লুই পাস্তুর যেভাবে জলাতঙ্কের জীবাণু দিয়েই জলাতঙ্কের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছিলেন

৪০৪৮ পঠিত ... ১৬:৪২, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৮

১৮৮৫ সালের জুলাই মাসের চার তারিখ ফ্রান্সের একটি ছোট শহরে নয় বছরের বাচ্চা ছেলে জোসেফ মাইস্টার স্কুলে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে বিশাল এক কুকুর এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাচ্চাটিকে আঁচড়ে-কামড়ে শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি করে দিল। এই পাগলা কুকুরটা ভয়ংকর রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কে ভুগছে। যেভাবে কুকুরটা বাচ্চাটিকে কামড় দিয়েছে তাতে বাচ্চাটিও যে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮৮৫ সালে জলাতঙ্কের চিকিৎসা ছিল না। এটি যে একটি ভাইরাস বাহিত রোগ সেটাও কেউ জানতো না। এখনকার মানুষ যেমন জানে, তখনকার মানুষও তেমনি জানতো রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কের রোগের মৃত্যু থেকে ভয়ংকর কোনো মৃত্যু হতে পারে না। জ্বর দিয়ে শুরু হয়, অস্বাভাবিক এক ধরনের বিষণ্নতা ভর করে সেটা পাল্টে যায় অনিয়ন্ত্রিত একধরনের উত্তেজনায়। গলার মাংসপেশীতে এক ধরনের খিঁচুনী শুরু হয়। মুখ থেকে ফেনা বের হতে শুরু করে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে চায় কিন্তু একবিন্দু পানি খেলেই খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। শেষের দিকে পানি খেতে হয় না। পানি দেখলেই উন্মত্ত এক ধরনের খিঁচুনি ভর করে।

জোসেফ মাইস্টারের মা তার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে বললেন, তার কিছুই করার নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে প্যারিসের লুই পাস্তুরের কাছে নেওয়া যেতে পারে। যে বিষয়টি সবচেয়ে বিচিত্র সেটি হচ্ছে লুই পাস্তুর কোনো ডাক্তার নন, তিনি একজন রসায়নবিদ। তার বয়স তখন তেষট্টি, স্টোকে শরীরের অর্ধেক অংশ অবশ। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে গেছেন কিন্তু তখনও সারা দেশের মানুষের তার ক্ষমতার উপর অগাধ বিশ্বাস।

লুই পাস্তুর খুব বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বলা যায়, তাকে দিয়েই মাইক্রোবায়োলজি বা আধুনিক চিকিৎবিজ্ঞান শুরু হয়েছে। ১৮৮০ সালে যখন লুই পাস্তুর তার অর্ধেক অবশ শরীর নিয়ে রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কে রোগের উপর গবেষণা শুরু করেছেন তখন এটি সম্পর্কে তিনটি বিষয় জানা ছিল। এক. রেবিজ আক্রান্ত পশুর লালায় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আছে। দুই. পশুর কামড়ে ক্ষতস্থান তৈরী হলে এই রোগের সংক্রমণ হয়। এবং তিন. সংক্রমণের পর কয়েকদিন থেকে কয়েকসপ্তাহ পরে এই রোগের উপসর্গগুলি দেখা যায়। এর বাইরে পুরোটাই একটা রহস্য।

লুইপাস্তুর খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রথমেই চেষ্টা করলেন জলাতঙ্কের কারণটি আলাদা করতে। একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গেলে তার রোগীর প্রয়োজন তাই লুই পাস্তুরের প্রথম কাজ হলো নিয়ন্ত্রিতভাবে পশুদের মাঝে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ করানো। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে রেবিজ আক্রান্ত হিংস্র পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা সংগ্রহ করে সেটা দিয়ে খরগোশ বা কুকুরকে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে দেখা গেল এই পদ্ধতিটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। তাছাড়া, সেটি ছিল খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। একটা পশুর মাঝে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে যদি মাসখানেক লেগে যায় তাহলে সেটা নিয়ে তো আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায় না। দ্রুত আক্রান্ত একটা পদ্ধতি বের করতে হবে।

লুই পাস্তুর চিন্তা করতে লাগলেন, রোগের উপসর্গ দেখে মনে হয় এটি স্নায়ুরোগ, মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ আছে।জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালা না নিয়ে যদি স্পাইনাল কর্ডের অংশবিশেষ সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশন দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী হয়? যেরকম চিন্তা সেরকম কাজ এবং লুই পাস্তুর আবিষ্কার করলেন তার ধারণা সত্যি। সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশন দিয়ে খুব নির্ভরযোগ্য ভাবে দ্রুত তিনি পশুকে রেবিজ রোগে আক্রান্ত করিয়ে দিতে পেরেছেন। এখন তিনি গবেষণার পরের ধাপে পা দিতে পারেন; রোগের কারণটিকে আলাদা করে বের করা।

এখানে এসে তিনি যেন এক শক্ত পাথরের দেয়ালের মাঝে ধাক্কা খেলেন। কিছুতেই এই অদৃশ্য কারণকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। একটা ব্যাক্টেরিয়াকে কৃত্রিম পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়, বংশবৃদ্ধি বা কালচার করা যায় কিন্তু এই অদৃশ্য পরজীবী প্রাণটিকে কোনো ভাবেই ল্যাবরেটরির টেস্টটিউবে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। লুই পাস্তুর আবার খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো ভাবলেন যদি তাকে কৃত্রিম অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা না-ই যায়, তাহলে তাকে জীবন্ত কোথাও বাঁচিয়ে রাখা হোক। সেই জীবন্ত অংশটুকু হলো খরগোশের মস্তিষ্ক। আবার লুই পাস্তুরের ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো, খরগোশের মস্তিষ্কে এই অদৃশ্য জীবাণু শুধু বেঁচেই থাকে না, আরো ভয়ংকর আরও সর্বনাশী হয়ে ওঠে, ছয়দিনের মাঝে এই রোগ তার সর্বগ্রাসী উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয়।

লুই পাস্তুর এখন গবেষণার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছেন, এখন এমন একটা প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে হবে যেটা দিয়ে এই রোগের প্রতিষেধক বের করা যায়। একদিন ল্যাবরেটরিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে দেখলেন একজন সহকারী জলাতঙ্ক আক্রান্ত একটা খরগোশের স্পাইনাল কর্ড কাচের ফ্লাস্কে ঝুলিয়ে রেখেছেন, কতদিন এই ভয়ংকর জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে সেটাই হচ্ছে পরীক্ষার উদ্দেশ্য। লুই পাস্তুর কাচের ফ্লাস্কের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন, কিছুদিন আগেই মোরগের কলেরা রোগের ব্যাক্টেরিয়াকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করে ভ্যাক্সিন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখানেও সেটি কি করা যায় না? যে অদৃশ্য জীবাণু তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু যার অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই সেটাকে কী দুর্বল করে এর প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।

পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যবহারিক বিজ্ঞানী তখন কাজে লেগে গেলেন। খরগোশের স্পাইনাল কর্ডে বেঁচে থাকা জীবাণুকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করতে লাগলেন। প্রতিদিন সেখান থেকে একটা অংশ নিয়ে সেটাকে গুঁড়ো করে সুস্থ খরগোশের মাথায় ইনজেকশন দিতে শুরু করলেন। যতই দিন যেতে লাগলো এই ভয়ংকর জীবাণু ততই দুর্বল হতে শুরু করলো, বারো দিন পর জীবাণু এত দুর্বল হয়ে গেল যে, সেটা সুস্থ প্রাণীকে সংক্রমণ করতেই পারলো না।

এখন আসল পরীক্ষাটি বাকি, এই প্রক্রিয়ায় সত্যিই কি জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরী করা সম্ভব? লুই পাস্তুর পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। একটা কুকুরের মস্তিষ্কে প্রথমে বারো দিনের দুর্বল জীবাণু প্রবেশ করানো হলো, তার পরের দিন এগারো দিনের জীবাণু তার পরেরদিন দশ দিনের জীবাণু। এভাবে প্রত্যেক দিনই আগের থেকে একটু বেশি ভয়ংকর জীবাণু কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকশন দেওয়া হলো কিন্তু এত দিনে কুকুরটির দেহে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরী হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর নিয়েও সেটি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলো। লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক বের করেছেন তবে মানুষের জন্য নয় পশুর জন্যে।

ঠিক এরকম সময়ে নয় বছরের জোসেফ মাইস্টারকে নিয়ে তার মা এলেন লুই পাস্তুরের কাছে, আকুল হয়ে লুই পাস্তুরকে বললেন, তার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে। লুই পাস্তুর খুব চিন্তার মাঝে পড়ে গেলেন, নয় বছরের এই বাচ্চার মাঝে নিশ্চিতভাবেই জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু ঢুকে গেছে, একজনের শরীরে জীবাণু ঢোকার পর তার শরীরে কী প্রতিষেধক তৈরী করা যাবে? যে প্রক্রিয়া কখনো কোনো মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা হয়নি সেটি কি একটা শিশুর শরীরে পরীক্ষা করা যায়?

অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি পরীক্ষাটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে দুই সপ্তাহের পুরোনো জীবাণু তারপর তেরো দিনের তারপর বারো দিনের। এভাবে যতই দিন যেতে লাগলো ততই আগ্রাসী জীবাণু বাচ্চাটির শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। একে বারে শেষদিন তার শরীরে জলাতঙ্ক রোগের যে জীবাণু ঢোকানো হলো সেটি অন্য যে কোনো পশু বা মানুষকে এক সপ্তাহের মধ্যে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে। সেই সময়টা সম্ভবত ছিল লুই পাস্তুরের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় -- তিনি খেতে পারেন না, ঘুমাতেও পারেন না, তার মাথায় শুধু একটা চিন্তা ছেলেটি কি বাঁচবে না মারা যাবে?

ছেলেটি মারা যায়নি। লুই পাস্তুরেরর চিকিৎসায় প্রথম জলাতঙ্ক রোগীটি বেঁচে উঠলো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে লুই পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় অবদানটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

জোসেফ মাইস্টার তার প্রাণ বাঁচানোর কারণে সারা জীবন লুই পাস্তুরের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল৷ সে বড় হয়ে লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরির দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব নিয়েছিল। নাৎসি জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন নাৎসি বাহিনী লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরি দখল করতে আসে। জোসেফ মাইস্টার গেটের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে ল্যাবরেটরি রক্ষা করার চেষ্টা করে।

জার্মান সেনাবাহিনীর গুলিতে তার মৃত্যু হওয়ার আগে সে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি।

৪০৪৮ পঠিত ... ১৬:৪২, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৮

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top