সুচিত্রা সেন : স্বেচ্ছায় যিনি দীর্ঘ ৩৬ বছর ছিলেন 'হোম কোয়ারেন্টাইনে'

৩৩০১ পঠিত ... ০০:০৫, এপ্রিল ০৬, ২০২০

অপার রহস্যে ঘেরা একটি মানুষ, যার নাম থেকে রূপ কিংবা সম্পর্ক থেকে জীবন সবটা নিয়েই রয়েছে বাংলার মানুষের অপার আকর্ষণ ও কৌতূহল। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশকালেই যিনি সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সম্মোহনী রূপ, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব এবং অভিনয় দিয়ে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে, দর্শকের মনে নিজেকে গভীরভাবে গেঁথে দিয়ে, আলোচনার ঝড় তুলে দিয়ে, হুট করেই তিনি চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে, নিরবে-নির্জনে, এক স্বেচ্ছা নির্বাসনে। সেই মানুষটি পরিবারের কাছে ছিলেন কৃষ্ণা, সমাজে ছিলেন রমা দাসগুপ্ত এবং চলচ্চিত্র জগতে এসে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী মহানায়িকা 'সুচিত্রা সেন'।

 

বাংলার 'মহানায়িকা'

১৯৫২ সালে 'শেষ কোথায়' ছবির মাধ্যমে সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অভিষেক হয়। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি। পরবর্তীতে তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ছিল 'সাত নম্বর কয়েদি' যা তাঁকে জনপ্রিয়তা দিতে পারেনি। শেষমেশ '৫৪ সালে 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবির মধ্যে দিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেন সুচিত্রা সেন। এরপর আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বরং সেই জনপ্রিয়তার মাপকাঠি দিনের পর দিন ধরে এতটাই আকাশচুম্বী হয়েছিল যে, এখন পর্যন্ত বাংলার কোনো নায়িকাই তাঁর কাছাকাছি যেতে পারেননি। কিন্তু অভিনয়জীবনের ২৫ বছর পর তাঁর রূপ-সৌন্দর্য ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রেখেই নিজেকে পর্দার আড়ালে গুটিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল তুমুল আকর্ষণ, আবেগ, রহস্য ও কৌতূহল। তার সর্বশেষ চলচ্চিত্রের নাম 'প্রণয় পাশা'। ১৯৭৮ সালে এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। ঠিক এরপরই তিনি সকলের সামনে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং স্বেচ্ছায় নির্বাসন বেছে নেন। সাড়ে তিন দশক ধরে তিনি তার মেয়ে মুনমুন, নাতনি রাইমা ও রিয়া, নিকটাত্মীয় এবং পারিবারিক ডাক্তার ছাড়া কারো সামনে আসেননি। এমনকি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি যখন হাসপাতালে ভর্তি হন তখনও সাংবাদিকরা সেখানে অষ্টপ্রহর জেগে তার সাক্ষাৎকার কিংবা ছবি কিছুই পাননি। শেষ পর্যন্ত সকল কিছু থেকে নির্বাসন নেওয়া মানুষটি যখন ২০১৪ সালের ১৭ই জানুয়ারি পৃথিবী থেকেও নির্বাসন নেন, তখন তার ইচ্ছেমতোই কালো কাচে ঢাকা ভ্যানে কফিন বন্দী হয়ে তার দেহ পৌছায় শ্মশানে। সফলতার তুঙ্গে থাকা, সকল পুরুষের স্বপ্নের নারী এবং সকল নারীর ফ্যাশন আইডলের কোনো ঘোষণা ছাড়া নির্বাসনে যাওয়ার কারণ নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে নানান তত্ত্ব বের করে ফেলেছিলেন তাঁর ভক্তরা, চেষ্টা করেছিলেন নিজেদের মত করে তাঁর চারপাশের রহস্যের প্রাচীরটাকে ভাঙতে। তবে এক কথা বলাই যায়, তিনি নিজেকে নিয়ে নানা মিথের জন্ম দিয়েছিলেন।

 

কেন এই নির্বাসন : রয়েছে নানান মতভেদ

সুচিত্রা সেনের নির্বাসন নিয়ে সবচেয়ে বড় মিথটি উত্তম কুমার সম্পর্কিত। বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নাম উত্তম-সুচিত্রা। সুচিত্রা সেন নাম নিলে আপনাআপনিই যেন মনে উত্তম কুমার নামটা চলে আসে। সমস্যা বাঁধে সেখানেই, যখন চলচ্চিত্র জগৎ ছাপিয়ে উত্তম-সুচিত্রা জুটির আভাস ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ে। সেই রেশ ধরে উত্তম-সুচিত্রা দু'জনেরই পারিবারিক জীবনে ঝড় নেমে আসে। যদিও তাদের প্রেমের সম্পর্ক রুপালি পর্দা ছেড়ে বাস্তবে রূপ নিয়েছে, এমনটি কেউ কখনোই স্বীকার করেননি। কিন্তু 'অগ্নিপরীক্ষা' চলচ্চিত্রের পোস্টারের নিচে লেখা 'আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হল অগ্নিপরীক্ষা' এবং তার নিচে সুচিত্রা সেনের স্বাক্ষর উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে আলোচনার এক তুমুল ঝড় উঠিয়েছিল। যদিও সেই লেখার ব্যাপারে কেউই কোনোদিন মুখ খোলেননি। উত্তম-সুচিত্রা প্রেমের গুঞ্জন তাদের ব্যক্তিজীবনে নানান বিচ্ছেদের জন্ম দেয় বলেও মনে করা হয়। তাই ভক্তদের অনেকেই মনে করেন, অসুখী দাম্পত্যজীবন, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ও ১৯৬৯ সালে স্বামীর অকালমৃত্যু ও আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝোঁক সুচিত্রার ব্যক্তিজীবনে প্রভাব ফেলে। তাই তিনি রুপালী পর্দাকে এক ঝলকে টেনে ফেলে নিজের জীবনের পর্দা যখন টেনে দেন তখন সকলেই তাঁকে নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেন।

এছাড়াও ভক্তদের মনোজগতের মহানায়িকা হয়ে নানা আলোচনার ঝড় তুলে তিনি যখন অন্তরালে চলে যান, তখন অনেকেই বলেন যে তাঁর যৌবনের জোয়ার এবং সৌন্দর্য বিদায় নেয়ার আগেই তিনি সকলের থেকে বিদায় নিয়েছেন। এতে করে তাঁর ভক্তদের মণিকোঠায় যুগ যুগ ধরে থাকবে তাঁর একই চিত্র। যেই চিত্রে সুচিত্রার বয়স বাড়ে না, রূপ কমে না, তিনি থেকে যান পরমাসুন্দরী এক নারী। তাই সুচিত্রা সেন নিজেকে অমর যৌবন দান করে অন্তরালে নিজের মরণশীল দেহ ও আত্নাকে গুটিয়ে নিয়েছেন বলেই মনে করেন ভক্তরা।

সুচিত্রার জীবনের মোড়ে মোড়ে রহস্যের দুর্ভেদ্য দেয়াল কখনই কেউ ভাঙতে পারেননি। তবুও ভক্তরা নিজেদের মতন বাস্তবের মিশেলে নানা কল্পকাহিনীর জন্ম দিয়ে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষের বহু আকুলতা, আবেগ, কল্পকাহিনী কিছুই তাঁকে তাঁর নির্বাসন থেকে টলাতে পারেনি। আত্নসংযমের চুড়ান্তে গিয়ে নিজের সাধনাকে জয় করেছেন মৃত্যু অব্দি, সকলের মধ্যে জন্ম দিয়েছেন তার প্রতি অত্যাধিক মনোজাগতিক আকর্ষণ।

 

শেষ কথা

বর্তমানে আমাদের বিশ্বকেও এক বিশেষ এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে৷ সুচিত্রা সেন স্বেচ্ছায় নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই বাধ্যতামূলক এই ঘরবন্দী জীবনে সুচিত্রা সেনের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের একান্তভাবে নিজের পরিবার ও নিজের সাথে সময় কাটানো ছাড়া উপায় নেই। অতিরঞ্জিত করে বলা যায়, তাঁর ৩৬ বছরের স্বেচ্ছাকৃত 'হোম কোয়ারান্টাইন' জীবনের সাধনাকে দৃষ্টান্ত ধরে আমরা অন্তত কিছুদিনের এই হোম কোয়ারান্টাইন মেনে চলব, এমনটাই আশা সকলের কাছে।

 

তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন

৩৩০১ পঠিত ... ০০:০৫, এপ্রিল ০৬, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top