মুহাম্মদ আলী, বক্সার। এই ছোট্ট পরিচয়েই তাকে চেনে দুনিয়াজোড়া লোক। পৃথিবীর সবচাইতে বিখ্যাত বক্সার। দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় স্পোর্টসম্যান। সব পরিচয়ই তার জন্য সত্যি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্টাকির লুইসভিলে জন্মেছিলেন তিনি। তখন নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে। আফ্রিকান আমেরিকান বলে জীবনের একটা বড় অংশ কাটাতে হয়েছে বর্ণবাদের বিভীষিকার শিকার হয়ে। খুব সাধারণ পরিবারে জন্মেও দমে যাননি কখনো। একেবারে সত্যিকারের লড়াই করেছেন। একের পর এক বক্সারকে নক আউট করে যেন হয়েছেন নিপীড়িতদের প্রতীক।
পৃথিবীর যে প্রান্তেই গিয়েছেন, মানুষ তাকে ভালোবাসায় সিক্ত করেছে। বাংলাদেশেও এসেছিলেন 'দ্য গ্রেটেস্ট'। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসলে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বক্সিং রিংয়ের ভেতর ও বাইরে এই উজ্জ্বল মানুষটার জীবনে আছে অসংখ্য মজার এবং অভাবনীয় ঘটনা। eআরকির পাঠকদের জন্য থাকছে তেমন দশটি ঘটনা।
১# আলীর বক্সিংয়ে আসার ঘটনাটা অনেকটাই নাটকীয়। মাত্র বারো বছর বয়সে সাইকেলচোর ধরার মাধ্যমে তার বক্সিং জগৎ-এ আসার সুত্রপাত ঘটে। সে সাইকেল চোর ধরার সময় চোরকে এত জোরে ঘুষি মারেন, যা দেখে লুইসভিল থানার অফিসার জো মার্টিন তাকে বক্সিং শেখার পরামর্শ দেন৷ ৬ সপ্তাহ পরে, মার্টিনের প্রশিক্ষণেই আলী জেতে তার প্রথম বক্সিং ম্যাচ।
২# মুষ্টিযুদ্ধে সেরা হলেও মুহাম্মদ আলী যে মগজ খাঁটানোর বেলায় একেবারেই কাঁচা, তা তার আর্মি আইকিউ টেস্টের নম্বর দেখলে যে কেউই বুঝবে। তাই তো আর্মিতে তিনি ‘শুধুমাত্র অতি সংকটাপন্ন ক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত’ ছিলেন। কারণ, আইকিউ টেস্টে তার স্কোর ছিল মাত্র ৭৮, অর্থাৎ ফেল। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি বলেছিলাম আমি সেরা। কিন্তু বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে যে সেরা তা তো বলিনি।’
৩# মুষ্টিযুদ্ধের লড়াইয়ে মুহাম্মদ আলীকে হারানো যেমন কঠিন, তেমনি কথার লড়াইয়ে তাকে হারানোও ঠিক তেমনিই কঠিন। ছড়া কেটে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো হলেও মুহাম্মদ আলীর বিপক্ষে লড়াই করা বক্সারদের ঘুম অনেকটাই হারাম হয়ে যেত যখন আলী উপহাস করে ‘সে কিভাবে জিতে যাবে’ সে বিষয়ক ছন্দে মেলানো কথা ছুড়ে দিতো প্রতিপক্ষ বক্সারদের দিকে তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে। তার খেলার ছলে বানানো ছড়াগুলো এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে কলাম্বিয়া রেকর্ডস ১৯৬৩ সালে ‘আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট’ নামে একটি স্পোকেন ওয়ার্ড অ্যালবাম রিলিজ করে যেখানে আলী একটি ব্যান্ডদলকে সঙ্গে নিয়ে লাইভ স্টুডিওতে দর্শকদের সামনে তার খেলার ছলে তৈরি ‘কবিতা’ পরিবেশন করেন।
৪# মুহাম্মদ আলী ছাড়া আর একজন বক্সারকে এক নামে প্রায় পুরো পৃথিবী চেনে। তিনি হচ্ছেন মাইক টাইসন। অবশ্য তার ‘খ্যাতি’র পিছনে বক্সিং রিং ও রিংয়ের বাইরে জন্ম দেওয়া সব অঘটনও অনেকাংশে দায়ী। মুহাম্মদ আলীর শেষ ম্যাচে দর্শক সারিতে ছিলেন কিশোর টাইসন। ল্যারি হোমসের বিরুদ্ধে সে ম্যাচে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যান আলী। টাইসন তখন আলীকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি বদলা নেবেন। ৭ বছর পর ল্যারি হোমসের প্রতিপক্ষ হিসেবে রিংয়ে উঠলেন টাইসন। দর্শকসারিতে এদিন উপস্থিত ছিলেন আলী। ফলাফলটা অনুমেয়ই। চতুর্থ রাউন্ডে ল্যারি হোমস নক আউট গেলেন। কথা রাখলেন টাইসন।
৫# ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে আলী বলেন যে, রোমের অলিম্পিকে সোনা জিতে ফেরার পর তিনি তার গোল্ড মেডেলটি টাইগ্রিস নদীতে ছুড়ে ফেলে দেন। কারণ, অলিম্পিক সোনাজয়ী জনপ্রিয় বক্সার হওয়া সত্ত্বেও তাকে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তার ‘অপরাধ’ তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। এ নিয়ে রেস্টুরেন্টদের লোকেদের সাথে বিবাদেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। তাই রাগে, ক্ষোভে তিনি মেডেলটি পানিতে ফেলে দেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে আটলান্টায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে তাকে আরেকটি মেডেল দেওয়া হয়।
৬# সে সময় হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন সনি লিস্টন। শুধু দুর্দান্ত বক্সারই নন, অপরাধী হিসেবে পুলিশের খাতায় নামও ছিল তার। মুহাম্মদ আলী তখন ছিলেন আন্ডারডগ, কিন্তু তারপরও তখনকার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টনের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে লিস্টনকে বিশাল কদাকার ভাল্লুক বলে ডাকেন আলী এবং বলেন যে লিস্টনের শরীর থেকে মাঝে মাঝে ভাল্লুকের গন্ধ বের হয়। ধারণা করা হয়, সেই ম্যাচের ফিফথ রাউন্ডে লিস্টন তার গ্লাভসে অয়েন্টমেন্ট জাতীয় কিছু লাগান, যার ফলে আলীর চোখে দেখতে সমস্যা হয় বারবার। তবুও আলী সপ্তম রাউন্ডে লিস্টনকে পরাজিত করে রাতারাতি ইতিহাস গড়ে ফেলেন।
৭# মুহাম্মদ আলীর ছিল ‘ফ্লাইটফোবিয়া’। বক্সিং রিংয়ে অদম্য এই বক্সারের কোন সাধ ছিল না পাখি হবার। আকাশে নিয়ে তার বিস্তর ভয়। এতটাই ভয় যে, একবার অলিম্পিক গেমস থেকে পর্যন্ত তিনি তার নাম সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। কারণ অলিম্পিকে যেতে হলে চড়তে হবে উড়োজাহাজ। ১৯৬০ সালে রোমে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্য প্লেনে চড়তে হবে বলে রোমে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে নাম কাটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন আলী। শেষ পর্যন্ত তিনি যেতে রাজি হলেও আর্মি স্টোর থেকে প্যারাসুট কিনে আনেন যেটি তিনি ফ্লাইটের পুরো সময়ই পড়ে ছিলেন।
৮# বড়বড় বক্সারদের কুপোকাত করা ছাড়াও মুহাম্মদ আলী সুপারম্যানের বিপক্ষেও কিন্তু লড়াই করেছিল এবং সুপারম্যানকেও কুপোকাত করে দিয়েছিলেন আলী। সুপারম্যান কমিকের #C-56 ইস্যুতে মুহাম্মদ আলী মুখোমুখি হয় ম্যান অফ স্টিল তথা সুপারম্যানের। আর বরাবরের মতনই সুপারম্যানকেও হারিয়ে দিয়ে জয়ী হয় আলী। এবং হ্যাঁ, পৃথিবীকেও সেবার সুপারম্যানের বদলে মুহাম্মদ আলী-ই "সেইভ" করেছিল।
৯# কমিকের জগতে সুপারম্যানের বিপক্ষে লড়াই করলেও মুহাম্মদ আলী ছিলেন বাস্তব জগতের সুপারহিরো। তিনি ২১ বছর বয়সী এক যুবককে আত্নহত্যার পথ থেকে শেষ মুহূর্তে ফিরিয়ে এনেছিলেন। নয় তলা থেকে লাফ দেওয়ার আগ মুহূর্তে আলী তার সাথে আধঘন্টা কথা বলেন এবং বোঝান। ফলে শেষ পর্যন্ত যুবকটি ফিরে আসে মৃত্যুর দুয়ার থেকে। তারপর তারা দুজন একসাথে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে আসেন। লস অ্যাঞ্জেলসের পুলিশেরা এর পুরো কৃতিত্ব আলীকেই দেয়।
১০# ১৯৬৫ সালে আলী এবং সনি লিস্টনের জনপ্রিয় হেভিওয়েট রিম্যাচে যেই গ্লাভস পরে আলী প্রথম রাউন্ডেই লিস্টনকে ‘ফ্যানটম পাঞ্চ’ দিয়ে ‘নকআউট’ করে দেন সেই গ্লাভসটি পরবর্তী সময়ে নিলামে উঠানো হয়। গ্লোভসটি একজন অজ্ঞাতনামা ক্রেতা নিজের দখলে নিয়ে নেয় ৯৬৫,০০০ ডলারে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন