কানপাতলা বাঙালি এবং প্লাস্টিক চাল ও ডিমের দিবাস্বপ্ন

২৫০৪ পঠিত ... ১৮:৫৩, এপ্রিল ২২, ২০১৮

ফেসবুকে আমার টাইমলাইনে সরাসরি না হলেও অন্যদের শেয়ার করা বেশ কিছু ভিডিও আজকাল দেখতে পাচ্ছি -- জনৈক ফেসবুকার উত্তেজিত স্বরে বলছেন, এতোদিন বিশ্বাস না করলেও আজ নিজের চোখে প্রমাণ পেয়েছেন, প্লাস্টিকের চাল বা প্লাস্টিকের নকল ডিম। এবং প্রমাণ হিসাবে দেখানো হয় কিছু জিনিস -- তার সাথে যোগ হয় এখনকার ব্যবসায়ীরা কতো খারাপ এর উপরে মুফত কমেন্ট্রি।

আসলেই কি বাজার ভরে গেছে প্লাস্টিকের চালে? কিংবা প্লাস্টিকের ডিমে?

এই গুজবটা নতুন না, অনেকদিন ধরেই নানা দেশে প্লাস্টিকের চাল বা ডিমের গুজবটা ছড়াচ্ছে। নকল ডিমের "প্রমাণ" হিসাবে ইউটিউবের একটা ভিডিও দেখানো হয় যাতে কোনো এক ফ্যাক্টরিতে এরকম ডিম বানানোটা ধাপে ধাপে দেখানো হয়।

ঘটনা কি তাহলে সত্যি?

প্রথমেই আসি নকল ডিম বানানো সম্ভব কি সম্ভব না সেই প্রসঙ্গে। অবশ্যই সম্ভব, মোম এবং এই জাতীয় নানা দ্রব্য মিশিয়ে ডিমের মতো দেখতে কিছু অবশ্যই বানানো চলে। চীনে নানা উৎসবে এরকম ডিমের ব্যবহার আছে বলে অনেক জায়গায় পড়লাম, আবার স্থানীয়ভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা চীনে এগুলো বেচে ধরা পড়েছে, তাও পড়লাম দুই এক জায়গায়।

তাহলে কি বাংলাদেশে আসছে চীনা নকল ডিম? ফেসবুকে দেখা ভিডিওতে গজগজ করতে থাকা ফেসবুকারটির কথা কি ঠিক?

এরকম অনেক ভিডিও আছে তবে আমি যেটা দেখেছি সেটা এরকম -- বাংলাদেশের একজন ক্রেতা বাজার থেকে ডিম কিনে এনে দেখেছেন ভিতরের কুসুমটা অদ্ভুত হয়ে গেছে, আর ডিমের খোসার ঠিক নিচে একটা কাগজের মতো কিছু, প্লাস্টিক প্লাস্টিক ভাব লাগছে। এইটাকে মোক্ষম প্রমাণ হিসাবে তিনি পেয়েছেন, এতেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যেন এটা নকল ডিম, খোদ চীন থেকে পাঠানো।

ভিডিওটা দেখে অনেকক্ষণ হাসলাম। হাসতেই থাকলাম। কারণ বিজ্ঞ পোস্টদাতা (বা দাতৃ) জীবনে কখনো পঁচা ডিম দেখেন নাই, তা বোঝা গেলো। বাংলাদেশের গরমে দোকানে বাইরে ডিম বেশিদিন রাখলে তা পঁচবেই, আর পঁচা ডিমের কুসুমও অবধারিতভাবেই ওরকম দেখাবে। কিন্তু খোসার নিচের 'প্লাস্টিক' এর আবরণটা? ঘটনা হলো ডিমের ভিতরে খোসার ঠিক নিচে একটা পাতলা মেমব্রেন বা আবরণ থাকে বটে। ডিম কড়া রোদে বেশিদিন থাকলে সেটা শুকিয়ে কাগজের মতো হতে পারে। তাই বলে তাকে প্লাস্টিক বা কাগজ মনে করাটা ছেলেমানুষী রকমের হাস্যকর।

একই ঘটনা "প্লাস্টিক" এর চালের ক্ষেত্রেও চলে। আরেকটি ভিডিওতে দেখলাম একজন ভাত রান্না করার পরে ভাতের চেহারা দেখে বলছেন এটা নির্ঘাত প্লাস্টিকের চাল। ভাতের মাড় নাকি শুকিয়ে প্লাস্টিকের মতো হয়ে গেছে, আর ভাতটাকে বল বানিয়ে বাউন্স করানো যাচ্ছে।

পোস্টদাতা কি কখনো ভাতের মাড় শুকানোর পরে কেমন হয় দেখেননি? চাল পুরানো হলে পঁচতে পারে বটে, আর সেই পঁচা চালের মাড় নানা অবস্থায় হাঁড়ির গরমে পড়ে প্লাস্টিকের মতো চেহারা হতে পারে বটে।

কিন্তু ঐ যে, মোক্ষম "প্রমাণ" ভাতের বল বাউন্স করা? প্লাস্টিক না হলে কি সেটা হতে পারে? জ্বী অবশ্যই পারে। ভাত মূলত কার্বহাইড্রেট, আর ভাতের স্থিতিস্থাপকতা অনেক সময়ে রবারের মতো হওয়া সম্ভব পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়ম মেনেই। তার জন্য প্লাস্টিক হওয়ার দরকার নাই। কাজেই ভাতের বল বাউন্স করলেই সেটা প্লাস্টিক হওয়ার প্রমাণ নয় মোটেও।

যাহোক এরকম আরো কথা বলে তথাকথিত 'প্রমাণ'গুলোর বিভ্রান্তি ধরিয়ে দিতে পারি, কিন্তু তার বদলে অন্যভাবে ব্যাপারটা দেখা যাক। এক কেজি চালের খুচরা দাম কতো? ৬০ টাকা? ১০০ টাকা? আর এক কেজি প্লাস্টিকের দাম কতো? মোটামুটি নিম্নমানের ১ কেজি প্লাস্টিকের দাম কোনো অবস্থাতেই ১৫০-২০০ টাকার কম হবে না (আমেরিকার বাজারে প্লাস্টিকের পাইকারি দাম দেখে বললাম), আর সেই প্লাস্টিক কাঁচামালকে দিয়ে চাল বানিয়ে সেই চাল চীন থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করে এবং বেশ কয়েকজন মধ্যসত্বভোগী পেরিয়ে মুদীর দোকানে পৌছাতে পৌছাতে তা কখনোই ২০০-৩০০ টাকা কেজির কমে দেয়া সম্ভব না। সেই অবস্থায় কীভাবে ক্রেতা সেটা ৬০ টাকা কেজিতে কিনতে পারবেন?

একই যুক্তি খাটে ডিমের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের বাজারে একটা ডিমের দাম ৮ টাকার মতো। এখন ভেবে দেখুন, একটা নকল ডিম বানাতে যা লাগে, সেটা কয়েক হাজার মাইল দূরে চীন তেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করার খরচ সহ ৮ টাকার কমে কি দেয়া সম্ভব? দোকানদার আপনাকে ৮ টাকায় একটা ডিম বেচলে অবশ্যই লাভ রেখে বিক্রি করছে, কাজেই তার কেনা দাম ৮ টাকার অনেক কম। তাই হিসাবটা কি মিলে? দুনিয়ার সব ডিম ব্যবসায়ীরা কি অনেক টাকা লস দিয়ে নকল ডিম বেচবে, যেখানে আসল ডিম সস্তায় মুরগির কাছ থেকে পাওয়া যায়?

কাজেই ফেসবুকে ঢুকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলেই যা তা বিশ্বাস করবেন না, কমন সেন্সকে সিন্দুকে তালা মেরে রেখে আসবেন না। নকল ডিম আর প্লাস্টিক চালের গালগল্প বিশ্বাস করা বা শেয়ার করার আগে একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, এগুলো কি আসলেই সম্ভব কি না। অর্থনীতির হিসাব বলছে, সেটা সম্ভব না। ফেসবুকিং করছেন বলেই কি সবার কাছে কানপাতলা বিশ্বাসপ্রবণ হিসাবে নাম কিনবেন এসব শেয়ার দিয়ে? মান সম্মানের খাতিরে হলেও কমন সেন্স প্রয়োগ করুন, কান শক্ত থাকুন অনলাইনে, অফলাইনে, সর্বত্র।

২৫০৪ পঠিত ... ১৮:৫৩, এপ্রিল ২২, ২০১৮

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top