ভাইরাসের নামকরণ যে কারণে জরুরি, যে পদ্ধতিতে করা হয়

১৩০১ পঠিত ... ১৯:৪৪, মার্চ ২৬, ২০২০

নতুন কোনো রোগ আবিষ্কৃত হলে সেই রোগের নামকরণ কিভাবে হয়? সেটা কি আবিষ্কার যে করে সে দেয়, যে একালায় আবিষ্কার হয় তারা দেয়, নাকি যে এলাকায় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় সে হিসেবে হয়? না, যেকোন প্রকারে একটা নাম দিলেই হবে না। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। ডব্লিউএইচও জাতিসংঘের আরও দুইটি সংস্থার সহায়তায় এই ধরণের নামকরণের এই দিকটি দেখভাল করে। 

 

 

নতুন রোগের নামকরণ করতে ডব্লিউএইচও’র এতো তাড়াহুড়া কেন? 

যেকোনো রোগ সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ডব্লিউএইচও’র নামকরণ করতে তোড়জোর শুরু হয়ে যায়। এর পেছনে কিছু কারণ আছে। প্রধান কারণ, ডব্লিউএইচও’র ভাষায় ‘দ্রুত নামকরণ না করা গেলে ‘ত্রুটিপূর্ণ আর নেতিবাচক নাম’ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সায়েন্টিফিক কমিউনিটির বাইরে লোকে রোগটাকে সাধারণত কমন কোন নামে ডাকে। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একবার নামটা মোটামুটি প্রচলিত হয়ে গেলে, এমনকি সেই নামটা ভুল হলেও তা বদলানো কঠিন হয়ে যায়। 

ফলে ২০১৫ সালের মে মাসে ডব্লিউএইচও এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ‘সদ্য শনাক্ত কোন রোগের বা ভাইরাসের রিপোর্ট করার সময় মিডিয়াতে কী নামে ডাকা হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ। এবং নাম হওয়া উচিত একই সঙ্গে সায়েন্টিফিক দিক দিয়ে নির্ভুল এবং সামাজিকভাবে ব্যবহারযোগ্য।’ একই সময় ডব্লিউএইচও নতুন রোগ বা ভাইরাসের নামকরণের বিষয়ে কিছু নির্দেশনা ঠিক করে দেয়।

 

বিশ্বব্যাপী মহামারি তৈরি করা নভেল করোনাভাইরাস কিভাবে নাম পেল? 

‘দ্য করোনাভাইরাস স্টাডি গ্রুপ অফ দি ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি অফ ভাইরাস’ বলে বিজ্ঞানীদের একটা সংগঠন আছে। এই গ্রুপ ভাইরাসের অফিশিয়াল শ্রেণিকরণ ও করোনাভাইরিডি গোত্রের নামকরণের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা ভাইরাসটির নাম দিয়েছেন: Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2’ অথবা SARS-CoV-2. কিন্তু ডব্লিউএইচও সেই নাম বদলে নতুন নাম দেয়। 

ডব্লিউএইচও করোনাভাইরাসের অফিশিয়াল নাম  ঠিক করে দিয়েছে কোভিড-১৯ ( COVID-19). এখানে CO করোনা’র সংক্ষিপ্তরূপ, VI ভাইরাস-এর। আর D হলো Disease এর সংক্ষিপ্তরূপ। আর ২০১৯ সালে প্রথম শনাক্ত হয়েছে বলে নামের শেষে ১৯ সংখ্যাটি। ফলে সবগুলোর সমন্বয়ে নাম দাড়ালো কোভিড-১৯।

 

ডব্লিউএইচওর নতুন গাইডলাইন কী জিনিস? 

ভাষার যেকোন শব্দই শুধু অর্থ না, তার নির্দিষ্ট ধরণের ব্যঞ্জনা বা দ্যোতনাও থাকে। [স্কুলে বাংলা ব্যাকরণে হয়তো আপনি উপসর্গ পড়তে গিয়ে পড়েছেন-- উপসর্গের অর্থবাচকতা নেই অর্থদ্যোতকতা আছে। হ্যাঁ সেই দ্যোতনার কথাই বলা হচ্ছে।] যেনতেন প্রকারে নাম দিলে সেটা সমাজের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বা ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি নেতিবাচক দ্যোতনা নিয়ে আসতে পারে। ডব্লিউএইচও এই কারণেই নতুন গাইডলাইন হাজির করেছে ২০১৫ সালে। নামকরণের সময় তারা জাতিসংঘের আরও দুটি সংগঠন World Organisation for Animal Health (OIE) এবং Food and Agriculture Organization of the United Nation (FAO) -এর সহায়তা নেয়। 

তাদের উদ্দেশ্য হলো রোগের নামের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, ভ্রমণ, প্রাণী কল্যাণ এবং কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জাতি গোষ্ঠী বা অঞ্চল বা পেশার প্রতি অপ্রয়োজনীয় নেতিবাচক প্রভাবকে সীমিত করা।

 

ডব্লিউএইচও’র নির্দেশনাগুলো কী কী? 

এই নির্দেশনা অনুসারে, রোগের নাম হবে টার্মগুলোর সমন্বয়ে। এই টার্মগুলো আবার গঠিত বিভিন্ন ক্লিনিকাল লক্ষণ (শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত), শারীরিক প্রক্রিয়া (ডায়রিয়া), এনাটমিক্যাল বা প্যাথলজিক্যাল রেফারেন্সের (কার্ডিক) সমন্বয়ে। এটা নির্দিষ্টভাবে কোন বয়সীদের আক্রান্ত করে সেটা উল্লেখ থাকতে পারে, কোন মৌসুমে বেশি হয় সেটির উল্লেখ থাকতে পারে বা রোগের তীব্রতার কথা থাকতে পারে। এছাড়া কোন পরিবেশে বা কোনো ভাইরাসের কারণে হয় (করোনাভাইরাস) এবং নতুন রোগটি প্রথম যে বছর শনাক্ত করা হবে সেই বছর থাকতে পারে। তবে মাসের নাম উল্লেখ করা হবে না। 

বছর উল্লেখ করার আরেকটা কারণ একই ধরণের ঘটনা বিভিন্ন বছরের ঘটনা ঘটনা আলাদা করতে। কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস Severe Acute Respiratiory Syndrome (SARS) এবং Middle East Syndorme (MARS) এর মতো ভিন্ন ধরণের রোগ তৈরির জন্য দায়ী।  

এছাড়া ডব্লিউএইচও আরও কিছু টার্ম ঠিক করে দিয়েছে রোগের নামকরণের সময় যেগুলো ব্যবহার করা যাবে না। এর মধ্যে আছে, ভৌগলিক অবস্থান, ইন্ডাস্ট্রি, পেশা বা এমন শব্দ যা ভীতি জাগায়। 

২০১৫ সালের আগে যে রোগগুলো নাম ২০১৫ সালের গাইডলাইনকে ভায়োলেট করেছে:

কিছু রোগের নামে ভৌগলিক অবস্থান, শহর, দেশ বা অঞ্চলের নামের উল্লেখ আছে। সাধারণত যেখানে রোগটা প্রথম শনাক্ত করা হয়েছে সেই অঞ্চলের নাম অনুসারে। ইবোলা নামটা এসেছে যে অঞ্চলে প্রথম ভাইরাসটা শনাক্ত করা হয়েছে সেখান থেকে--কঙ্গো গণপ্রজাতন্ত্রের ইয়ামবাক্তুতে যা ইবোলা নদী থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে। একইভাবে জিকা ভাইরাসের প্রথম শনাক্ত হয়েছে উগান্ডার জিকা অরণ্যের রেসাস বানরদের মধ্যে। 

১৯৪৭ সালে আবিষ্কৃত এই ভাইরাস অবশ্য মানুষের মধ্যে ছড়ায় আরও পাঁচ বছর পরে উগান্ডা ও তানজানিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে। জাপানিজ এন্সেফালিটিস (প্রথম শনাক্ত হয়ে ১৮৭১ সালে জাপানে), মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম, স্প্যানিশ ফ্লু, রিফ ভ্যালি ফিভার বা লাইম ডিসিজ এ সবগুলো নামই নির্দিষ্ট অঞ্চলের নাম থেকে এসেছে। 

কয়েকটা রোগের নাম রোগের আবিষ্কারকের নাম থেকে এসেছে। চাগাস রোগের নামকরণ করেছে ব্রাজিলীয় চিকিৎসক কার্লোস চাগাসের নামানুসারে। তিনি এই রোগ আবিষ্কার করেন ১৯০৯ সালে। একইভাবে ক্রেটজফেল্ট-জ্যাকব রোগ আবিষ্কারক দুইজনের নাম থেকে রাখা হয়েছে। 

কিছু রোগের নাম প্রাণীদের নাম বহন করে। যেমন, বার্ড ফ্লু (H5N1), সুয়াইন ফ্লু (H1N1)। ২০০৯ সালের H1N1 প্যান্ডেমিককে সুয়াইন ফ্লু নামেই ডাকা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, ২০০৯ সালের এই প্যান্ডেমিকের জন্যে দায়ী ভাইরাসটি কিন্তু শুকরের দ্বারাই ছড়ায়নি। ভাইরাসের মধ্যে যে ফ্লু জিন রয়েছে তা পাখি, শুকর ও মানুষের ফ্লু টাইপের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালের প্যান্ডেমিকের ভাইরাসকে সুয়াইন ফ্লু ডাকায় পর্ক ইন্ডাস্ট্রিতে বড় ধরণের ধ্বস নেমেছিলো।

১৩০১ পঠিত ... ১৯:৪৪, মার্চ ২৬, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top