ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ২০২০ সালেও কেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা? একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবনা

২৪৮৫ পঠিত ... ২১:২১, এপ্রিল ১৪, ২০২০

গোটা পৃথিবীর মানুষ যখন করোনার ভয়ে কাঁপছে; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজন তখন সংঘর্ষে লিপ্ত। সেখানে 'কাটা-পা' নিয়ে উল্লাসের খবর পাওয়ায়; ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনপদ ২০২০ সালে কেন মধ্যযুগের প্রবণতা দেখাচ্ছে; এ নিয়ে প্রত্ন গবেষণা জরুরি হয়ে পড়ে।

কী করে এই জনপদের নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলো তা জানতে গুগল করে 'এস এম শাহনূর' প্রণীত 'নামকরণের ইতিকথা' থেকে জানা যায়, সেন বংশের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের বড়ই অভাব ছিল। যার ফলে এ অঞ্চলে পূজা অর্চনার জন্য পুরোহিত পাওয়া যেতো না। এ সমস্যা নিরসনের জন্য সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন আদিসুর কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার শহরের মৌলভী পাড়ায় বাড়ী তৈরি করে। সেই ব্রাহ্মণদের বাড়ির অবস্থানের কারণে এ জেলার নামকরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।

অন্য একটি মতানুসারে দিল্লী থেকে আগত ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ এ শহর থেকে উল্লেখিত ব্রাহ্মণ পরিবারসমূহকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন, যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক উচ্চারণ 'বাউনবাইরা'।

নামকরণের ইতিহাসের মধ্যেই বাউনবাইরার বাইরা-বাইরির ঐতিহ্য ধরা পড়ে। এখানে সংঘর্ষ থেমে থাকেনি কখনো।

বৃটিশেরা এসে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত দুটি গ্রুপ পেয়ে গেছে হিন্দু-মুসলমান। সুতরাং 'ডিভাইড এন্ড রুল' সূত্রের উর্বর বাইরাবাইরি ক্ষেত্র হিসেবে পেয়ে গেছে এখানে।

উইকিপেডিয়ার তথ্য জাদুঘরে গিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে বিপ্লবী উল্লাস কর (অভিরাম) দত্ত কর্তৃক বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন। ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ ও গোপাল দেব প্রকাশ্য দিবালোকে তদানিন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি.সি.বি স্টিভেনসকে তারই বাসগৃহে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৩০ সালে কৃষক আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতা আব্দুল হাকিম খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান। এ সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে চারজন বেসামরিক লোক নিহত হয়।

ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বাইরাবাইরির ধর্মীয়কালকে সাথে রেখেই রাজনৈতিককালের সূচনা ঘটে। ধর্মপ্রেম ও দেশপ্রেম এই দুটো নিয়েই বাইরাবাইরি চলতে থাকে।

পাকিস্তানীরা এসে শোষণের উর্বর ক্ষেত্রে হিসেবে পেয়ে যায় এই জনপদকে। শাসন-শোষণ চলতে থাকে নির্বিচারে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অবদান অনেক। আবদুল কুদ্দুস মাখনের মত ব্যক্তিরা এখানে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয় এবং এদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী জনগণ সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন ।২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়োজিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম তার সাথের বাঙালি সেনাদের নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর্মি ক্যাম্পের সকল পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে বন্দি করেন। ঐদিন দুপুরে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম মৌলভীবাজারের শমসেরনগর হতে তার সেনাদল নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল তার কাছে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির দায়িত্ব অর্পণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া হানাদার মুক্ত হয়। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ সালে আখাউড়ার দরুইন গ্রামে শহীদ হন । ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজয়নগর উপজেলার ইসলামপুরে এস ফোর্সের অধিনায়ক তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ১১ জন আহত হন । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ জন নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়।ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে গড়ে তোলা হয়েছে কুল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ। এখানে ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে।

ইতিহাসের চূড়ান্ত মাহেন্দ্রক্ষণে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় নিজের দেশে আর কার বিরুদ্ধে লড়াই করবে; তাই কখনো ধর্মপ্রেমের দোহাই দিয়ে কখনো দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে সংঘর্ষ চললেও সমাজ জীবনে বাইরা-বাইরির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্পন্ন হয় এই জনপদে। কখনো হিন্দু-মুসলমান; কখনো আওয়ামী-লীগ-বিএনপি নামে খণ্ড খণ্ড লড়াই চলতে থাকে। কিন্তু কখনো ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর সুরের জাদুঘরে হামলা; কখনো নাসিরনগরে হিন্দু-এলাকায় হামলা ও তারপর পবিত্র কর এসে গঙ্গাজল ছিটিয়ে আশার সওদাগরগিরি করার পর কীসের হিন্দু-মুসলমান, কীসের আওয়ামী লীগ-বিএনপি; লুডু খেলা নিয়ে বাইরাবাইরির বিনোদন চলতে থাকে সেখানে।

আর করোনা এসে আওয়ামী লীগ-বিএনপি, হিন্দু-মুসলমান, শিবির-শিবসেনা নির্বিশেষে হামলা করতে থাকলে; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ বুঝতে পারে পৃথিবীতে বিশুদ্ধ ধর্ম-প্রেম কিংবা দেশ-প্রেমের কোন মূল্য নেই। পৃথিবীতে আসলে প্রেম বলে কিছু নেই।

সুতরাং সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী মাস্ক পরে; হ্যান্ড সানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে লম্বা লম্বা লাঠি নিয়ে কোয়ারিন্টিন দূরত্বে দাঁড়িয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তারা।

এরপর হঠাতই মধ্যযুগ এসে কড়া নাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দরোজায়। প্রতিপত্তি জাহিরের নেশায় 'নারায়ের তাকবীর' বলে হামলা করে সুরের জাদুঘর গুঁড়িয়ে দেবার রিরংসার ঐতিহ্য বুকে নিয়ে অসুরেরা আবারো ঘোরতর প্রতিপত্তি জাহিরের নেশায়, জয় বাংলা বলে করোনাকালে উপহার দিলো কাটা পা।

এ কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাটা-পা নয়; এ যেন আশার সওদাগরদের ভাষণের কারবারে আর বৃথা উন্নয়ন সংগীতে লুকিয়ে রাখা আদিম দক্ষিণ এশিয়া। সভ্যতার রক্তমাখা কাটা-পা।

২৪৮৫ পঠিত ... ২১:২১, এপ্রিল ১৪, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top