সম্প্রতি ফেসবুকে একটা 'মধ্যবিত্ত' লেখা খুব ভাইরাল হতে দেখা গেছে। লেখার মূল ভাষ্য, মধ্যবিত্তদের বেহিসেবী খরচই করোনার এই সময়ে মধ্যবিত্তদের সাফারিংয়ের কারণ। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা, কফিশপে গিয়ে কফি খাওয়া, বাদাম খেয়ে আড্ডার বদলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে চিল করার কারণেই অনেক মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বা ভুগতে হচ্ছে বলে আমরা এই লেখাটি থেকে জানতে পারি।
এছাড়াও নিত্যনতুন গ্যাজেট কেনা, টাইলসের বাসায় থাকা, হুদাই 'পশগিরি' দেখানোটাও এখনকার মধ্যবিত্তদের ভোগান্তির পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ বলে লেখাটি থেকে জানা যায়। আগের দিনে মধ্যবিত্তরা টাকা জমিয়ে কিভাবে ঢাকায় জমি জিরাত কিনতো, সেসব স্মৃতিচারণও আমরা দেখতে পাই।
তবে এই লেখাটি পড়ে মধ্যবিত্ত মনে কিছু প্রশ্ন জেগে ওঠেই, বিভিন্ন পশগিরি দেখানোর 'মধ্যবিত্ত ইচ্ছার' মতো যেই প্রশ্নগুলোকে দাবিয়ে রাখা কঠিন।
প্রথমত, একটু ভেবে দেখেন, আপনার পরিচিত কয়টা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির পোলাপানরে আপনি চেনেন যে আগে ক্রিমসন কাপে কফি খায়া বেড়াইত, কিন্তু এখন নিয়মিত ভাত খাইতে পারতেছে না, বা সামনে খাইতে পারবে না সেই টেনশনে আছে? যারা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় বা খায়-দায়, তাদের কাউকে দেখছেন করোনার এই সময়ে অনেক অভাবগ্রস্থ, অনুদান চাইয়া বেড়াচ্ছে, সরকারি ন্যায্যমূল্যের দোকান ছাড়া জিনিস কিনে না?
এই লেখার ভাষ্য অনুযায়ী, ঘোরাঘুরি, বাইরে খাওয়া-দাওয়া বা এই ধরনের চিত্তবিনোদন এ সময়ের পোলাপানদেরই আবিষ্কার। সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখা আমাদের প্রজন্মের যারা বাপ মা, তারা কি হলে সিনেমা দেখেন নাই বলতেছেন? তাইলে কি ফ্যামিলি নিয়া ম্যাটিনি শো দেখতে যাওয়ার গল্পগুলা ভুয়া?
তবু কিছুক্ষণের জন্য ধরে নিচ্ছি, এইসব বিনোদনের খরচ না করলে তারা এখন প্রতি মাসে ঘরে বসে বসেই বাসা ভাড়া দিতে পারতেন। টাইলসের বাসাও বাদ দিলাম, ঢাকা শহরের যেকোনো জায়গায় এখন খুবই নরমাল (যাকে বলে মধ্যবিত্ত বাসা) যে কোন বাসার ভাড়া কত? আর যদি টিনশেড একতলা কোন বাসায় থাকার কথা আপনি বলেন, সেইখানের পরিবেশে আপনার মধ্যবিত্ত বাপ-মা থাকতে পারবে? যদি আপনার বাপ-মা থাকতেও পারে, সবার বাপ-মা থাকতে পারবে সেই নিশ্চয়তা আপনি কীভাবে দেন?
এরপর আসি জায়গা জমি কেনার প্রসঙ্গে। মধ্যবিত্ত-অর্থনীতিবিদ ভাইটি বলছেন, মধ্যবিত্ত সেভিংস দিয়ে (মানে এই যে বিভিন্ন জায়গায় খাইয়া-ঘুইরা কমায়া যেই টাকা আপনি বাঁচাইবেন) ছোট্ট এইটুকু জমি কিনে ফেলার কথা। 'নব্বইয়ের দশকে মানুষ গরিব থাকলেও তাদের একটুখানি জমিটমি ছিল'। কিন্তু যেই দশকে আপনার বাপ মা পনের হাজার টাকা বেতনে সংসার চালাইত, সেই দশকে এই শহরে জায়গার দাম কত ছিল? আর এই দশকে পঞ্চাশ হাজার বেতন পায়া সংসার চালানো আপনার শহরে জায়গার দাম কত? সময় এবং যুগের প্রয়োজনে (অথবা চাপেও, বলতে পারেন) খরচের খাত যে কয়গুণ বাড়ছে, সে প্রসঙ্গ নাহয় থাকুক।
ট্যুরে না গিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার রোমান্টিক পরামর্শও আমরা লেখাটিতে পাই৷ তবে প্রশ্ন হলো, আপনার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার বাস ভাড়া কত, আর ট্যুরে যাওয়ার বাস ভাড়া কত? কত টাকা বাঁচে? ওই টাকা জমায়ে ছয় মাস চলা যায় ঢাকায়? গ্রামের বাড়ি এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কি সবার সেই হৃদ্যতা আছে যে সেখানে গেলে তার মানসিক চাপ, নগরজীবনের স্ট্রেস যথেষ্ট পরিমাণ কমবে? যদি সেই হৃদ্যতা না থাকে, সেজন্যও কি সে-ই দায়ী? আর এক গ্রামের বাড়ি আপনি কয়বার যাবেন, সেইটা আপনার মেন্টাল হেলথের জন্য খুব ভালো কিছু কিনা, সেসব নিয়াও কথা বাড়ানো অনর্থক।
ট্যুর দেয়া, সিনেমা দেখা, আড্ডা দেয়া, রেস্টুরেন্টে বসা (ঢাকায় আর কোথাও বসার সুযোগ আছে কি?) এসব চিত্তবিনোদন কিংবা বিনোদন খাতের খরচকে আপনি এক কথায় অপ্রয়োজনীয় খরচ বলতে পারেন কিনা, সে নিয়ে বিতর্কটাও থাকুক। তবে আপনি যদি মনের বদলে শুধু শরীর বাঁচায়ে রাখতে চান, তাহলে অবশ্য এইসব খরচের কোনো প্রয়োজন নাই।
এ প্রসঙ্গে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো। এক ধূমপায়ীকে তার বন্ধু বললো, 'তুই সিগারেট খাইয়া এতদিনে যত টাকা খরচ করছিস, সিগারেট না খাইয়া সেই টাকা জমাইলে এতদিনে একটা গাড়ি কিনে ফেলতে পারতি।' ধূমপায়ী বন্ধু উত্তর দিল, 'তুই তো সিগারেট খাস না, তোর মার্সিডিজটা কই?'
যেই মধ্যবিত্তদের কথা বলা হইলো, যারা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখে, কফিশপে কফি খায়া বেড়ায়, নিয়মিত ট্যুরে যায়, তাদের কথা না হয় তবুও বাদ দিলাম। এই সকল কোন কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত না এমন অসংখ্য মধ্যবিত্ত যারা আছেন এদের সমস্যাটা কই তাইলে? এরা কেন টাকা জমাইতে পারতেছে না? এদের ঘরবাড়িগুলা কই?
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন