এই যুগে যা নরমাল, আগামী যুগে কি সেগুলো পার্ভাশন বলে গণ্য হবে?

১০৪৩ পঠিত ... ২২:৩৮, জুন ১৮, ২০২০

 

ভাবনাটা মনে এলো সম্প্রতি। 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' বা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন শুধু আমেরিকা নয় বিশ্বের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছে। তারই প্রেক্ষিতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস, উইন্সটন চার্চিল বা মহাত্মা গান্ধীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তির ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার দাবি তুলছেন অনেক আন্দোলনকারী। কোথাও কোথাও এদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছেও। আন্দোলনকারীদের দাবি এরা বর্ণবাদী।

এমনই পটভূমিতে ভাবনাটা মনে এলো৷ 

আমি বলছি না উইনস্টন চার্চিল বা মোহনদাস করমচাদ গান্ধী কিংবা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মধ্যে বর্ণবাদিতা ছিলো না। অবশ্যই তাদের বর্ণবাদী আচরণের অনেক নজির আছে। সত্যি বলতে কি, তাদেরকে কেউ যদি রেসিস্ট বা বর্ণবাদী বলে, তা মোটেই মিথ্যা হবে না। 

তারা যে বর্ণবাদী তার প্রমাণ হলো, এদের সমসাময়িক অন্যান্য বিখ্যাত লোকদেরকে কিন্তু আন্দোলনকারীরা বর্ণবাদী বলছেন না। ফলে আমার বক্তব্য এমন না যে এরা বর্ণবাদী না। আমার বক্তব্য অন্যত্র। 

আমরা অন্য যুগের মানুষকে বিচার-বিবেচনা করার সময় বর্তমানের প্রভাবশালী (ডমিন্যান্ট) নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কিংবা রাজনৈতিক আবহাওয়া দিয়ে প্রভাবিত হই। 

বর্ণবাদ কথাটাই বিবেচনা করা যাক। ইতিহাসের সব কালে বর্ণবাদের চেহারা ও সংজ্ঞা কি একইরকম ছিলো? নিশ্চয়ই না। বর্ণবাদের এখনকার সময়ের মোটামুটি প্রচলিত সংজ্ঞা দেখা যাক। 

বলছি না উইনস্টন চার্চিলের মধ্যে বর্ণবাদিতা ছিলো না। কিন্তু ইতিহাসের সব কালে বর্ণবাদের চেহারা ও সংজ্ঞা কি একইরকম ছিলো?

সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপকে বর্ণবাদ বলা হয় যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একই সাথে বিশ্বাস করা হয় কোন কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য। 

বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। কারণ, গবেষকদের মধ্যে গোষ্ঠী (race) ধারণাটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এছাড়াও কোনটি বৈষম্য এবং কোনটি বৈষম্য নয় সেটি নিয়েও সবাই একমত নয়। বর্ণবাদ কখনও গায়ের চামড়ার রং দিয়ে হতে পারে, কখনও আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনও গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনও বর্ণ (caste) দিয়ে হতে পারে।

কোনো কোনো সমাজতাত্ত্বিক মনে করেন, কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনও তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধুমাত্র বর্ণবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ। 

ধরা যাক, আপনার জন্ম এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসে৷ প্রাচীন গ্রীসে দাসপ্রথ চালু ছিলো। 

আপনি কি তখন দাসপ্রথার বিরোধিতা করতেন? বিরোধিতা মানে সমাজ-ব্যবস্থা বদলানোর দাবিতে তীব্র বিরোধিতা বলতে যা বোঝায়? 

প্লেটো বা সক্রেটিস বলেন বা মহাজ্ঞানী এরিস্টটল বলেন, তাদের সময়ে প্রচলিত দাসপ্রথার বিরোধিতা এদের কেউই করেননি বলেই প্রথাটা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কিন্তু লক্ষ্য করুন, তখন পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিলো দাসপ্রথাকেন্দ্রিক। আবার এই দার্শনিকেরাও যে নীতিহীন খারাপ লোক ছিলেন তাও না। 

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে প্রচলিত ধর্মগুলোর তুলনায় ইসলাম ধর্মের অনেকগুলো প্রগতিশীল ও জনমুখী চিন্তা থাকলেও, বা ইসলামে বর্ণপ্রথার কঠোর বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও ইসলাম কিন্তু দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করতে পারেনি। যদিও অনেকগুলো হাদিসে দাসকে মুক্ত করে দেয়ার জন্যে মুসলিমদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে, কিন্তু একেবারে নিষিদ্ধ করতে পারেনি। কারণ তখনকার সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দাসপ্রথা অধিকাংশ লোকের কাছে যে শুধু স্বাভাবিক ছিল তাই না, কোথাও কোথাও প্রয়োজনীয়ও ছিলো। 

তবু পৃথিবীর রেকর্ডেড হিস্ট্রিতে সর্বপ্রথম বর্ণবাদের বিরোধিতা করেছেন প্রাচীন গ্রিসের নাট্যকার ইউরিপিদিস।

কথা হলো, প্রাচীন দাসপ্রথাকেন্দ্রিক পৃথিবীতে থাকলে আপনার মতামত কি এরিস্টটল বা তখনকার ইসলামের চেয়ে খুব বেশি আলাদা হতো? এবং দাসপ্রথাকে মেনে নেয়ার জন্য কি তখনকার সব্বাইকে আপনি দোষারোপ করবেন? সবাই খারাপ, বর্বর? 

এই প্রশ্নগুলো অস্বস্তিকর। কিন্তু জাজমেন্টে আমাদের বায়াস থেকে মুক্তি পেতে, অতিসরলিকৃত চিন্তার বলি হওয়া থেকে বাঁচতে এই  ধরণের অস্বস্তিকর প্রশ্নও তোলা উচিত। 

অতীতের সমাজ ও সেইসব সমাজের মানুষকে বিচার যেমন আপনি করছেন, ভবিষ্যতের সমাজও কিন্তু আপনার-আমার বর্তমানের সমাজকে বিচার করবে তাদের সময়ের লেন্সে। 

মনে করা যাক, মানবাধিকার ও ব্যক্তির মুক্তি এই ধারণা আগামীর পৃথিবীর রাজনীতিতেও মৌলিক ও জরুরি প্রশ্ন হয়ে রবে। তখন বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে যে অমানষিক পরিশ্রম ও অধিকারবিহীন জীবন যাপন করতে হচ্ছে, সেটিকে কি আগামী দিনের পৃথিবীর মানুষেরা বর্বরতা ও অসভ্যতা হিসেবে দেখবে না? 

অথচ বর্তমানে আপনি-আমি মানবেতর জীবন-যাপন করা শ্রমিকদের এই বাস্তবতাকে কিন্তু প্রকারান্তরে মেনেই নিচ্ছি। এই বিকৃতি বা পার্ভাশনকে আমরা এখন তো স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছি। তার মানে আমাদের সমাজে চুপ করে থাকা এইসব লোক বর্বর?

দেখুন, এই মুহূর্তে আমরা কিন্তু ভালো-মন্দের নৈতিক বাউন্ডারির বাইরে পা বাড়াতে ইতস্তত করছি। ভালো-মন্দের নৈতিক বাউন্ডারির বাইরে দরকারি-অদরকারি, বাধ্যতামূলক/মেনে নিতেই হচ্ছে/বিকল্প নাই এমন সব শব্দের দিকে যাচ্ছি। 

ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট পরিসরে বসে আমরা যখন অন্য কোনো কালের ঘটনা, ব্যক্তি বা নীতি-নৈতিকতা বা মূল্যবোধকে বিচার করতে চাই, অনেক রকম বায়াস বা মনস্তাত্ত্বিক পক্ষপাতের শিকার হই। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠনের একটা প্রবণতা হলো সে বর্তমানের লেন্সে অতীতের পৃথিবীকে দেখে। এই লেন্সের মধ্যে প্রচ্ছন্ন তাকে বর্তমানের ডমিন্যান্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব। লেন্সে বর্তমানের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রোথিত থাকে। বর্তমানের রাজনীতি ও নৈতিকতা অতীতের মধ্যে তার ছায়া খোজে। সেখানে বর্তমানের প্রত্যাশা  মতো না পেলে তাকে বর্বর, অসভ্য বলে গণচিহ্নিত করে। প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়৷ হেরোডোটাস পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে ভাগ করেছেন দুইভাগে। এক: গ্রীক। দুই: বর্বর।

আমাদের অবশ্যই বর্ণবাদের মতো অমানবিক ব্যবস্থা ও চিন্তার বিরোধিতা থেকে বের হওয়া উচিত। আমাদের মাথায় রাখা উচিত, কোন এক যুগে/সমাজে যা নরমাল অন্য সমাজে তাও পারভার্শন বলে মনে হতে পারে শুধুমাত্র দেখার চোখের কারণে।

তবে আমাদের চেয়ে ভিন্ন অন্য যুগের বা সংস্কৃতির সমাজব্যবস্থাকে বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের সময়ের চশমাকে পরম সত্যি না ধরে, একটু উদারভাবে, একাধিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা সত্যি ও বাস্তবতার কাছাকাছি যেতে সাহা্য্য করতে পারে।

১০৪৩ পঠিত ... ২২:৩৮, জুন ১৮, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top