বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়, ইতোমধ্যেই আক্রান্ত তিনজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে দেশে–বিদেশে উদ্বেগ বাড়ছে। এই ভাইরাসটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি যে বেশি, এ ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার চাইতে সতর্ক হওয়াটাই উত্তম। নিজেকে আর নিজের পরিবার, স্বজনদের রক্ষা করতে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার ভূমিকা কী হওয়া উচিত এ সময়? কীভাবে আপনি পারবেন এই ভাইরাস প্রতিরোধ করতে?
প্রথমেই কিছু জরুরি বিষয় আপনাকে জানতে হবে
১# বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক বলেছেন, ‘আমরা শুধু মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না, আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধেও যেটা এই মহামারী রুখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।’ সুতরাং, গুজব ছড়াবেন না। আতংকিত হবেন না। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, বিবিসি অর্থাৎ এমন স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য নিউজ মিডিয়া বাদে হুটহাট যেকোনো মিডিয়ার খবর বিশ্বাসও করবেন না, শেয়ারও দেবেন না। ইনবক্সে আধা-পরিচিত কিংবা অপিরিচিত কারো কাছ থেকে হুটহাট পাওয়া সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি বা ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপের ভাইরাল পোস্টের ক্ষেত্রেও একই হিসাব, বরং সেগুলো আরও বিপদজনক।
২# মাস্ক পরা কি উচিত?
লক্ষণ দেখা গেলে এবং অসুস্থতা বোধ করলে অবশ্যই মাস্ক পরবেন। তাছাড়া কোয়ারেন্টাইনে থাকা, বিদেশ ফেরত ও করোনায় আক্রান্ত কোন রোগীর সাথে কথা বলতে গেলেও মাস্ক পরবেন।
৩# আক্রান্ত ব্যক্তি কি পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারেন?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হতে পারেন। কারণ, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো সাধারণ সমস্যা অনুভব করে থাকেন।
তবে বয়স্ক, ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের মতো রোগী বা যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাদের জন্য এই ভাইরাস বিশেষ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের রোগের প্রকোপ কম, তাদের সুস্থ হতে এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
৪# জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, মাংসপেশি ও শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথাসহ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা দিলে আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বর: ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১
৫# করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে কি মৃত্যু নিশ্চিত?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাত্র ৫ শতাংশ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৩ শতাংশের মতো মানুষ মারা যায়।
৬# আক্রান্ত হলে কীভাবে বুঝবেন
করোনাভাইরাস মূলত ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত জ্বরের সঙ্গে শুকনা কাশি দিয়ে শুরু হয়। জ্বর ও কাশির এক সপ্তাহের মাথায় শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়। সময়ের সাথে সাথে এইসব লক্ষণ প্রকোট আকার ধারণ করে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
৭# ভাইরাসটি কি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়?
এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, নতুন করোনাভাইরাসটি কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির ড্রপলেট ইনফেকশন বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। ছড়াতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিসের স্পর্শে আসলেও। তবে মানব শরীরের বাইরে এই ভাইরাস কয়েকঘন্টার বেশি বাঁচে না।
৮# যিনি আক্রান্ত নন, তার মাধ্যমে কি ছড়াতে পারে?
কোভিড-১৯ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি। এছাড়া যেসব আক্রান্তের ক্ষেত্রে সংক্রমণের লক্ষণ এখনো প্রকাশ পায়নি তাদের কাছ থেকে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা খুবই কম।
৯# ধরুন, আপনার পাশের বাড়িতে রোগী আছে। সেখান থেকে স্বাভাবিকভাবে আপনি আক্রান্ত হবেন না। কারণ, ভাইরাসটি কোনো তরল কণার মাধ্যমে বাহিত হয়ে আপনার শরীরের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় ঢুকতে হবে, নচেৎ নয়। তাহলে কোনো রোগী দেখলেই পালানোর দরকার নাই। রোগী থেকে তখনি ছড়াবে যখন নিকট-সংযোগে (Close Contact) যাবেন।
১০# চিকিৎসায় টিকা বা ওষুধ আছে কি?
কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় এখনও কোনো ওষুধ বা টিকা নেই। যারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদের লক্ষণ দেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যাদের অবস্থা গুরুতর তাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। বেশিরভাগই সহায়ক যত্নেই ভালো হয়েছেন।
১১# স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভাইরাসটির সংক্রমণের মাত্রার উপর ভিত্তি করে চার স্তরের পরিস্থিতি বিবেচনার বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করে রেখেছে। হাসপাতাল প্রস্তুত করার পাশাপাশি প্রত্যেক উপজেলায় ইউএনও-র নেতৃত্বে ১০ সদস্যের ও জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই কমিটিগুলোই প্রয়োজনে স্কুল-কলেজ বন্ধসহ নির্দিষ্ট এলাকা আবদ্ধ করা, কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র খোলা এসব ব্যবস্থা নেবে।
যা করবেন
১. বারবার হাত ধোয়া
নিয়মিত এবং ভালো করে বারবার হাত ধোবেন (অন্তত ২০ সেকেন্ড যাবৎ)। এই ছোট একটি কাজ আপনার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি কমিয়ে দিবে। যেসব বস্তুতে অনেক মানুষের স্পর্শ লাগে, যেমন সিঁড়ির রেলিং, দরজার নব, পানির কল, কম্পিউটারের মাউস বা ফোন, গাড়ির বা রিকশার হাতল ইত্যাদি ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাত পরিষ্কার করতে হবে।
২. দূরে থাকুন
যেকোনো সর্দি–কাশি, জ্বর বা অসুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত এক মিটার বা ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। আর সব ফ্লুর মতোই এই রোগও কাশির ক্ষুদ্র ড্রপলেট বা কণার মাধ্যমে অন্যকে সংক্রমিত করে। ইতিমধ্যে আক্রান্ত এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন। অসুস্থ পশুপাখি থেকে দূরে থাকুন।
৩. কাশির আদবকেতা মেনে চলুন
নিজে কাশির আদবকেতা বা রেসপিরেটরি হাইজিন মেনে চলুন, অন্যকেও উৎসাহিত করুন। কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় নাক, মুখ রুমাল বা টিস্যু, কনুই দিয়ে ঢাকুন। টিস্যুটি ঠিক জায়গায় ফেলুন।
৪. নাক–মুখ স্পর্শ নয়
হাত দিয়ে আমরা সারা দিন নানা কিছু স্পর্শ করি। সেই বস্তু থেকে ভাইরাস হাতে লেগে যেতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন। অপরিষ্কার হাত দিয়ে কখনো নাক–মুখ–চোখ স্পর্শ করবেন না।
৫. খাবারের ক্ষেত্রে সাবধানতা
কাঁচা মাছ–মাংস আর রান্না করা খাবারের জন্য আলাদা চপিং বোর্ড, ছুরি ব্যবহার করুন। কাঁচা মাছ–মাংস ধরার পর ভালো করে সাবান–পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। ভালো করে সেদ্ধ করে রান্না করা খাবার গ্রহণ করুন। অসুস্থ প্রাণী কোনোমতেই খাওয়া যাবে না।
৬. অভ্যর্থনায় সতর্কতা
কারও সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ড শেক), কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন
৭. যথাসম্ভব বাসায় থাকুন
জনবহুল পরিবেশে যাওয়া খুব জরুরি না হলে এই মুহূর্তে তা এড়িয়ে চলাই ভালো। কোনো ট্যুরের প্ল্যান থাকলে বাতিল করুন।
যা একেবারেই করবেন না
১# ধূমপান। অন্যের খাওয়া সিগারেট পাস নিয়ে দুই টান দেয়ার কথা তো ভাববেনই না।
২# একাধিক মাস্ক বা অন্যের পরা মাস্ক পরিধান।
৩# নিজে নিজে ওষুধ সেবন করবেন না, বিশেষ করে ‘নিজের প্রেসক্রিপশনে’ অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না প্লিজ।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন