একাত্তরের ঈদ: যেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঈদের দিন

১৭৪৩ পঠিত ... ১৯:৩০, মে ২৩, ২০২০

২০ নভেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানের দুর্ভেদ্য মিয়ানওয়ালী কারাগার। সাধারণ কয়েদীদের মাঝে খুশির কলরব। আজকে ঈদের দিন। কারাগারের ভেতরেই ঈদের জামাত পড়া হবে। থাকবে বিশেষ খাবার।

কিন্তু বিশেষ সেলের কয়েদীদের ঈদ বলে কিছু নেই। তাদেরকে সেল থেকেও বের করা হয়নি, ঈদের বার্তা নিয়েও তাদের কাছে কেউ যায়নি।

এমনই এক সেলে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বহুদিন যাবৎ আটকে থাকায় সময়ের হিসেব তাঁর নেই। নরক-সম সেলের বাইরে খোঁড়া হয়েছে সাড়ে তিনহাত গর্ত! জিজ্ঞেস করলে তাঁকে বলা হয়েছে যে শত্রু আক্রমণ করলে ব্যবহারের জন্য বাংকার! অবশ্য পাশের এক কয়েদী তাঁকে জানিয়ে দিয়েছে, এই গর্ত খোড়া হয়েছে তাঁকে কবর দেয়ার জন্যই!

সকাল বেলায় তাঁর সেলের দরজা খুলে গেলো। এক সেপাইয়ের হাতের বাটিতে কিছু ফল। বঙ্গবন্ধু তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। সেপাই বললো- আজ ঈদ। জেলার সাহেব আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু ভাবলেন- এটা কি মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা বন্দির অন্তিম ইচ্ছাপূরণ? নাকি আবার কোন রসিকতা?

তাঁর মনে পড়ে গেলো দেশে ফেলে আসা পরিজন, দেশের মানুষের কথা। বিষাদে আচ্ছ্বন্ন হয়ে পড়লেন তিনি...

মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে আসা যাক। ফকিরাপুল বাজার জামে মসজিদ। সাড়ে আটটা থেকে বারেবারে ঘোষণা হচ্ছে যে নয়টায় জামাত।

আরামবাগের বাসা থেকে শিল্পী হাশেম খান জামাতে গিয়ে হাজির হলেন। নামায হলো, খুতবা হলো, মোনাজাতও হলো। খুতবা ও মোনাজাতে ইমাম সাহেব পাকিস্তানের কল্যাণ কামনা করে এবং পাক সেনাবাহিনীর গুণকীর্তন করে দোয়া চাইলেন খোদার কাছে।

হাশেম খানের মনে হলো, সে দোয়ায় ইমাম সাহেবের অন্তরের সায় কতখানি সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। নামাজ সেরে বাড়িতে ফিরে এলেন তিনি। নিরানন্দ বাড়ি। এবার নতুন কেনা কাপড় পরে কেউ ঘুরছে না, পোলাউ-কোর্মা রান্না করে দাওয়াত দিয়ে কেউ সাধাসাধি করছে না। এরই মধ্যে কারা যেন হ্যান্ডবিল ছড়াচ্ছে যে এবারের ঈদে নতুন কাপড় না পরা হোক। এই ঈদে আনন্দ করার কিছু নেই।

জাহানারা ইমামের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ির চিত্র অবশ্য ভিন্ন। সকালে উঠেই তিনি রান্না করেছেন ঈদের সেমাই, জর্দা। বড় ডেগচিতে তৈরী করা হয়েছে পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তাঁর বাসার অবস্থা অবশ্য অতি শোচনীয়। জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফ, ছেলে জামী কেউই আজ মসজিদে যায় নি। ওসব খাবারও মুখে তোলেনি কেউ। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয়নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান।

জাহানারা ইমাম খাবার তৈরী করেছেন একান্ত মাতৃ আকুতি থেকে। যদি রুমীর কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য তিনি রেঁধেছেন। কেউ যদি আসলেই আসে, তিনি নিজের হাতে তাদের বেড়ে খাওয়াবেন। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য লুকিয়ে রেখেছেন এক শিশি আতরও!

চলে আসা যাক রণাঙ্গনে। গেরিলা মাহবুব আলম বসে আছে গোপন মিটিঙে। আগামীকাল ঈদ। একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, ঈদের দিন পাক আর্মি ব্যাপকভাবে হামলা করবে সীমান্ত এলাকাজুড়ে। গুজবটা যেভাবেই ছড়াক, বিচলিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঈদের নামাযের জন্য জামাতে দাঁড়াবে ঠিক সে সময়ই নাকি করা হবে এই হামলা!

যুদ্ধের মাঠে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য কোনো তৎপরতাকেই অবিশ্বাস করা যায় না। তাই সিদ্ধান্ত হলো, মুসলমান ছেলেরা যখন ঈদের জামাতে দাঁড়াবে, তখন হিন্দু ছেলেরা কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে হাতিয়ার হাতে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। হিন্দু সহযোদ্ধাদের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান ছেলেরা নামায পড়বে।

ক্যাম্পের ভিতরের চত্বরে ঈদের জামাত হলো। মোনাজাতের সময় ইমাম সাহেব নবী করিম (সাঃ)-এর হিজরতের সঙ্গে যোদ্ধাদের দেশ ত্যাগকে তুলনা করে এমন ভাষায় আবেগ দিয়ে মোনাজাত করলেন যে উপস্থিত সবাই কাঁদলো।

ঈদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে খাসীর মাংসের। শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে নামাজ সেরে মুক্তিযুদ্ধারা খাসীর মাংস আর পোলাউ দিয়ে নাশতা করলো। বহুদিন পরে ভালো খাবারে তাদের যেমন ভালো লাগে, অনেকে ঈদের দিনে কাছের মানুষের কথা মনে করে হয়ে পড়ে বিষন্ন।

ওদিকে দেশের আরেকপ্রান্তে তামাবিল-ডাউকি বর্ডারের কাছে ঈদের নামাজ পড়ার কোন ফুরসত নেই। সমানে চলছে গুলি বিনিময়। দুপুরের দিকে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা কিছুটা উন্নতমানের খিচুড়ি ভার বয়ে নিয়ে এসেছিল। আর্টিলারির গোলা-গুলির মধ্যেই খিচুড়ির টুকরীগুলো বিভিন্ন প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছানো হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের মাঝেই খিচুড়ির মাঝে অমৃতের স্বাদ খুঁজে নেন।

কলকাতায় অস্থায়ী সরকারের তখন কী অবস্থা? ঈদের জামাতে দেখা গেলো কেবল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এমএজি ওসমানীকে। মাওলানা ভাসানী কলকাতায় উপস্থিত থাকলেও ঈদগাহে তাঁকে পাওয়া গেলো না। সিআইয়ের দলিলে দেখা যায় ঈদের দিন সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি দিল্লী যান মাওলানা ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য।

কানাঘুষা চলছে যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে গৃহবন্দী করা হয়েছে। বিশ্বাসঘাতকতার একটা আলামত টের পাওয়া যাচ্ছে। এই নিয়ে তাজউদ্দীন আহমেদ গোপন অস্বস্তিতে আছেন। উপস্থিতদের অন্যতম ওসমানীর এডিসি লে. শেখ কামাল। নামাজ শেষে মুজিবের বড় ছেলেকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে যখন তাজউদ্দীন, একই সময় প্রচণ্ড জ্বরে কাতরাচ্ছেন তাঁর একমাত্র পুত্র সোহেল তানজিম।

মুজিব নগরের পাবলিক রিলেশান অফিসার নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে সেদিনের ঘটনা।সারাদিন কিছুই মুখে তোলেননি তাজউদ্দীন। তাঁর দপ্তরে সেদিন কোনো বিশেষ খানাপিনার আয়োজন ছিলো না। বাইরে থেকে যা এসেছে সব বিলিয়ে দিয়েছেন অফিসের লোকজনকে। ঈদের রাতে মুক্তাঞ্চলে একটা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান তিনি। সেখানেই প্রথম কিছু মুখে দেন, যোদ্ধাদের রান্না করা সেমাই।

পরে নজরুল ইসলাম আবার ছেলের কথা তোলায় তাজউদ্দীন জবাব দেন যে- চিন্তাটা শুধু কলকাতায় ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের জন্য কেন? আমরা কি এখানে আমাদের বউ ছেলেমেয়েদের সাময়িক আশ্রয়ের জন্য এসেছি? অসুখবিসুখের কি কারো প্রতি বিশেষ দয়ামায়া আছে? অসুখ বিসুখ কি শুধু নিরাপদ স্থানে আশ্রিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলেমেয়েকেই দেখছে? পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে সেদিন রাতে বাংলাদেশের যে উদ্বাস্তু শিবিরগুলো দেখে এলেন, অসুখ-বিসুখ জ্বরজারির দৃষ্টি কি সেখানকার ছেলেমেয়ের উপর পড়েনি? দখলীকৃত বাংলার অসহায় কোটি কোটি মানুষের ঘরেও তো অসুখ-বিসুখ হতে পারে। মন খুলে বলুন, তাজউদ্দীনের বউ ছেলেমেয়েরা কি তাদের চেয়েও অসহায় অবস্থায় আছে?

একটু থেমে তাজউদ্দীন আবার বলেন- সত্যি আমি দুঃখিত। খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে আপনারা আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। ভারত সরকারের সুরক্ষিত আশ্রয়ে কলকাতা শহরে আমাদের কে কোথায় অসুখে পড়েছে, কিংবা দু-এক বেলা খেতে পাচ্ছে না এসব চিন্তা ছাড়েন তো! যারা নিরাপদে বেঁচে আছে তাদের একজন-দু’জনের কথা ভাবলে তো চলবে না। দেশকে কেমন করে উদ্ধার করবো, সেসব বিষয় নিয়ে ভাবেন, চিন্তা করেন।

আবার চলুন ফিরে আসি ঊনপঞ্চাশ বছর পর এই সময়ের বাংলাদেশে। সময় নিয়ত বহমান। যুদ্ধের সময়ও প্রেম আসে, একইসাথে হয় আত্মদান, রান্না হয় ঈদের সেমাইও! এবার আমাদের করোনাযুদ্ধ। এবারের ঈদ চলছে ঘরে বসে। সুস্থ, নিরাপদ আর আনন্দময় হোক সকলের ঈদ। 

 

তথ্যসূত্র:

সাপ্তাহিক জয় বাংলা : মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা
একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম
মুজিবনগরে ঈদ: এম আর আক্তার মুকুল
একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা: নজরুল ইসলাম
মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধকথা : ওবায়দুর রহমান মোস্তফা
পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন - আহমাদ সালিম (মফিদুল হক অনুদিত)

১৭৪৩ পঠিত ... ১৯:৩০, মে ২৩, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top