হেনরি বের্গসন ও সামাজিক জীবনে হিউমার

১৪৪৬ পঠিত ... ১৩:২৩, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯

'হিউমার বিশ্লেষণ করা আর ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করা একই রকম, উভয় ক্ষেত্রেই উহারা মারা যায়।'

ই. বি. হোয়াইট
মার্কিন হিউমারিস্ট, শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

 

নাম বিষয়ে যে কোনো লেখায় শেকসপিয়ারের ‘হোয়াটস ইন আ নেইম?’ কথাটা যেমন অতিব্যবহৃত, হিউমারের তত্ত্ব বিষয়ক কোনো বই বা লেখাপত্র ঘাঁটলে উপরের বাক্যখানাও আপনার চোখে বারবার পড়বে। ই. বি. হোয়াইটের এই উদ্ধৃতিটা মোটামুটি ক্লিশে পর্যায়ে চলে গেছে।   

বেশিরভাগ হিউমার সম্পর্কিত লেখার জন্যে কথাটা সত্যি হইলেও ব্যতিক্রমও আছে। কির্কেগার্দ, নিৎশে বা হেনরি বের্গসনেরা এই ব্যতিক্রমী ধারার হিউমার তাত্ত্বিক। এরা ব্যাঙ না মেরেই ব্যবচ্ছেদ করছেন।   

তো, এই হিউমার-আচ্ছন্ন যুগে কিছু ব্যাঙ না হয় আমি মারলাম। যেহেতু ব্যাঙ জ্যান্ত রাখতেই হবে এমন কথা আমারে কেউ বলে নাই। হিউমার বিষয়ে তিন হাজার বছর ধরে অনেকেই খুচরা-খাচরা মন্তব্য থেকে বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন অর্থাৎ ব্যাঙ মারছেন। আমিও কিছু ব্যাঙ মারতে চাই, অবশ্যই বড় বড় চিন্তাবিদদের কান্ধে বন্দুক রেখে। এই রচনায় আমি যার কান্ধে বন্দুক বা চাপাতি রাখতে যাইতেছি তিনি হেনরি বের্গসন। 

 

কে এই হেনরি বের্গসন?

[নামটা সহী ফরাসি উচ্চারণে অঁরি বের্গসঁ বললে বাংলায় কিছু কালচারাল ক্যাপিটাল জুটে অবশ্য।] 

তিনি একজন ফরাসি একাডেমিশিয়ান এবং দার্শনিক। দর্শনে অবদানের জন্যে ১৯২৭ সালে তাঁরে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হইতেছে, ভদ্রলোক যেইসব ‘গুরুত্বপূর্ণ’ আইডিয়া বা চিন্তার জন্যে খ্যাত ছিলেন, এমনকি নোবেল পুরস্কারও পাইছেন, ওইসব লেখা এখন আর তেমন কেউ পড়ে না। তাঁর একটামাত্র বই যা লোকজন আজও আগ্রহ নিয়া পড়ে সেইটা তাঁর হিউমার বিষয়ক বই।     

তাত্ত্বিকভাবে বিশদে হিউমার নিয়া প্রথম বইটা লেখছেন তিনি। ১৯০০ সালের প্রকাশিত তার বই ‘লাফটার: অ্যান এসে অন দ্য মিনিং অফ কমিক’ হাস্যরসের তত্ত্ব বিষয়ক প্রথম বই যেখানে একজন দার্শনিক হাস্যরসের বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা নিছেন।     

বের্গসন সেই বিরল দার্শনিকদের একজন, যিনি মনে করতেন, দার্শনিকদের উচিৎ চিন্তা যতটা সম্ভব সহজবোধ্য ও জার্গন-ফ্রি ভাষায় সাধারণ পাঠকদের কাছে প্রকাশ করা। তিনি এমনটা পর্যন্ত বলছেন যে, 'দর্শনে এমন কিছু নাই যে দৈনন্দিন জীবনের ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।' ফিলসফিক্যাল টেক্সট শুনলেই আমাদের মনে যে কষা গদ্যের ছবি ভেসে ওঠে, বের্গসনের এই বই তেমন না। 

ফরাসি দার্শনিক হেনরি বের্গসন (১৮৫৯-১৯৪১)

হিউমার বিষয়ে বেশিরভাগ বই যেসব বিষয়ে ফোকাস করে, সেগুলো হলো: মানুষ কেন হাসে বা কোন কাঠামোতে ফেললে মানুষের মনে হাস্যরসের উদ্রেক হয়, অথবা কোন প্রক্রিয়ায় হাস্যরস উৎপাদিত হয় ইত্যাদি। এইসব বিষয়ে আলগোছে কিছু মন্তব্য করলেও বইটাতে বের্গসনের মূল মনোযোগ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে হাসির ভূমিকা ঠিক কীরকম, সেইটা বোঝা।  

‘লাফটার’ বইয়ে মোট প্রবন্ধের সংখ্যা তিন। শুরুতে বের্গসন বলে নিছেন যে, কমিক কী তার সংজ্ঞা দেয়া তাঁর লক্ষ্য না। বরং মানুষের জীবনে কমেডির ভূমিকা, বিশেষ করে কমেডি কীভাবে ব্যক্তিক ও সামজিক কল্পনার সাথে সম্পর্কিত – সেইটা গভীরভাবে বুঝতে তিনি আগ্রহী। ‘কেন হাসে?’র চাইতে ‘কী কী নিয়া হাসে?’-এই প্রশ্নে বের্গসনের আগ্রহ বেশি।   

 

প্রথম প্রবন্ধ--‘দ্য কমিক ইন জেনারেল’

এই প্রবন্ধে বের্গসন কমিকের স্বভাব-চরিত্র বুঝতে চাইছেন। কমিকের কী কী বৈশিষ্ট্য তিনি দেখতে পান সে ব্যাপারে আলোচনা করছেন। এই প্রবন্ধে আমার মতে, তিনি অন্তত তিনটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করছেন।   

 

ক. হিউমারের মানবকেন্দ্রিকতা

তো, কী কী নিয়া মানুষ হাসে? প্রাণী? গাছপালা? বস্তু? বের্গসনের মতে, এইগুলা নিয়াও হাসা সম্ভব। তবে তখনই সম্ভব যখন এইগুলার মধ্যে মানব স্বভাবের কোনো না কোনো উপাদান যখন থাকবে।   

বের্গসন লিখছেন,‘প্রথম যে পয়েন্টে মনোযোগ দেয়া উচিৎ তা হইতেছে, "মানবিক সীমানার বাইরে কমেডির অস্তিত্ব নাই। একটা ল্যান্ডস্কেইপ সুন্দর, মনোমুগ্ধকর ও সাবলাইম হইতে পারে, অথবা তুচ্ছ বা অসুন্দর হইতে পারে, এটা কখনও হাসির হবে না। ... আপনি কোনো প্রাণী দেইখা হাসতে পারেন কিন্তু সেইটা প্রাণীটার মধ্যে আপনি কিছু মানবসুলভ আচরণ বা অভিব্যক্তি শনাক্ত করছেন বইলাই। একটা হ্যাট দেখেও হাসতে পারেন আপনি, কিন্তু যা নিয়া মজা করতেছেন আপনি, এইক্ষেত্রে, সেটা এক টুকরা পরিধেয়মাত্র না, বরং মানব-কল্পনা যে ছাঁচে তারে অর্থপূর্ণভাবে দেখে তার ভিত্তিতে। অদ্ভুত ব্যপার হইতেছে, এত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সাধারণ একটা ব্যাপার, দার্শনিকদের মনোযোগ পায় নাই।‘

একটা উদাহরণ দিই, যদিও এইটা বের্গসনে নাই। 

চিড়িয়াখানায় সবচাইতে ‘ফানি’ প্রাণী কোনটা? বেশিরভাগ মানুষের ভোট, আমার ধারণা, বান্দরের খাঁচায় গিয়া পড়বে? কারণ 'অন্য কোনো প্রাণী বা জড়বস্তু একই রকম ইফেক্ট সৃষ্টি করলে তার কারণ তার সাথে মানুষের কোনো না কোন দিকে মিল আছে।' বান্দর, তুলনায় বেশি ফানি, কারণ মানব-স্বভাবের নানান উপাদান অন্যান্য প্রাণীর চাইতে বেশি আছে বান্দরের মধ্যে।  

হিউমারের এই মানবকেন্দ্রিকতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন বের্গসন। এরিস্টটল মানুষরে সংজ্ঞায়িত করছেন, ‘এমন প্রাণি যে হাসে’ বলে। বের্গসনের মতে, ‘এমনভাবেও কওয়া যাইতো যে মানুষ হইতেছে সেই প্রাণী, যারে নিয়া হাসাহাসি করা হয়।'   

    

খ. হিউমারের (সাময়িক হলেও) অনুভূতিশূন্যতা  

'আরেকট দিক পয়েন্ট আউট করতে চাই, হাসির সাথে অনুভূতিশূন্যতা জড়িত।…আবেগের চাইতে হাসির বড় কোনো শত্রু নাই, আবেগহীনতাই হাসির উপযুক্ত পরিবেশ। বলতেছি না যে, আবেগ থাকলে হাসা যায় না, বলতেছি, যেই মুহূর্তে মানুষ হাসে, যে ব্যক্তি বা বস্তু নিয়া হাসে, তার প্রতি ওই নির্দিষ্ট মুহূর্তে সহানুভুতি রাখা সম্ভব না।'

এই অনুভূতিশূন্যতা বুঝাইতে বের্গসনের ফ্রেইজটা সুন্দর। অন্তত আমার কাছে ইংরেজিতে সুন্দর লাগে: মোমেন্টারি এনেস্থিশিয়া অফ দ্য হার্ট। দুর্বল বাংলায় হয়তো বলা যায়, 'হৃদয়ের সাময়িক অনুভূতিশূন্যতা'।     

আপনার কোনো শ্রদ্ধা বা প্রিয়ভাজন লোকরে নিয়া কেউ রসিকতা/ট্রল করলে দেখবেন আপনি মজা পাইতেছেন না। কারণ তার সাথে আপনার যে ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট বা অনুরাগ আছে, সেইটা কমিক আনন্দ নিতে আপনাকে বাধা দিবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাহফুজুর রহমান, সালমাল মুক্তাদির বা কেকা ফেরদৌসীরে নিয়া অনলাইনে যে ব্যাপক ট্রল হয়, এই ব্যক্তিরা আপনার প্রিয়ভাজন এবং কাছের মানুষ হইলে দেখবেন আপনি খুব একটা মজা নিতে পারতেছেন না। কারণ তাদের সাথে আপনার আবেগগত সম্পর্ক আছে। অথবা পারবেন বের্গসন কথিত ‌‘মোমেন্টারি এনেস্থিশিয়া অফ দ্য হার্ট’ কাজ করলে।

হাস্যরসে সবসময়ই কোনো না কোনো টার্গেট থাকে যারে নিয়া ফান করা হয়। সেই টার্গেট হইতে পারে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি আইডিয়া পর্যন্ত। এই টার্গেটরে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানরা বলেন ‘বাট’, বাট অফ দ্য জোক। জোক বা কমেডির টার্গেটদের জন্যে তাদেরকে নিয়া করা রসিকতা সুখকর হয় না সাধারণত।

অর্থাৎ হাস্যরস উপভোগ করতে এক ধরনের আবেগগত দূরত্ব প্রয়োজন হয়। 'ক্লোজ-আপে দেখলে জীবন ট্রাজেডি কিন্তু লং শটে কমেডি। ঠিকমতো হাসতে চাইলে, আপনারে যন্ত্রণা গ্রহণে সক্ষম হইতে হবে এবং সেইটা নিয়া খেলতে পারতে হবে।'--চ্যাপলিনের এই কথা বার্গসনের ধারণার প্রতিধ্বনি মেলে।

নানান ডার্ক ম্যাটেরিয়াল নিয়া হাস্যরস করতে পারে বলে ইহুদিদের হিউমার পশ্চিমে প্রশংসিত। এবার প্রচলিত একটা ইহুদি জোক পড়েন: 

ডেবি মসকৌইটজ তার দাদীরে নিয়া গেছে সিনেমা দেখতে। সিনেমার বিষয় রোমান যুগের সহিংসতা। দাদী ঠিকঠাক দেখতেছিলেন। যখনই সিংহের খাঁচায় কয়েকজন খ্রিস্টানরে ছেড়ে দেয়া হইলো, দাদী অস্থির হয়া বলে উঠলেন, ‘আহারে বেচারা, আহারে!’

ডেবি তারে বুঝাইলো এইটা সিনেমা, বাস্তব না। তাও দাদীর অস্থিরতা কমে না। শেষপর্যন্ত ডেবি ফিসফিস করে বললো, ওই বেচারা লোকগুলা খ্রিস্টান, ইহুদি না। এবার দাদী স্বস্তি পাইলো।

কিন্তু একটু পরে আবার সে অস্থির হয়া উঠলো। ডেবি বললো, 'আবার কী হইলো দাদী?'
দাদী বললো, 'ওই কোনার সিংহটা একটাও পাইতেছে না।'


গ. কমেডি মূলত সামাজিক অভিজ্ঞতা

হিউমার মূলত সামাজিক অভিজ্ঞতা। ‘ইটস এ গ্রুপ থিং। হাসি সবসময় কোনো নির্দিষ্ট গ্রুপের হাসি।' বের্গসনের একটা দাবি, সমাজ যে ব্যক্তি বা আচরণকে অস্বাভাবিক হিসাবে দেখে এবং আইনত বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন দ্বারা যাকে শাস্তি দিতে পারে না, তাদেরকে সাইজ করে হাস্যরস দিয়া। তিনি লিখছেন, ‘লাফটার, প্রধানত সংশোধনমূলক। অবমাননামূলক হওয়ায় যাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা হয়, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক। হাসির মতো অন্য আর কিছুই আমাদেরকে নিরস্ত্র করে না। সমাজ ব্যক্তির অস্বাভাবিকতাকে প্রায়ই হাস্যরসের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে।' 

 

দ্বিতীয় প্রবন্ধ: দ্য কমেডি অফ ফর্মস অ্যান্ড দ্য কমেডি অফ মুভমেন্ট 

বের্গসন কথা বলছেন কমেডিক অভিজ্ঞতায় বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা নিয়া। তাঁর সিদ্ধান্ত: জীবন্ত মানুষকে নমনীয়, কমনীয় স্বচ্ছন্দে কাজকর্ম করা প্রাণী বলেই অনুধাবন করে মানুষ। যখন সে মানুষের মধ্যে এমন কিছু দেখে বা অনুধাবন করে যা ‘মানুষ’-এর ব্যাপারে তাঁর এই ধারণার সাথে খাপ খায় না, যেমন হোঁচট খায়া পড়া, তা হাসির উদ্রেক করে।

চার্লি চ্যাপলিন, বাস্টার কিটন বা মিস্টার বিন বা এনিমেটেড ফিল্মগুলারে আমরা উদাহরণ হিসাবে নিতে পারি। এক কথায় মানুষের মধ্যে জড়সুলভ/মেকানিকাল আচরণ হাসি জাগায়। এই জড়ত্ব বা অনমনীয়তা শুধু শারীরিকতায় সীমাবদ্ধ না, একই সাথে তা মানুষের স্বভাব-চরিত্র বা আচরণের জন্যেও প্রযোজ্য। যেমন, যাদের মুদ্রাদোষ অতিরিক্ত, তাদের হাস্যকর লাগে। সিটকমের চরিত্রগুলা যাদের আচরণে যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি থাকে, একই ধরনের প্রেডিকটেবল আচরণ তারা বারবার করে।

'ব্যক্তির আচরণ, মানবশরীরের সঞ্চালনা বা অঙ্গভঙ্গি আমাদের হাসির মনে হয়, ঠিক সেই অনুপাতে যা আমাদের প্রাণহীন যন্ত্রের কথা মনে করায়ে দেয়।'

এইখানে অনেকের মনে হইতে পারে, বের্গসন প্যারাডক্সের মধ্যে পড়ছেন। কারণ বইয়ের প্রথম প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি বলছেন, ‘মানবিক সীমানার বাইরে হাস্যরসের অস্তিত্ব না থাকা’র কথা, তিনিই আবার বলতেছেন, ‘হাসির হয় মানুষের আচরণ যখন যন্ত্রের কথা মনে করায়।' 

আপাতভাবে প্যারাডক্সিক্যাল মনে হইলেও বাস্তবে বের্গসন আসলে বলতেছেন, হাস্যরসের কেন্দ্রে মানুষ থাকবে, কিন্তু সেই মানুষ অ্যাবনরমাল। শরীরী কমেডির জন্যে তাকে যান্ত্রিক হতে হবে অস্বাভাবিক হওয়ার খাতিরে। কিন্তু যান্ত্রিকতার মধ্যে যদি কোনো মানুষসুলভ উপাদান একদমই না থাকে তবে তা লোককে হাসাবে না। এক কথায়,‘সামথিং মেকানিক্যাল এনক্রাস্টেড অন দ্য লিভিং’। প্রাণবন্ত মানুষের মধ্যে যান্ত্রিকতা থাকতে হবে।    

‘লাফটার: অ্যান এসে অন দ্য মিনিং অফ কমিক’ হাস্যরসের তত্ত্ব বিষয়ক প্রথম বই যেখানে একজন দার্শনিক হাস্যরসের বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা নিছেন!

 

তৃতীয় প্রবন্ধ: দ্য এক্সপ্যানসিভ ফোর্স অফ দ্য কমিক

বিষয় হলো মানুষের কল্পনার সাথে হিউমারের সম্পর্ক নিয়া, কোন ধরনের বিষয়কে মানব কল্পনা হাসির মনে করে--তা বিশদে আলাপ করছেন বের্গসন। এছাড়া কমিকের বিষয়ে কিছু মন্তব্য করছেন তিনি।

 

হাসির ঘটনা ‘অস্বভাবিকতা’র সাথে সম্পর্কিত, বেখেয়াল হাসির

তার মতে, স্বাভাবিক কোনো লোক ফানি বলে মনে হবে না। অস্বাভাবিকতাই শুধুমাত্র হাস্যরস সৃষ্টি করে। অদ্ভুত ধরনের ও রঙের পোষাক, চলার ভঙ্গি ইত্যাদি হাসির। রাস্তায় হোঁচট খাওয়া ব্যক্তির কথা কমিক ফিগার হিসেবে তুলে ধরছেন তিনি।    

'রাস্তায় হাঁটতে থাকা এক লোক, হোঁচট খায়া পড়ে গেল, পথচারীরা সেইটা দেখে হো হো করে হাসলো। তারা লোকটাকে নিয়া হাসতো না যদি, আমার ধারণা, তারা লোকটাকে হঠাৎ স্বেচ্ছায় রাস্তায় বসে পড়তে দেখত। তাদের হাসির কারণ লোকটার পতন অনৈচ্ছিক, নিয়ন্ত্রণহীন। একইভাবে, তার আচরণের আকস্মিক পরিবর্তন হাসি জাগায় নাই, বরং জাগাইছে পরিবর্তনের অনৈচ্ছিক উপাদান--জবুথবু জড়সুলভ ভাব।'

বেখেয়াল বা অ্যাবসেন্টমাইন্ডেডনেসও হাসির মনে করছেন তিনি। বেখেয়ালের সময় ব্যক্তি শারীরিকভাবে হাজির থাকলেও তার মন পইড়া থাকে বহু দূরে--এটা মুভিতে হাসির উদ্রেক করার সহজ একটা তরিকা। 'বেখেয়াল সবসময় কমিকাল। আসলে বেখেয়ালের মাত্রা যত বেশি কমেডিও তত বেশি। সিস্টেমেটিক বেখেয়াল, যেমনটা আছে দন কিহোতে’র মধ্যে, হইতেছে সবচাইতে হাসির জিনিস। আমরা যদি দেখি, কেউ শেভিং ক্রিম দিয়া দাঁত মাজতে নিছে--আমাদের হাসি পাইতে পারে। অবশ্য এইটাও আসলে বের্গসনের কমিক যান্ত্রিকতার ধারণারই এক ধরনের সম্প্রসারণ।   

বের্গসনের মতে, অস্বাভাবিকতা, যেহেতু তা চমকপ্রদ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, হাস্যরসের একটা মৌল বিষয়। যদিও বইয়ের শুরুতে বলছেন, ‘কেন হাসে?’ এই ব্যাপারে তার আগ্রহ কম, এই পর্যায়ে এসে কেন হাসে বা কীভাবে হাস্যরস সৃষ্টি হয়, সে ব্যাপারে মন্তব্য করছেন।

 

তো, কেন হাসি পায়? 

'হাসি পায় তখনই যখন হৃদয়ঘটিত গভীর বা পবিত্র কিছু থেকে আমাদের মনোযোগ সম্পূর্ণ বৈষয়িক বা দুনিয়াবি তুচ্ছ কিছুতে হঠাৎ সরে যায়। যেমন, কোনো যাজক ধর্মবিষয়ে বক্তৃতা দেয়ার সময় যদি কোনো মাছি ঘুর ঘুর করে তাঁরে ত্যাক্ত করে--আমাদের মনোযোগ চলে যাবে যাজকের হাত দিয়া মাছি তাড়ানোর দিকে এবং দৃশ্যটা ফানি মনে হবে।'

এই উদ্ধৃতি হিউমার উৎপাদনের যে অনেকগুলা তত্ত্ব আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইনকনগ্রুয়িটি তত্ত্বের মধ্যে পড়ে। ইনকনগ্রুয়িটি থিয়োরির গুরু ধরা হয় কান্টকে যিনি বের্গসনের এই কথার কাছাকাছি বলছেন: 'হাসি হইতেছে তীব্র প্রত্যাশার হঠাৎ শূন্যতায় রূপান্তরজনিত ফলাফল।'  সহজে বললে, কোনো এক ধরনের প্রত্যাশা যখন হঠাৎ কিছু না বা তুচ্ছতায় মিলিয়ে যায়, তখন হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। কান্ট ও অন্য তাত্ত্বিকদের হাস্যরস বিষয়ক তত্ত্ব বিশদে অন্যত্র আলাপ করা হবে।

অবশ্য ‘কেন আমরা হাসি?’--এই প্রশ্নের উত্তর খুব জটিল। কারণ আমরা পরিবর্তনশীল সমাজে বাস করি, হাস্যরস কালচারের নানান নিয়মকানুন, প্রথা, ইতিহাসসহ নানান জটিল ফ্যাক্টরের সাথে জড়িত। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাবিদেরা বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে হাস্যরসরে ব্যাখ্যা করতে চাইছে এবং দেখা গেছে কোনো একটামাত্র তত্ত্ব দুনিয়ার সমস্ত হাস্যরসকে পুরাপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে নাই। তত্ত্বগুলা ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করব।  

ভ্লাদিমির  প্রপ-এর মতো কোনো কোনো সমালোচক বিশদে দেখাইছেন কীভাবে কালচার থেকে কালচারে, সময়ের বদলের সাথে সাথে হিউমার বদলায়ে যায়। তাই এই যুগে ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ বা ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর মতো পুরানো হাস্যরসাত্মক বইগুলো পড়লে খুব একটা মজা পায় না পাঠকেরা।

বার্গসনের দাবি, হাস্যরসের একটা অন্তত সার্বজনীন ভূমিকা আছে, তা স্থান কাল পাত্র যা-ই হোক না কেন। হাস্যরসের একটা মূল কাজ সংশোধনমূলক বা শাস্তিমূলক। তার মতে, 'দেহে নির্দিষ্ট উপাদান বেশি হয়া গেলে রোগ যেমন দেহরে শাস্তি দেয়, হাসিও তেমন কিছু কিছু ব্যর্থতা বা অপারগতারে শাস্তি দেয়। আলাদাভাবে ব্যক্তির সাথে ডিল করতে পারে না বলে, একটা গড়পড়তা লক্ষ্য নিয়া কাজ করে বলে হাসি অনেক সময় নিরপরাধরেও শাস্তি দেয়, কখনও বা অপরাধীরেও দেয় দায়মুক্তি।’  অর্থাৎ হিউমারে স্টেরিওটাইপিং হবেই।  

হিউমার বিষয়ে প্রথম বই হওয়ার বাইরে এই কারণেও বের্গসনের চিন্তা হিউমার-চিন্তার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ যে, হিউমারের সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ব্যবহার নিয়া তিনিই প্রথম সচেতনভাবে লিখছেন।

১৪৪৬ পঠিত ... ১৩:২৩, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top