মিঠেখালির হাটে দৌড়ে চলেছে একটি শিশু। তার দু'হাতে আলগোছে ধরে রাখা অমূল্য সম্পদ। সম্পদের নাম হাওয়াই মিঠাই।
সম্পদের ভোক্তা হচ্ছে আরেকটি শিশু। তার ছোট বোন। শিশুটি যতোই দ্রুত দৌড়াচ্ছে, হাওয়াই মিঠাই গলে গলে হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে। শিশুটি দৌড় আরও বাড়ালো। সম্পূর্ণটা গলে যাবার আগেই তাকে বোনের কাছে পৌঁছাতে হবে। বোনের এই জিনিস খুবই প্রিয়।
অর্ধেক রাস্তা যাবার আগেই হাওয়াই মিঠাই গলে শেষ! শিশুটি গভীর বেদনায় আক্রান্ত হলো। এই বেদনা তার সারা জীবনে যায়নি। মরবার আগে এই বেদনা বোনের কাছে বলে যান, তখনও শিশুর মতোই কাঁদছিলেন। তিনি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
মরণে কত বয়স হয়েছিলো তাঁর? আমি চমকে উঠে আবিষ্কার করি- আমার কাছাকাছি বয়সীই! যে বয়সে রক্তের উত্তেজনা আস্তে আস্তে কমে কমে আসে, সময়ের পরিপক্কতা যোগ হয়ে হয়ে আসল শিল্পী পূর্ণতার দিকে ধাবমান হন, তখনই তাঁর চলে যাবার সময় হলো।
দ্রোহের কবি বলা হয় তাঁকে। প্রেমেরও কবি। ব্যক্তি রুদ্র প্রচণ্ড খামখেয়ালী। জীবন নিয়ে নানা নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে গেছেন। আবার কবি রুদ্র তাঁর কবিতার ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। প্রতিটা কবিতাই যেন আলাদা স্বত্তা। কলেজে উঠে তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচয়। প্রথম কবিতাটা ছিলো-
একদিন আমি আত্মার ভেতর
আত্মহত্যা করলাম
অথচ কেউই করলো না শোক
শুধু
আমার ব্যক্তিগত ডায়রির একটি পৃষ্ঠা
নিঃশব্দে খসে গেল।
(নিজস্ব সাইক্লিক অর্ডার)
ধাক্কা খেয়েছিলাম। এইভাবেও ভাবা যায়? এইভাবেও নিজের নিঃস্ব হওয়া নিয়ে চিন্তা করা যায়?
তারপরে তো পরিচয় হলো 'আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই' কিংবা 'জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন' এইসব বিস্ফোরক লাইনগুলোর সাথে। রুদ্র তখন আমার গোপন প্রেম। কলেজের লাইব্রেরিতে রুদ্রের একটা কবিতা সংকলণ ছিলো। ঐ বইটা মনে হয় কলেজে আমিই সবচেয়ে বেশি রেজিস্ট্রি করেছি!
একাত্তরের ভয়াবহ অত্যাচারের প্রথম আবহ টের পাই রুদ্রের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প পড়ে। ওহ, কী বীভৎস বর্ণনা! আমার মনে আছে, একেকটা ছত্র পড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। বাসায় বুটের ডাল দিয়ে গরুর মাংস রান্না হয়েছিলো। আমার প্রিয়। সে রাতে একদানা ভাত মুখে তুলতে পারিনি।
তসলিমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন একাশিতে। ছাড়াছাড়ি হয় কবে? অষ্টাশিতে? কবির কষ্ট অনুরণিত হয় শত-সহস্র কবিতায়। জীবনের প্রথম প্রণয়ে, প্রথম বিরহে রুদ্র ছিলেন গোপন আশ্রয়। শুধু আমারই না, অনেক তরুণেরই মনে হয়। কী দারুন আকুতি তাঁর প্রণয়ে নিমজ্জিত হবার... কী দারুণ শক্তি তার প্রণয় কূপ থেকে ডানা মেলে আকাশে উড়বার!
বিচ্ছেদের পরের বছরেই সম্ভবত লিখেন সেই বহুল জনপ্রিয় 'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো'
কার জন্য লিখেছিলেন সেই পঙক্তি? তসলিমার জন্য? তসলিমাই হাহাকার করে জানতে চেয়েছিলেন- মনে মনে তুমি কার চিঠি চেয়েছিলে? আমার? নেলী খালার? শিমুলের?
তসলিমাকে আদর করে ডাকতেন সকাল। সকালের বিরহেই তিনি জীবনের বিকেল দেখতে ভুলে গেলেন? কে বলতে পারে?
কবীর সুমন বলেছিলেন- আমি ঈর্ষা করি, যত দিন না আমার দাফন হবে, আমার ধারনা আমার দাফনের পরও আমি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে ঈর্ষা করব। খোদার কসম আমি রবীন্দ্রনাথকেও ঈর্ষা করি না। আমি ঈর্ষা করি লালন ফকিরকে, হাসন রাজাকে, কবি জসিমউদ্দিনকে, আর এই লোকটাকে যে দুটো লাইন লিখতে পেরেছিল। আর কাউকে আমি ঈর্ষা করিনা।
ভাল আছি, ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।
আজকে একুশ জুন। বেঁচে থাকলে চৌত্রিশে আটকে না থেকে আপনি হতেন চৌষট্টির প্রবীণ। কে জানে, আকাশের ঠিকানায় হয়তো ভালোই আছেন আপনি।
আজ নাকি আপনার মৃত্যুদিন। কোন অর্বাচীন বলে এমন কথা? আমার কাছে আপনি কখনই মরেননি। রুদ্রেরা মরে না।
ভালো থাকবেন, প্রিয় কবি!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন