যেসব কারণে একের পর এক ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে সড়কে প্রাণহানি বন্ধ হবে না

১২৩৬ পঠিত ... ২০:৫০, মার্চ ২০, ২০১৯

১৯ মার্চ (মঙ্গলবার) সকালে রাজধানীর প্রগতি সরণিতে রাস্তা পার হবার সময় সুপ্রভাত পরিবহনের দুটো বেপরোয়া বাসের চাপায় জেব্রা ক্রসিংয়ের উপর প্রাণ হারান আবরার আহমেদ চৌধুরী নামের এক শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালসের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থী রাস্তা পার হচ্ছিলেন অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভার্সিটি বাসের উদ্দেশ্যে। এই দুর্ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রতিশ্রুতি দেন দুর্ঘটনাস্থলে দুই মাসের ভিতরেই একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের।

এমনটা এবারই প্রথম নয়। এর আগে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সড়ক দুর্ঘটনার পর ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ফুটওভারব্রিজ কতটা ব্যবহার হয়? এই যেমন একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বুয়েটের এক শিক্ষার্থী নিহত হবার ঘটনায় বুয়েটে বানানো হয়েছিল একটি ওভারব্রিজ। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত ওভারব্রিজগুলোর একটি এটি। ঢাকা শহরে এমন ওভারব্রিজের সংখ্যা নিতান্তই কম না।

নিরাপদ সড়ক মানেই কি ফুটওভার ব্রিজ? রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং এসবের বেসিক বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন কামরুজ্জামান কামরুল। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এখন একই বিভাগে মাস্টার্সে পড়ছেন। পড়ে নিন, যেসব কারণে নিরাপদ রাস্তা পারাপার মানেই ফুটওভার ব্রিজ না।  

 

সড়ক দুর্ঘটনা, চালকের অবহেলা আর পথচারীদের খামখেয়ালী চলাচল প্রসঙ্গে আমাদের অনেকের মধ্যেই কিছু ভুল ধারণা আছে বলে মনে হয়েছে।

কোনো দুর্ঘটনা হলেই সম্ভবত সবার আগে যে ইস্যুটা আসে, একটা ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা এবং মানুষজনকে এটি দেখিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া।

ফুটওভারব্রিজ জিনিসটা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার! হুটহাট বানালাম আর এটা ফাংশনাল হয়ে গেলো, এমনটা না। জিনিসটাতে ফিন্যান্সিয়াল ইনভেস্টমেন্ট ছাড়াও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষজন এটা কতটা ব্যবহার করবে, সেটা নিয়েও স্টাডি করা।

কোনোরকম স্টাডি ছাড়া শুধুমাত্র মানুষজনকে বুঝ দেবার জন্য ফুটওভার ব্রিজ করা হয়েছে, যেটার ফাংশনালিটি নাই, এইরকম উদাহরণ অনেক আছে। বুয়েটের সামনে, শাহবাগে, বাংলা মোটরে এবং আরো অনেক ইন্টারসেকশনে (যে জায়গায় দুটি রাস্তা এসে মিলে যায়; চৌরাস্তা)।

অনেকেই সম্ভবত এই পর্যন্ত পড়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলছেন। হয়ত ভাবছেন যে, বাংলা মোটর কিংবা শাহবাগের ফুটওভার ব্রিজ খুবই ইম্পরট্যান্ট! এইটা কেন বেহুদা হবে?

কেন এসব জায়গায় ওভারব্রিজ গুরুত্বপূর্ণ না, সেটা কিছুটা ব্যাখ্যা করতে হবে।

মানুষজনের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে কম কষ্ট করে রাস্তা পার হওয়া। এটা শুধু বাংলাদেশে না, সারা পৃথিবীতে। কাজেই ডিজাইন ফিলসফিটা হচ্ছে, আপনি এমন ব্যাবস্থা করবেন, যাতে মানুষজন সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং এটার জন্য কোনো কষ্ট করতে না হয়, অথবা কম কষ্ট করতে হয়!

এখন ব্যবস্থা বলতে অবশ্যই পত্রপত্রিকাতে আমরা যে রকম ছবি দেখি, পুলিশ গিয়ে কমান্ডো স্টাইলে ঝাপায়া পড়তেছে, তেমন ব্যবস্থা অবশ্যই না। জরিমানা করাও না। সত্যি বলতে কি, বিশ্বাস করেন অথবা নাই করেন, এই জায়গাতে জনগণের বিশেষ দোষ নাই রাস্তার মধ্যে দিয়ে পার হবার। রাস্তাতে গাড়ি ঘোড়া বসে থাকলে, ডিভাইডারে আরামসে লাফ দিয়ে উঠে অন্য পাশে চলে যেতে পারলে সবাই এই কাজই করবে। রাস্তার মধ্যে দিয়েই পার হবে।

আপনি যেটা করতে পারেন, সেটা হলো যে কারণগুলোর জন্য মানুষজন এইরকম রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করে, সেগুলোকে কমিয়ে আনতে পারেন। আর তাদের এই ন্যাচারালি আকাশে উঠার বিষয়টাকে বাদ দিয়ে সেটাকে এক জায়গাতে নিয়ে কনভার্জ করতে পারেন, ইন্টারসেকশনে।

 শাহবাগের এই ইন্টারসেকশনে প্রতিদিন অসংখ্য পথচারী রাস্তা পার হন

আরেকটু খোলাসা করা যাক। ইন্টারসেকশনগুলোতে এমনিতে ফোর ফেইজ সিগনাল কাজ করে বাংলাদেশে। এগুলোর সাথে একটা এক মিনিটের পথচারী পারাপার সিগনাল যোগ করলে পুরো জিনিসটা পানির মত সহজ হয়ে যায়। সবাই খুব আরামে পার হয়ে যেতে পারে।

ফুটওভার ব্রিজ গুলোর বড় একটা সমস্যা হচ্ছে, বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষজন কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা এতে উঠতে পারেন না, বা চান না। কাজেই স্বাভাবিক প্রবণতা কাজ করে নিচ দিয়ে পার হবার। যতদিন পর্যন্ত ওভারব্রিজগুলোর সবার জন্য এক্সেসের সিস্টেম থাকবে না, সবার কষ্ট কমবে না, ততদিন পর্যন্ত এই জিনিস কেউ ব্যবহার করবে না।

আরে ভাই, সিম্পল ব্যাপার, রাস্তাতে গাড়ি ঘোড়া চলতেসে না। আমি ক্যানো বেহুদা ২৫ ফিট উপরে উঠতে যাবো? বরং গাড়ি ঘোড়া চলতেসে না, এই গ্যাপটা ব্যবহার করি মানুষজনকে কন্ট্রোলড ওয়েতে পার হতে দেবার জন্য। ক্ষতি তো নাই?

তারমানে, ইন্টারসেকশনে ফুটওভার ব্রিজ দেয়া যাবে না। দিলে বেহুদা খরচ বাড়বে। মানুষজন রাস্তা দিয়েই পার হবে, জেব্রা ক্রসিং ইউজ করেও হতে পারে। অথবা এক মিনিট বা তিরিশ সেকেন্ডের ডেডিকেটেড পেডেস্ট্রিয়ান সিগনাল এনফোর্স করতে হবে নির্দিষ্ট সময় পরপর।

তাইলে ফুটওভারব্রিজ দিবে কই?

এটার উত্তর আপনি একটু চিন্তা করেন আগে।

যে সকল রাস্তায় টানা ভেহিকেল মুভমেন্ট করে, মাঝখানে কোনো স্টপেজ নাই বা সচরাচর থামে না, টানা ডিভাইডার আছে, বাট মেইন রোডের দুই পাশের লোকাল রোডে মানুষজন নিয়মিত এপাশ ওপাশ যাতায়াত করতে চায়, এইরকম জায়গায় আপনি ফুটওভার ব্রিজ দিবেন। উদাহারণ, ফার্মগেট এবং কারওয়ান বাজারের রাস্তার মাঝের ফুটওভার ব্রিজ দুইটা।

এখানেও কিছু পাবলিক আছে যারা বেড়া ছিড়েখুড়ে, ডিভাইডার ভেঙ্গেচুরে হলেও নিচ দিয়াই রাস্তা পার হতে চাইবে। এদের নিয়ে কিছু বলার নাই, ধইরা জরিমানা করেন, জেলে ঢুকান, ফাঁসিতে ঝুলান যা খুশি করেন। দৌড়াইতে গিয়া এরা চাঁপা পড়ে, এদের কারণে দোষ হয় ড্রাইভারের। আরো একটা কথা বিশ্বাস কইরেন, আমরা যেভাবে ড্রাইভারদের দোষ দেই ঢালাও ভাবে, ওরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এত দোষী থাকে না। দোষ পথচারীদেরও আছে। তবে সবচাইতে বেশি দোষ নীতি নির্ধারকদের, তারপর ইঞ্জিনিয়ারদের।

এইবার সর্বশেষ ইস্যু! প্রশ্ন করতেই পারেন, আমি যে এত কথা বললাম, আমি এসব কিভাবে বুঝলাম?

উত্তর হচ্ছে যে, আমি এসব বের করি নাই। এগুলো ডেভেলপ করেছে ভয়াবহ পন্ডিত সব লোকজন। যারা ভিশনারি, ডেভেলপমেন্ট বোঝে, হিউম্যান বিহেভিয়ার কিভাবে ম্যানিপুলেট করা যায়, কাজে লাগানো যায় এসব বুঝে। চাইলে অসংখ্য উদাহারণ দেখানো সম্ভব এসব ফুটওভার ব্রিজ সংক্রান্ত। আপনি চাইলে গুগল সার্চও করতে পারেন। এগুলো AASHTO বইয়ে বলা আছে, আর আমি শিখছি শামসুল হক স্যারের ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস করতে গিয়ে। পৃথিবীর যে কোনো একটা উন্নত দেশের টোটাল ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেমে আপনি একটা ইন্টারসেকশনে একটা ফ্লাইওভার দেখাতে পারবেন না। যাও আগে ছিলো, এখন সব ভেঙ্গে ফেলেছে বা সরিয়ে ফেলছে।

এতো কথার সারাংশ হচ্ছে,

১) ইন্টারসেকশনে ফুটওভারব্রিজ দেওয়া উচিত না। থাকা উচিত জেব্রা ক্রসিং অথবা ডেডিকেটেড পেডেস্ট্রিয়ান সিগনাল। আপনি জোর করে ফুটওভার ব্রিজ দিতেই পারেন, নিয়ম জারি করতেই পারেন, কিন্তু মানুষ সেটা ব্যাবহার করবে না, এটা ইনক্লুসিভ ডিজাইন হবে না।

২) ফুটওভার ব্রিজ দিতে হয় টানা রাস্তায়। যেখানে উঁচু ডিভাইডার দিয়ে রাস্তা আলাদা করা আছে এবং আপনি যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে চান, এমন জায়গায়।

৩) যে জায়গাটায় আবরার মারা গেল, সেটা কোন ইন্টারসেকশন না। তাই সেখানে হয়ত একটা ওভারব্রিজ হতে পারে। কিন্তু কোন রকম ফিল্ড স্টাডি ছাড়া একটা দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই যদি ওভারব্রিজ নির্মাণ করে ফেলা হয়, তাহলে হয়ত সেটারও কোন ফাংশনালিটি থাকবে না। শুধুই পয়সা খরচ। পকেট ভরার উন্নয়ন।

শেষ কথা! হাত-পা কেটে গেলে কিন্তু ফ্লাজিল খেলে কোন কাজ হয় না। ভিন্ন অসুখের জন্য ভিন্ন ওষুধ কাজ করে। তাই সড়ক সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যার সমাধান যদি হয় ফ্লাইওভার এবং ওভারব্রিজ, সেটা অনেকটা রাস্তার ক্যানভাসারের বিক্রি করা সর্বরোগের মহৌষধের মতোই কাজ করবে।  

১২৩৬ পঠিত ... ২০:৫০, মার্চ ২০, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top