আপনি অশীতি থেকে শতায়ু হোন

৩৩১৩ পঠিত ... ১১:৫৩, নভেম্বর ৩০, ২০২৫

WhatsApp Image 2025-11-30 at 16.54.45_3a087a31

লেখা: সাফওয়ান রহমান 

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ২০১৪। ঘোর আওয়ামী কাল।

খালেদা জিয়াকে নিয়ে একটা অন্যরকম ভাবগম্ভীর মুগ্ধতা হয় তখন। একটা ঘটনা কেন্দ্র করে।

হাসিনা তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়ে নিজের অধীনে নিজেই নির্বাচনের সব বন্দোবস্ত করে ২০১৪ সালের ৫ ই জানুয়ারি নির্বাচনের আয়োজন করে। বিএনপি ঘোষণা করে মার্চ ফর ডেমোক্রেসি। ভয়াবহ আওয়ামী ক্র‍্যাকডাউন যথারীতি।

যখন সমস্ত দিক অন্ধকার, ছায়াসঙ্গী ফাতেমাকে নিয়ে গুলশানের বাসভবন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। হাতে বাংলাদেশের পতাকা। হাসিনার পুলিশ তাকে বাড়ির গেইটে ঘিরে ধরে। এখনও মনে আছে—সব টিভিতে গরম গরম লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। হাসিনা এত সাইকো ছিল, যে, শেষমেশ বালুর ট্রাক দিয়ে গুলশানের বাসাটা অবরুদ্ধ করে।

আমরা যারা ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের গৃহবন্দী আপসহীন খালেদা জিয়াকে দেখি নাই, সেই আপসহীন অপ্সরীকে দেখলাম ২০১৪ এর নির্বাচনে। যেন স্বর্গপ্রেরিত এক প্রবল মহীয়সী সেইদিন জল্লাদ হাসিনার চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, 'বাড়ি কোথায়? গোপালি?'

বেগম খালেদা জিয়া... তাঁকে নিয়ে আরও আমার বিশেষ কিছু মুগ্ধতার জায়গা আছে। যেটা গত ১০/১৫ বছরের পর্যবেক্ষণে উপলব্ধি।  

শেখ হাসিনা যেখানে 'আমার বাবা, আমার বাবা' বলতে বলতে মুখের ফেনা তুলে ফেলত; তার চোখে-মুখে অন্যরকম জোশ চলে আসত—সেখানে খালেদা জিয়ার মুখে এযাবৎকালে 'আমার স্বামী, আমার স্বামী' শুনি নাই। ‘স্বজন হারানো বেদনা’ তারও ছিল, কিন্তু তাকে কখনো তা ক্যাশ ইন করে নগ্ন পলিটিকাল বিজনেস করতে দেখি নাই।

শেখ হাসিনা শেষদিকে এসে, আমার ভাই শেখ কামাল-শেখ রাসেল, আমার মা বঙ্গমাতা—এদেরকেও রাষ্ট্রীয়করণ করে দেশটাকে যেন এক রাজপরিবারের কাছে বর্গা দিয়ে দেন। আমাদের জেন-জি যতবার শেখ কামালের গল্প শুনেছে, ততবার কেন, জীবনেও খালেদা জিয়ার মুখে তার ভাই-বোন-আম্মা -- কোনোকিছুর নাম জপতে দেখি নাই।

বাংলাদেশের পলিটিকাল স্পেক্ট্রামে যেই বিষয়টা আলোচনাই হয় না, তা হল খালেদা জিয়া বাংলাদেশে হাসিনার দ্বারা ভয়াবহ রকমের স্লাটশেইমডের শিকার। মুক্তিযুদ্ধের পর নাকি জিয়া তাকে ঘরে তুলতে চায় নাই কারণ কর্নেল জানজুয়ার সাথে তার পরকীয়া ছিল- এমন বিশ্রী অপবাদ হাসিনা অনেকবার আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে খালেদা জিয়াকে দিসেন।

শেষটায় যখন,খালেদা জিয়ার লিভার বিকল হতে থাকল - হাসিনা আওয়ামী লীগের সমাবেশে বলল যে - কি খাইলে লিভার পচে যায় সেটা আমরা জানি। কী পরিমাণ ডিসগাস্টিং জিঘাংসা থাকলে মানুষ এমন সাইকো হয়।

---

বাংলাদেশপন্থার এক অনবদ্য রূপায়ণ আমাদের খালেদা। ছিলেন ইন্ডিয়ার প্রবলতম মাথাব্যথার জায়গা। তাঁকে কখনো ভারত গিয়ে গরগর করে হিন্দি বলতে শুনি নাই। মনমোহন সিংয়ের শাসনামলে তিনি যখন ভারত সফর করলেন - মনে হল সিনা টান করে একখন্ড অভিমানী উচ্চশির বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে।  ঠিক যেমন মোরারজী দেসাইয়ের সাথে জিয়াউর রহমান সিনা টান করে দেখা করেছিলেন তার আমলে। অন্যদিকে আমরা দেখেছি হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে। - বলে আসত - ইন্ডিয়াকে বলেছি আমাদের ক্ষমতায় রাখতে।

খালেদা'র ফরেন পলিসি আমাকে অনেক কৌতূহলী করে। একহাতে নেমেসিস ভারত অন্য হাতে চীন, আরেক পাশে পাকিস্তান,  অন্যদিকে সার্ক সামলেছেন। পারভেজ মোশাররফকে ঢাকায় এনে স্মৃতিসৌধে নিয়েছেন—চীনের সাথে সফল নেগোসিয়েশন করেছেন—মধ্যপ্রাচ্যে লুক ওয়েস্ট পলিসি নিয়েছেন। নিয়েছেন লুক সাউথইস্ট পলিসি - বৈঠক করলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট মেঘবতী সুকর্ণপত্রীর সাথে। গেলেন থাইল্যান্ড। সার্ককে শক্তিশালী করেছেন। ঢাকায় সার্ক সামিট হোস্ট করেছেন। ছিলেন সাফটার প্রবল সমর্থক।

ঢাকায় একটা গুঞ্জন আছে যে ইরাক যুদ্ধে খালেদা জিয়ার কাছে মুসলিম সৈন্য চাইলে তিনি তা স্ট্রংলি ডিনাই করেন।

---

যেটা একেবারেই আলোচনা হয় না তা হল ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েই খালেদা জিয়া একটা বড়সড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দেন। লাখখানেক মানুষ মারা যায় সুপার সাইক্লোনে। খালেদা জিয়া নেগোসিয়েশন করে নিয়ে আসলেন 'অপারেশন সি এঞ্জেল'। সফলভাবে টেক্কা দিলেন অবস্থা।

----

জেএমবি'র মতো ভয়াবহ সিকিউরিটি থ্রেটকে নিউট্রালাইজ করেছেন তিনি।

----

আরেকটা জিনিস যেটা নজর কাড়ে তা হল—বাংলাদেশের ইতিহাসের সমালোচিত সময় ওয়ান-ইলেভেন। প্রচণ্ডরকম চাপ থাকা সত্ত্বেও এই ইস্পাত-দৃঢ় মানসী বাংলাদেশ ছাড়েন নাই- যেখানে হাসিনা দেশ ছেড়ে লন্ডন গেছেন। খোশমেজাজে ছিলেন।

১৯৯১ সালে খালেদা বলেছিলেন তার বিখ্যাত উক্তি–আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা, অন্যদের হাতে গোলামির জিঞ্জির।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর খালেদার জয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে সাপ্তাহিক বিচিত্রা লিখেছিল—তিনি কোনো দল অথবা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য রাখেননি। বরং একটি নির্দিষ্ট সময়ের দুঃশাসনকে বক্তব্য ও তথ্য দিয়ে তা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।

একানব্বইতে জিতে তিনি উপহার দিয়েছিলেন সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী। দৈনিক বাংলার সমীক্ষায় হয়েছিলেন বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব।

দলকে একাধিকবার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন। সবশেষ আঘাতটি দিয়েছিলেন মান্নান ভুইয়া। সেখান থেকেও বাউন্স ব্যাক করেন আপসহীন নেত্রী।

বায়োগ্রাফার মহিউদ্দিন আহমদ পর্যন্ত লিখেছেন, তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে।

হে মহীয়সী,

আপনাকে আমাদের বড্ড প্রয়োজন এই ট্রানজিশান পিরিয়ডে।

আপনি অশীতি থেকে শতায়ু হন, ফিরে আসতেই হবে।

৩৩১৩ পঠিত ... ১১:৫৩, নভেম্বর ৩০, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top