরাট গাছ বনসাই করে রাখে। অ্যাকুরিয়ামে মাছ রেখে দেয়। 

এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে হবে এমন না। কিন্তু ব্যাখ্যা হিসেবে ইন্ট্রেস্টিং সন্দেহ নাই। আপনার সন্দেহ থাকুক বা না থাকুক এই করোনাকালে শখের বশে বাগান করে দেখতেই পারেন। বারান্দায় হোক, ছাদে হোক, আর শহরের বাইরে হলে তো অবশ্যই আপনি অনেক জায়গা পেয়ে যাবেন। শখ হিসেবে বাগান করাটাকে বিবেচনা করতে পারেন। একটু সবুজ বাড়িয়ে নিলেন, অক্সিজেন বাড়লো আপনার চারপাশে। ক্ষতি কী?

৭৩৫ পঠিত ... ১৯:৫৯, জুলাই ০১, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top